ঝলক ধানের ক্ষতিপূরণ কিংবা মিছে আত্মতৃপ্তি-খাদ্য নিরাপত্তা by মোশাহিদা সুলতানা

ভেম্বর মাসের এক তারিখ। ২০১১। কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ শাখা থেকে তিনটি বীজ বিক্রেতা কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রায় ৬০ লাখ টাকার বীজ ও সার কৃষকদের দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চলতি বছর এনার্জি প্যাক এগ্রোর হাইব্রিড ধান ঝলক, মেসার্স মেটাল এগ্রোর হাইব্রিড ধান সারথি-১৪ এবং বহুজাতিক কোম্পানি সিনজেনটার টমেটো বীজ ব্যবহার করে হাজার হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন।


বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষতিপূরণ দাবি করে কৃষকরা বিক্ষোভ প্রকাশ করেন। বছরের প্রায় শেষ দিকে এসে ক্ষতিপূরণ বিষয়ে সরকারের এই নির্দেশকে অনেকেই একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। বিভিন্ন ব্যবসায়ী মহল থেকে শুরু করে আমলা, বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারক মহলের অনেকেই মনে করছেন, এই মৌসুমের ক্ষতি আগামী মৌসুমে বিনা মূল্যে বীজ ও সার সরবরাহের মধ্য দিয়ে পূরণ করলে কোম্পানি ও কৃষক উভয়েই লাভবান হবেন। তারা মনে করছেন, দেশের বিদ্যমান আইনে যেহেতু বীজ ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত হলে কৃষকদের সরাসরি আর্থিক ক্ষতিপূরণের কোনো বিধান নেই, কাজেই পরের বছরের বিনামূল্যে বীজ ও সার সরবরাহ করা একটি মধ্যবর্তী সমাধান মনে করা
যেতেই পারে ।
যে কোনো সমস্যা হলে বিভিন্ন আয়োজনকে বিভিন্ন মহল নিজেদের মতো করে সমাধান হিসেবে দাবি করতে পারে। যেমন_ ১. যে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সে যখন পুরোপুরি ক্ষতিপূরণ পায় তখন সেটা ক্ষতিগ্রস্তের কাছে সমাধান হয়; ২. যে ক্ষতি করে সে ক্ষতিপূরণ না দেওয়ার পেছনে কারণ দেখিয়ে বলতে পারে ক্ষতিপূরণ না দেওয়া একটি সমাধান; ৩. যে ক্ষতি করে সে ক্ষতিগ্রস্তকে তার ন্যায্য পাওনা না দিয়ে এবং তার নিজের মতো ক্ষতিপূরণ দিয়ে, বড় করে খবর ছাপিয়ে জনমত তৈরি করার মধ্য দিয়ে দাবি করতে পারে সে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। এখন আমরা এমন একটি সময়ে বসবাস করছি যখন আমাদের চারদিকে সকলেই ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পক্ষে কথা বলেন। আর তাই চক্ষুলজ্জায় পড়ে সহানুভূতিশীল হওয়া ও ব্যবসায়ে নৈতিকতা রক্ষা টিকে থাকার আয়োজনের মধ্যে একটি কৌশল হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। তাই এখন শুধু নামেমাত্র ক্ষতিপূরণ দিলেই চলে না, পাশাপাশি এর পক্ষে জনমত তৈরি করাও পুরো কৌশলের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তাই বুদ্ধিমান ব্যবসায়ীরা এখন আর প্রথম বা দ্বিতীয় সমাধানের ধারে-কাছে যায় না, এখন তৃতীয় সমাধানটিকেই ব্যবসায়ীরা লাভজনক মনে করে। কিন্তু তৃতীয় সমাধানটিও সহজ কাজ নয়। কারণ এর জন্য প্রয়োজন সুবিধাজনক আইন প্রণয়ন, নীতিনির্ধারণ ও সরকারের হস্তক্ষেপ। ঝলক ধানের এই বিশেষ ক্ষেত্রে আমরা কোম্পানিগুলোকে তৃতীয় সমাধানটিই বেছে নিতে দেখি এবং এখানে সরকারের মধ্যবর্তী অবস্থানটি, আইন ও নীতি সবকিছুই ব্যবসায়ীদের পক্ষে কাজ করতে দেখি। শুদ্ধ করে বললে বলতে হয়, আইন ও নীতির অনুপস্থিতিই এখানে তৃতীয় সমাধানের অনুকূল।
