বোলিং-ফিল্ডিং মন্দ নয়, তবু প্রায় তিন শ by নোমান মোহাম্মদ

লেন্ডল সিমন্সের বদলে সেঞ্চুরিটা ড্যারেন ব্রাভো করলেই হতো! স্মৃতির সরণি ধরে এক যুগ আগের বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ছবিটা কাল তাহলে ফিরে আসত আরো উজ্জ্বল হয়ে! ফিরে আসতেন ব্রায়ান লারা, জাতিস্মরের ব্যাটে চড়ে।টেস্ট-ওয়ানডে মিলিয়ে ক্যারিয়ারে মোট ৫৩টি সেঞ্চুরি করেছেন লারা। কিন্তু ১৯৯৯ সালের ৯ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ইনিংসটির মতো খুনে মেজাজে তাঁকে দেখা গেছে কমই। সেটি শুধু ৪৫ বলের সেঞ্চুরির কারণেই নয়। বোলারদের নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলায় যে মেতেছিলেন ক্যারিবিয়ান যুবরাজ।


পেসার-স্পিনার সবার বিপক্ষেই তাঁর রুদ্ররূপ; ভয়াল সৌন্দর্যের কী অপূর্ব সেই প্রদর্শনী! তাতেই তো ৫০ ওভারে ৩১৪ রানের পাহাড়ে চড়ে বসেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।বাংলাদেশের বিপক্ষে সেটি ক্যারিবিয়ান দলীয় সর্বোচ্চ স্কোর। কাল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান করে তারা আরেক ওপেনারের সেঞ্চুরিতে। এই লেন্ডল সিমন্সও লারার দেশ ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর। কিন্তু 'লারার ক্লোন' তো তিনি নন। সেটি ড্যারেন ব্রাভো। ওই রকমই বাঁহাতি, ব্যাটে বল ছোঁয়ানোর মুহূর্তের সেই ট্রেডমার্ক ছোট্ট লাফ, কবজির কারুকাজ আর ফুটওয়ার্কের বিচক্ষণতায় লারারই জাতিস্মর। যতক্ষণ ব্যাটিং করেন, মনে হয় যেন তা রুপালি প্রজাপতির নাচন। কাল যদি এই ড্যারেন ব্রাভোর সেঞ্চুরিতে তিন শ ছুঁই ছুঁই স্কোরে যেত ওয়েস্ট ইন্ডিজ, তাহলেই না ১২ বছর ৪ দিন আগের বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম পুরোমাত্রায় ফিরত কালকের শেরেবাংলায়।
তবে একটা পার্থক্য থেকে যেত তাও। সেদিন বাংলাদেশের বোলার-ফিল্ডারদের একেবারে এলোমেলো করে দিয়েছিলেন লারা। লাইন-লেন্থ ভুলে গিয়ে একের পর এক ভুল করছিলেন মঞ্জুরুল ইসলাম-শফিউদ্দিন আহমেদ। কাল অবশ্য সেই দোষে দুষ্ট নন উত্তরসূরিরা। বরং বলা যায়, রুবেল-রাজ্জাক-সাকিবরা যত খারাপ বোলিং করেছেন, ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যানরা খেলেছেন এর চেয়ে ভালো। একটু বেশিই ভালো!
অথচ তপ্ত দুপুরে শুরুটা কিন্তু মন্দ ছিল না বাংলাদেশের। অধিনায়ক হয়ে টানা দ্বিতীয় ম্যাচ টস জিতেছিলেন মুশফিকুর রহিম। দুই প্রান্ত থেকে নতুন বলে শফিউল ইসলাম ও রুবেল হোসেনের শুরুটা ছিল দারুণ। প্রথম পাঁচ ওভারে ১১ রানের বেশি দেননি তাঁরা। কিন্তু সকালের সূর্য যেমন সব সময় দিনের পূর্বাভাস দেয় না, মধ্যাহ্নের এই আনন্দ তেমনি অপরাহ্নের আলোয় হয়ে গেছে মলিন। ষষ্ঠ ওভারে আদ্রিয়ান বারাথের বাউন্ডারি দিয়ে শুরু রানের জলোচ্ছ্বাস। নিজে ২১ রানের বেশি করতে পারেননি। হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে পড়ে ১৫ ওভার শেষে বেরিয়ে গেছেন মাঠ ছেড়ে। কিন্তু সতীর্থরা সেটি বুঝতে দিলেন কই! দিলে তো আর বাংলাদেশকে প্রথম উইকেটের জন্য ২৪৭তম বল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না!
