কালো টাকা শর্তহীন বিনিয়োগের সুযোগ-প্রণোদনা প্যাকেজ আজ ঘোষণা হতে পারে

শেয়ারবাজার সংকট নিরসনে সরকার বেশ কিছু সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে। আজ মঙ্গলবার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির এসব সিদ্ধান্ত ঘোষণার কথা রয়েছে। তবে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার আগে গতকাল সোমবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) স্পষ্ট করে জানিয়েছে, শেয়ারবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীকে তার আয়ের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা হবে না।


এছাড়া ব্যাংকগুলোর নগদ অর্থের সংকট নিরসনে সিআরআর ও এসএলআর রেট কমানোর বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে বলে জানা গেছে। তবে সামষ্টিক অর্থনীতি ও মূল্যস্ফীতি বিবেচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকই এ বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। প্রণোদনা প্যাকেজে সিআরআর-এসএলআর বিষয়ে কোনো ঘোষণা থাকবে না।
এদিকে প্রণোদনা চূড়ান্ত করতে গতকালও সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন এসইসির চেয়ারম্যান ও সদস্যরা। সরকারি প্রণোদনাগুলো যাতে ব্যর্থ না হয়, তা নিশ্চিত করতে এ বৈঠকে খুঁটিনাটি বিষয় পর্যালোচনা করা হয়েছে। বৈঠক শেষে এসইসির সদস্য হেলাল উদ্দিন নিজামী জানিয়েছেন, মঙ্গলবার এসইসির পক্ষ থেকে সরকারি প্রণোদনার ঘোষণা আসতে পারে।
কালো টাকা বিনিয়োগে এনবিআরের স্পষ্টীকরণ বিজ্ঞপ্তি : এখন থেকে পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগ করলে সরকারের কোনো সংস্থাই প্রশ্ন করবে না। বিনিয়োগকারী যে কোনো অঙ্কের টাকা সেকেন্ডারি বাজারে বিনিয়োগ করতে পারবেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কিংবা সরকারের অন্য কোনো গোয়েন্দা সংস্থা তার আয়ের উৎস সম্পর্কে জানতে চাইবে না।
গতকাল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিষয়টি স্পষ্টীকরণ করে এক আদেশ জারি করেছে। গতকাল সোমবার থেকেই ওই আদেশ কার্যকর করা হয়েছে। এর আগে শুধু এনবিআরের আইনে শেয়ারবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগে
প্রশ্ন না করার বিধান ছিল। এর বাইরে দুর্নীতি দমন কমিশন বা অন্য কোনো গোয়েন্দা সংস্থার প্রশ্ন করার সুযোগ থাকায় এ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। এই বিভ্রান্তি দূর করতে এনবিআর গতকাল বিষয়টি স্পষ্টীকরণ করেছে।
এদিকে শেয়ারবাজার চাঙ্গা করতে আরও কিছু ক্ষেত্রে কর ছাড়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আজ যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার কথা রয়েছে তাতে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার পর এনবিআর এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করবে। সম্প্রতি গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে শেয়ারবাজার স্থিতিশীল করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম শেয়ারবাজারে শর্তহীন কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ। গতকাল এনবিআর আদেশ জারি করে তা কার্যকর করে। সরকার আশা করছে, শর্তহীন কালো টাকা খাটানোর সুযোগ দেওয়ার ফলে অনেকেই সক্রিয় হবেন এবং বাজার চাঙ্গা হবে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, সেকেন্ডারি বাজারে বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে কর প্রণোদনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করলে যে পরিমাণ মুনাফা পাবেন তার আয় সম্পূর্ণ করমুক্ত থাকবে। এতদিন তাদের ১০ শতাংশ মুনাফার ওপর প্রযোজ্য হারে কর দিতে হতো। বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এই বিধান থাকার ফলে বিদেশিদের কাছ থেকে পুঁিজবাজার খাতে সরকারের আয় কমে গেছে। শেয়ারবাজারে বিদেশি পোর্টফোলিও বা বিনিয়োগ বাড়াতে তাদের মুনাফা করমুক্ত করা হলো। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ কর প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। দু'একদিনের মধ্যেই আদেশ জারি করে ওই সব সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে এনবিআর।