ঠিক এই মুর্হূতের বাস্তবতায়, অর্থাৎ কৃষকের অধিকার আদায় যখন বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক নীতির শিকার, সরকার যখন বেসরকারি উদ্যোক্তাদের পক্ষে এবং বীজ বিক্রেতারা যখন মুক্তবাজারের নামে আধিপত্য বিস্তারে তৎপর, তখন যেই সমাধানটি হওয়ার কথা ছিল ঠিক সেই সমাধানটিই হয়েছে ঝলক ধানের ক্ষেত্রে। তবে এই সমাধানটিকে সমাধান হিসেবে মেনে নিলে আগামী দিনে আমাদের দেশ ও জাতিকে চড়া মূল্য দিতে হবে বলে আমি মনে করি। আর তাই আমি পাঠকদের একটু ঘুরিয়ে ভাবতে বলব। চলুন কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার মধ্যে বুঝতে চেষ্টা করি কেন এই সমাধান আসলে দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। ১. এই সমাধানে ব্যবসায়ীদের স্বল্পমেয়াদে ও দীর্ঘমেয়াদে কী কী উপকার হচ্ছে? ২. এই সমাধানে কৃষকের স্বল্পমেয়াদে ও দীর্ঘমেয়াদে কী কী উপকার হচ্ছে? ৩. ভোক্তারা পুরো প্রক্রিয়া থেকে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?
প্রথমে দেখা যাক সরকার যাকে ক্ষতিপূরণ বলছে তা আসলে কী? সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোম্পানিগুলো বিভিন্ন অঞ্চলে প্রদর্শনী পল্গট করে বীজ উৎপাদন করবে এবং টমেটোর ক্ষেত্রে বহুজাতিক সিনজেন্টা রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের দেড় হাজার কৃষককে ২০ গ্রাম করে টমেটোর বীজ দেবে এবং ধানের ক্ষেত্রে এনার্জি প্যাক এগ্রো ও মেসার্স মেটাল এগ্রো মিলিতভাবে নোয়াখালী, গোপালগঞ্জসহ দেশের অন্যান্য এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত দুই হাজার কৃষককে দুই কেজি করে ধানবীজ, ২৫ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) ও ১৫ কেজি মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) সার সরবরাহ করবে।
ক্ষতিপূরণ প্রদান : ব্যবসায়ীদের জন্য কতটুকু ক্ষতিপূরণ প্রদান আর কতটুকু বিনিয়োগ?
প্রথমত, কৃষকের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ কত তার হিসাব করতে গেলে হিসাব করতে হবে কৃষকের শ্রমের মূল্য, বিনিয়োগকৃত পুঁজির পরিমাণ, পুঁজি ঋণ হিসেবে পেয়ে থাকলে ঋণের পরিশোধিত সুদ এবং আবাদের পর আকাঙ্ক্ষিত ফসলের মূল্য। সেই হিসেবে ক্ষতির পরিমাণ হওয়ার কথা বিপুল পরিমাণ। অথচ দেশব্যাপী দশ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের মধ্যে মাত্র দুই হাজার কৃষকের জন্য পরবর্তী বছরে বীজ, সার দিয়ে প্রদর্শনী পল্গটের ব্যবস্থা করার মধ্য দিয়ে বীজ বিক্রেতা এনার্জি প্যাক বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া থেকে এই দফা নিস্তার পেল। দ্বিতীয়ত, এই ক্ষতিপূরণ নামে ক্ষতিপূরণ হলো এবং ব্যবসায়ে নৈতিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা গেল। তৃতীয়ত, গণমাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রচার করে ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা গেল। চতুর্থত, নিজের উৎপাদিত বীজ সরবরাহ করে এর ভবিষ্যৎ বাজার নিশ্চিত করা গেল। এর মধ্য দিয়ে বাড়তি কোনো অর্থ ব্যয় করতে হলো না। পঞ্চমত, সরকারের নির্দেশ মান্য করার মধ্য দিয়ে কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণে কোম্পানির দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হলো এবং ষষ্ঠত, জনগণ জানল কৃষকের ক্ষতিপূরণ দিতে বিপুল অর্থ গচ্চা দিতে হলো অথচ কোম্পানির জন্য এই ধরনের ক্ষতিপূরণ দেওয়া আসলে তাদের ভবিষ্যৎ ব্যবসা নিশ্চিত করার জন্য বিনিয়োগ।
ক্ষতিপূরণ গ্রহণ : কৃষকের জন্য লাভ না পরবর্তী দুর্যোগে ক্ষতিপূরণ লাভের অনিশ্চয়তা?