টোয়েন্টি টোয়েন্টিতে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন অধিনায়ক মুশফিকুরের বিচক্ষণতা। বিশেষত তাঁর বোলিং পরিবর্তন ছিল চোখে পড়ার মতো। সবাইকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্যবহার করে ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যানদের থিতু হতে দেননি। কাল ওয়ানডেতেও সেই চেষ্টা ছিল পুরোমাত্রায়। ছিল না কেবল সাফল্য। তাতে ক্রিকেটের এক আপ্তবাক্য প্রমাণিত হলো আরেকবার_অধিনায়ক ততটাই ভালো, যতটা ভালো তাঁর দল।
এই দল হিসেবে কাল প্রথম ইনিংসে অন্তত যোজন ব্যবধানে এগিয়ে সফরকারীরা। পরিকল্পনা ছিল, তবে সেটি কাগুজে না থেকে প্রকাশিত মাঠের পারফরম্যান্সে। খুব যে ধুন্ধুমার ব্যাটিং করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, তা না। বরং ছিল ভিন্ন কন্ডিশনে ভিন্ন উইকেটে দ্রুত খাপ খাইয়ে নেওয়ার পেশাদারি দক্ষতার ছাপ। তাই তো ৫ ওভারে যে দলের রান ছিল ১১, ইনিংসের অর্ধেক পথ পেরিয়ে যাওয়ার পর তা ১১১। ৩৫ ওভার শেষে ছিল ১৬৪, কিন্তু হাতে উইকেট থাকায় শেষ ১৫ ওভারে তারা তোলে ১৩৪ রান। বুঝুন অবস্থা!
প্রথম উইকেটে সিমন্স-বারাথ ৬৭ রান করার পর পরেরজনের ইনজুরিতে সিমন্স-স্যামুয়েলসের আরো দেড় রান যোগ। এই পুরোটা সময় তেমন কোনো সুযোগই তাঁরা দেননি বাংলাদেশকে। একটাই ব্যতিক্রম। ৩৬.৩ ওভারে সাকিবের বলে স্যামুয়েলসের কঠিন ক্যাচটি ধরতে পারেনি মুশফিক। পরের বলে মিডউইকেটে ঠেলে ১ রান নিয়ে ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি পেয়ে যান সিমন্স। ১১২ বলে চারটি বাউন্ডারি, দুটি ওভার বাউন্ডারিতে তিন অঙ্কে যাওয়ার পর আরো দুর্বার তিনি। বিশেষত শফিউলের করা ৪০তম ওভারে চারটি বাউন্ডারি মেরে কাঁধ ঝুলিয়ে দেন স্বাগতিক ফিল্ডারদের। ওয়াইড থেকে আরেকটি বাউন্ডারিতে ওই ওভারে হয় ২১ রান।
৪২তম ওভারের প্রথম বলে প্রথম আনন্দ করার সুযোগ পায় বাংলাদেশ। রুবেলের বলে শর্ট ফাইন লেগে অলক কাপালিকে ক্যাচ দিয়ে আউট হন সিমন্স। দুই বল ব্যবধানে ৭৮ বলে ৭১ রান করে স্যামুয়েলসও আউট। কী লাভ তাতে! ব্যাটিংদানব কিয়েরন পোলার্ড যে ক্রিজে আসেন এরপর। ষষ্ঠ বলে সাকিবকে অনায়াস ছক্কা মেরে শুরু করেন ঝড়। পাওয়ার-টাইমিংয়ের যুগলবন্দিতে ২৫ বলে ৪১ করেছেন কিছু বুঝে ওঠার আগেই। ইনিংসে দুটি বাউন্ডারি ছাড়াও সাকিব-শফিউল-রাজ্জাককে মারা বিশাল তিনটি ছক্কা। সঙ্গে লারার প্রতিচ্ছবি হয়ে ড্যারেন ব্রাভোর ১৯ বলে ২০ রান। তবে শেষ ওভারের প্রথম বলে পোলার্ড আউট হওয়াতেই হয়তো তিন শ ছোঁয়া আর হলো না ওয়েস্ট ইন্ডিজের।
তাতে কী! '৯৯-এর লারার ওয়েস্ট ইন্ডিজের কথা তো কাল মনে করালেন সিমন্স-স্যামুয়েলস-পোলার্ডরা। সেবার ২০৫ রানে অল আউট হয়ে ১০৯ রানে হেরেছিল বাংলাদেশ। কাল অল আউট না হলেও হারটা ৪০ রানের।

No comments

Powered by Blogger.