কালো টাকা বিনিয়োগ প্রশ্নে গতকাল এনবিআরের জারি করা আদেশে বলা হয়েছে, এনবিআর শেয়ারবাজার বিকাশে সবসময় সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে অপ্রদর্শিত আয় (কালো টাকা) শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল শেয়ারবাজারের বিকাশ ও এই খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করা।
একই বিবেচনায় চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরে অপ্রদর্শিত আয় বিনা ব্যাখ্যায় স্টক এক্সচেঞ্জে নিবন্ধিত কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীকে তার আয়ের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা হবে না।
আদেশে আরও বলা হয়েছে, কালো টাকা নিয়ে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসনকল্পে এবং বিনিয়োগকারীরা যাতে আস্থার সঙ্গে অপ্রদর্শিত আয় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারেন, সে লক্ষ্যে এনবিআর বিষয়টি স্পষ্টীকরণ করেছে।
আরও যা কিছু থাকছে : শেয়ারবাজার প্রণোদনা চূড়ান্ত করার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, সরকার যেসব প্রণোদনা ঘোষণা করতে যাচ্ছে, তাতে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের বিনিয়োগ বৃদ্ধিই প্রাধান্য পেয়েছে। ব্যাংকগুলোর সহযোগী মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসে প্রদত্ত ঋণ পরিশোধ এবং একক ঋণগ্রহীতা সীমা সম্পর্কিত শর্ত পরিপালনে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বোচ্চ পরিমাণ শিথিলতা প্রদর্শন করবে। এছাড়া দরপতনে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার বিষয়েও এতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে মার্জিন ঋণের সুদ মওকুফ ও আইপিওতে বিশেষ কোটা বরাদ্দ রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের চিহ্নিত করা এবং সুদ মওকুফের বিষয়টি জটিল হওয়ায় এ বিষয়ে ঘোষণা দিতে কিছুটা বিলম্ব হতে পারে।
গতকালের বাজার পরিস্থিতি : সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা ঘোষণায় কিছুটা বিলম্ব হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে শেয়ারবাজারের লেনদেনেও। তবে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী এখনও আশাবাদী। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বিনিয়োগও যথেষ্ট পরিমাণ বেড়েছে। গত বুধবার থেকে শেয়ারবাজার টানা ঊর্ধ্বমুখী এবং গতকাল দেশের উভয় শেয়ারবাজারে লেনদেন বাড়লেও সূচকের যথেষ্ট ওঠানামা লক্ষ্য করা গেছে। শেষ পর্যন্ত মিশ্রাবস্থার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে দিনের লেনদেন। ডিএসইতে লেনদেন হওয়া ২৫৬টি কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ১২৯টির দর বেড়েছে, কমেছে ১২১টির। সাধারণ সূচক ৯ পয়েন্ট বেড়ে ক্লোজ হয় ৫৩২২ পয়েন্টে। লেনদেন হয়েছে মোট ৫১৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা মূল্যের শেয়ার। অপর শেয়ারবাজার সিএসইতে লেনদেন হওয়া ১৭৭টি শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ১০৮টির দর বেড়েছে, কমেছে ৬৭টির। নির্বাচিত খাত সূচক ৯ পয়েন্ট বেড়ে ক্লোজ হয়েছে ৯৬৮২ পয়েন্টে। লেনদেন হয়েছে ৫৬ কোটি ৮ লাখ টাকার শেয়ার।
অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে এসইসির বৈঠক : শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা ফেরাতে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন প্রণোদনা নিয়ে আরও একবার বৈঠক করেছেন অর্থমন্ত্রী। গতকাল এ বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান, অর্থসচিব ড. মোহাম্মদ তারেক, ব্যাংক ও আর্থিক বিভাগের সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারী, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নজরুল হুদা এবং এসইসির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী জানান, 'শেয়ারবাজার নিয়ে গত কয়েক দিন আমরা যে সব বৈঠক করেছি, এটা তারই ধারাবাহিকতা। আজ আমরা বেশ কিছু বিষয় চূড়ান্ত করেছি। পুরো বিষয়টিই এসইসি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জানাবে।' মঙ্গলবার ব্রিফিং হবে কি-না, সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'বিষয়টি এসইসির, কবে ব্রিফিং করা হবে তারাই ভালো বলতে পারবে।'

No comments

Powered by Blogger.