মানবতাবিরোধী আপরাধের বিচার-'সাঈদী ভুয়া মাওলানা'

জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-প্রক্রিয়ায় ট্রাইব্যুনালে সূচনা বক্তব্য শেষ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ, তিনি একজন ভুয়া মাওলানা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার থেকে বাঁচার জন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই পিরোজপুর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ১৯৮৬ সালে পিরোজপুরের পাড়েরহাটে


যান ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য দেওয়ার জন্য। ভুয়া মাওলানা সেজে ওয়াজ মাহফিল করেন। এর আগ পর্যন্ত সাঈদী আত্মগোপনে ছিলেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গতকাল সোমবার সূচনা বক্তব্যে এসব অভিযোগ তুলে ধরেন রাষ্ট্রপক্ষের কেঁৗসুলি।
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আবারও সাঈদীর বিরুদ্ধে অপরাধগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পিরোজপুরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও জামায়াত নেতা সাঈদীর নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী ব্যাপক গণহত্যা, লুটপাট, নারী ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। আওয়ামী লীগসহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল এবং হিন্দু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার অভিপ্রায়ে এটা করা হয়, যা এ ট্রাইব্যুনালে বিচার্য বিষয়।
অন্যদিকে সাঈদীর পক্ষে সাক্ষী জোগাড় করতে তাঁর আইনজীবীরা পিরোজপুরে যাবেন বলে ট্রাইব্যুনালকে অবহিত করেছেন। এ জন্য সেখানে নিজেদের নিরাপত্তা চেয়ে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনা চেয়েছেন তাঁরা।
সাঈদীর বিচার শুরুর অংশ হিসেবে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে রবিবার ট্রাইব্যুনালে সূচনা বক্তব্য শুরু করা হয়। কিন্তু ওই বক্তব্য শেষ না হওয়ায় গতকাল অসমাপ্ত বক্তব্য শেষ করে রাষ্ট্রপক্ষ। প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান অসমাপ্ত বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সকাল ১০টা ৪৩ মিনিট থেকে বক্তব্য শুরু হয়ে ১১টা ৪৩ মিনিটে শেষ হয়। তাতে সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হয়। ওই সময় রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, জেয়াদ আল মালুম, রানা দাসগুপ্ত, মোখলেসুর রহমান বাদল প্রমুখ। সাঈদীর আইনজীবীদের মধ্যে ছিলেন তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার তানভীর আহমেদ আল আমীনসহ কয়েকজন।
গতকাল রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্যে বলা হয়, সৈয়দ আফজাল হোসেন পিরোজপুরে শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন। তবে সাঈদী আরবি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শী এবং বাকপটু হওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন এজাজের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ কারণে তিনি রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার হতে সক্ষম হন। তাঁর নেতৃত্বে এবং সহযোগিতায় পিরোজপুরের পাড়েরহাট বন্দরসহ বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ, অগি্নসংযোগ, লুট, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাকিস্তানি সেনা সদস্য, ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস সদস্যদের আটক করেন মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু সাঈদী আত্মসমর্পণ না করে অস্ত্রসহ পিরোজপুর থেকে পালিয়ে যশোরের বাঘারপাড়া থানার রওশন আলীর বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে আত্মগোপন করে থাকাবস্থায় স্থানীয় লোকজন তাঁর পরিচয় জেনে যায়। এ কারণে সেখান থেকে পালিয়ে যান সাঈদী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর সাঈদী নিজেকে মুক্ত মনে করেন। এরপর ১৯৮৬ সালে পাড়েরহাট যান। সেখানে তিনি ভুয়া মাওলানা সেজে ওয়াজ মাহফিল করেন।
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হয়, পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় সহযোগীরা নির্বিচারে নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে ধরে হত্যা, গণহত্যা করেছে। স্বর্ণালংকারসহ ব্যাপক লুটপাট করে, অগি্নসংযোগ করে। তারা যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে বর্ণিত অপরাধ করেছে।
গতকাল সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন শেষ হলে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক রাষ্ট্রপক্ষকে উদ্দেশ করে বলেন, 'আগামী ৭ ডিসেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন। তা আপনাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।'
এরপর সাঈদীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালে বলেন, 'আমরা দেশে-বিদেশে তদন্ত করছি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা প্রয়োজন। আমরা পিরোজপুরে যাব। কিন্তু নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের নিরাপত্তা দিতে পুলিশ বাহিনীর প্রতি নির্দেশনা চাইছি।'
জবাবে ট্রাইব্যুনাল বলেন, 'প্রয়োজন নেই। আপনারা যেদিন যাবেন, তার আগে এসপিকে চিঠি দেবেন। আশা করি, সব ঠিক থাকবে।'
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মামলায় গত বছরের ২৯ জুন সাঈদীকে তাঁর শাহীনবাগের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ২ আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এরপর শুনানি শেষে গত ১৪ জুলাই তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ৩ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.