প্রথমত, যদিও নোয়াখালী অঞ্চলের কৃষকরা এই নামেমাত্র ক্ষতিপূরণ নিতে অস্বীকার করেছে; কিন্তু এই ক্ষতিপূরণ নিলেও কৃষক তার ন্যায্য ক্ষতিপূরণ অর্থাৎ ফসলের ক্ষতির সমপরিমাণ অর্থ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হলো। দ্বিতীয়ত, কৃষক এই ক্ষতিপূরণ থেকে তার ঋণের আসল ও সুদ বাবদ কোনো অর্থ পাবে না। তৃতীয়ত, ফসল হারিয়ে এর বদলে পাবে বীজ। পরবর্তী ফসল ঘরে তোলার আগ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন ব্যয়ের জন্য ঋণ করে সুদে জর্জরিত হওয়া ছাড়া প্রকৃত অর্থে অন্তর্বর্তীকালীন ভোগান্তির জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ পাবে না। অপূরণীয় সামাজিক ক্ষতি মোকাবেলায় যেমন ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি চাহিদা মেটাতে কৃষকের যেই সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে তার কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না। বরং প্রথম বছরের ক্ষতির অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করতে গিয়ে পরের বছর অধিক পারিবারিক শ্রম দিতে হবে।
ভোক্তাদের ভবিষ্যৎ ভোগান্তির দ্বার উন্মুক্তকরণ : বীজ আইনে ক্ষতিপূরণের ধারা যুক্ত না হওয়াতে ভবিষ্যতেও এই ধরনের প্রদর্শনী পল্গটের মাধ্যমে 'ক্ষতিপূরণ' দেওয়ার প্রক্রিয়াকে একটি মডেল হিসেবে কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি হলো। এতে করে বড় ধরনের বিপর্যয় হলে তার দায়ভার বহন করতে হবে কৃষককে এবং বর্ধিত মূল্যে ভোক্তারা খাদ্য কিনতে বাধ্য হবে, অথবা জরুরি ভিত্তিতে সরকারকে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে ভর্তুকি দিয়ে খাদ্য আমদানি করতে হবে। সরকার ভর্তুকি না দিলে তখন সাধারণ জনগণ বিদেশ থেকে বেশি মূল্যে খাদ্য আমদানি করতে বাধ্য হবে।
এই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার মধ্য দিয়ে সরকার বেসরকারি বিক্রেতাদের ব্যবসা করার পথ উন্মুক্ত করে দিল। এরই মধ্যে আমরা বেসরকারি বীজ বিক্রেতাদের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করে কৃষকের কোম্পানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর পথ করে দিয়েছি। অথচ আমরা ভাবছি না যে বীজ উৎপাদন ক্রমেই বাণিজ্যিক হয়ে গেলে খাদ্য উৎপাদন মূল্য বৃদ্ধি পাবে। জনগণকে বেশি মূল্যে খাদ্য কিনতে হবে। এর ভার দরিদ্র ভোক্তাকেই দিতে হবে।
হাইব্রিডের ওপর নির্ভরতা বাড়লে অতিরিক্ত সার ব্যবহার বাড়বে, উৎপাদন মূল্য বাড়বে এবং কৃষকের আরও বড় ঝুঁকি মাথায় নিয়ে মাঠে নামতে হবে। এরই মধ্যে কৃষি পেশা হিসেবে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে। সরকার বীজ ব্যবসায়ীদের জন্য সব সুবিধা উন্মুক্ত করে দিয়ে দিন দিন কৃষিকাজে কৃষকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। যেই নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, হাইব্রিড বীজ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ভার্টিক্যাল উৎপাদনশীলতা বাড়বে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। জনগণ তাদের প্রশ্ন করতে পারে, খাদ্য নিরাপত্তা মানে কি শুধুই উৎপাদন বৃদ্ধি, নাকি খাদ্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা? সেই অর্থে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর দোহাই দিয়ে বীজের বাজার বাণিজ্যিকীকরণ করলে কি দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, নাকি ব্যবসায়ীদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে?
কৃষককে অভুক্ত রেখে, নামেমাত্র ক্ষতিপূরণ দিয়ে, পরম আত্মতৃপ্তিতে যে নীতিনির্ধারক মহল খাদ্য নিরাপত্তার পেছনে ছুটছেন তাতে খাদ্য নিরাপত্তা অবশ্যই নিশ্চিত হবে, তবে তা শুধু নীতিনির্ধারক মহল ও ব্যবসায়ীদেরই, আপামর জনগণের নয়।

মোশাহিদা সুলতানা : অর্থনীতির শিক্ষক ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
smosh@alum.mit.edu

No comments

Powered by Blogger.