সাম্প্রতিক-বিপন্ন সরকার এবং উভয় সংকটে আওয়ামী লীগ!

র্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। দেশে তারল্য সংকট চলছে। কমে গেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে ভর্তুকি কমাচ্ছে সরকার। জ্বালানি খাত থেকে নাকি সরকার ভর্তুকিই তুলে দিতে চায়। কয়েক দিন আগে আরো এক দফা বাড়ল জ্বালানি তেলের দাম। শিগগিরই বাড়বে বিদ্যুতের দামও। এসব নিয়ে দেশের বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদরা পেরেশান।


নিজেদের পেরেশানির প্রতিটি বিষয় কী কারণে এবং কতটুকু পেরেশানির, তা খুঁটিনাটি বিশ্লেষণসহ বুঝিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেসব কারণ ব্যাখ্যায় কান না দিয়ে গত শনিবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, দেশে অর্থনৈতিক কোনো সংকট নেই। বিশ্ব মন্দার এই সময়ে বাংলাদেশ নাকি খুব ভালো অবস্থানেই আছে।
দেশ ভালো অবস্থানে আছে, এটা অবশ্যই ভালো খবর। কিন্তু খবরটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য? শীর্ষস্থানীয় যেসব অর্থনীতিবিদ দেশের সাম্প্রতিক অর্থনীতি নিয়ে আশঙ্কার কথা বলছেন, তাঁরা কি মিথ্যা বলছেন? তাঁদের সঙ্গে সরকারের কোনো বিরোধ আছে বলে তো জানা নেই। তাঁরা কেন সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে যাবেন?

অর্থনীতি ভালো আছে!
ক্ষমতাবানরা সমালোচনা পছন্দ করে না। বর্তমান সরকারও এর ব্যতিক্রম নয়। এই বছর তিনেকের শাসনামলে বহু ভুল আর ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সরকার। কিন্তু সেসব বিষয় সরকার ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেছে সব সময়। আর এই চাপা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় যাঁরা জনস্বার্থেও বাধা হয়েছেন, তাঁদেরই উল্টো ভুল প্রমাণের চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ। এতে দৃশ্যত বা কার্যত কোনো সুবিধাই সরকার লাভ করেনি। উল্টো এমন কিছু মানুষকে সরকার শত্রুস্থানীয় করে ফেলেছে, যাঁদের পরামর্শ কিংবা অংশগ্রহণ সরকারের কর্মকাণ্ডকে আরো ত্বরান্বিত করতে পারত।
একটি সরকার দেশের উন্নয়নে অনেক কাজের উদ্যোগ নেবে বটে, তবে তার সবই যে সফল হবে, এমন কোনো কথা তো নেই। কিছু সাফল্য থাকবে, কিছু ব্যর্থতা থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক। সাফল্যগুলো যেভাবে উদ্যাপন করা হয়, তেমনিভাবে ব্যর্থতাগুলোও যদি প্রকাশ্যে আলোচিত হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু ব্যর্থতাগুলো শুধরে নেওয়ার পরবর্তী পথটাও সুগম হয়। কিন্তু বিরোধী দলের সমালোচনার ভয় নিয়ে যেকোনো ব্যর্থতা ঢেকে রাখতে চায় সরকার। কিন্তু সত্য কি কখনো চাপা থাকে? প্রকাশিত হয়ে যায়। তাতে সরকারের স্বচ্ছতা নষ্ট হয়, সাধারণ মানুষের আস্থা হারায়। নিজেদের ব্যর্থতা চেপে রাখার চেষ্টা না করে সেসব বিষয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করা উচিত। ব্যর্থতা বা সংকট থেকে উত্তরণের পথ সম্মিলিতভাবে খোঁজা উচিত। কিন্তু আত্মসমালোচনা শোনার অভ্যাসটা বোধ হয় আমাদের রাজনীতিবিদদের হবে না কোনো দিনই। প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন, অর্থনীতি ভালো আছে। তাহলে জ্বালানি খাতের ভর্তুকি কেন তুলে দিতে চায় সরকার? দুই দিন পরপর কেন বাড়ানো হচ্ছে জ্বালানি তেলের দাম? রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা কেন হাতে নেওয়া হয়েছিল? আর সেটা যদি খুব প্রয়োজনীয়ই হতো, তাহলে সিএনজি ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বন্ধের হুমকি শুনে সেই সিদ্ধান্ত থেকে পিছু কেন হটল সরকার? খুচরা বিদ্যুতের দাম কেন বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে? বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে মূল্যবৃদ্ধি মানেই জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি। দেশের অর্থনীতি যদি ভালোই থাকে, তাহলে জনগণের দুর্ভোগ কেন বাড়াতে চায় সরকার? প্রশ্ন অনেক, কিন্তু উত্তর নেই।

গুজবের ডালপালা
ঘরে-বাইরে উভয় সংকটে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় থাকা কোনো দল এর আগে এতটা বিপন্ন অবস্থায় পড়েছে বলে মনে হয় না! সরকার দ্রব্যমূল্য সামলাতে পারছে না, জনদুর্ভোগ বাড়ছে। এ নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে জনমনে। অসন্তোষ আওয়ামী লীগের ঘরেও। দলের ভেতর তো দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে ছিল আগে থেকেই। সেই দ্বন্দ্ব-জটিলতা এখন বিরাট আকার ধারণ করেছে। অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে দলটির মধ্যে, সরকারেও। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম পদত্যাগ করেছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। সৈয়দ আশরাফ পদত্যাগ করেননি এবং নিজ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কাজ করছেন বটে, তবে এখনো কিন্তু তিনি নিজ মুখে পদত্যাগের বিষয়টি সম্পর্কে কোনো কথাই বলেননি।
সৈয়দ আশরাফের মতো আওয়ামী লীগের আরো অনেক নেতার পদত্যাগ কিংবা পদ রদবদলের খবর বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। কৃষিমন্ত্র্রী মতিয়া চৌধুরী, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু, ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা, শিল্পমন্ত্রী দীলিপ বড়ুয়া, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুসহ আরো অনেকেই পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন বলে গুজব শোনা যাচ্ছে। যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান পদত্যাগের নির্দেশ পেয়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলেও খবর শোনা গেছে। (সূত্র : দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১৮ নভেম্বর)
সরকারের পক্ষ থেকে এসব বিষয় খোলাসা করা হয়নি। তবে আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধিরা বলেছেন, এগুলো গুজব; এবং আওয়ামী লীগকে বিব্রত করতেই এগুলো ছড়ানো হচ্ছে।
তাতেও কিন্তু আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতাই প্রকাশিত হচ্ছে। দলের এত সিনিয়র এবং গুরুত্বপূর্ণ পদের নেতাদের পদত্যাগ কিংবা রদবদলের খবর তখনই ছড়িয়ে পড়তে পারে, যখন একটি দলের সাংগঠনিক যোগাযোগ এবং জিজ্ঞাসা থাকে না। ক্ষমতা অতি কিংবা অপব্যবহারের কারণে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তৃণমূলের। সরকারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর বিরুদ্ধেও অসন্তুষ্ট দলীয় নেতা-কর্মীরা। বহুবার তাঁদের রদবদলের দাবি উঠেছে বটে, কিন্তু দাবি বাস্তবায়িত হয়নি। এখন হঠাৎ করে পদত্যাগ ও রদবদলের যে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে, তা নিয়ে সরকার বা আওয়ামী লীগের অবাক নীরবতায় দলটির তৃণমূলে ভীষণ অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে, যা বাড়তেই থাকবে। আওয়ামী লীগ যদি শক্ত হাতে এসব বিষয় সামাল দিতে না পারে, তাহলে বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনের ধাক্কা সামলানো সরকারের জন্য কষ্টকরই হয়ে যাবে।

No comments

Powered by Blogger.