জেলখানা থেকে চিঠিঃ শুরু না শেষ? by সুভাষ সিংহ রায়

প্রয়াত সাহিতি্যক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের প্রবচনগুচ্ছ আমি যে কতবার পড়েছি তার কোনো হিসাব নেই। তাঁর একটি বিখ্যাত প্রবচন হচ্ছে, 'বাঙলার বিবেক খুবই সন্দেহজনক। বাঙলার চুয়াত্তরের বিবেক সাতাত্তরে পরিণত হয় সামরিক একনায়কের সেবাদাসে।' তিনি বড় বেশি অপ্রিয় সত্য বলতেন যে কারণে তাঁকে ঘাতকরা রেহাই দেয়নি। বাংলাদেশে দিন দিন এ রকম সত্য বলার লোক কমে যাচ্ছে। যারা ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্দুর বাকশাল কর্মসূচির প্রচারে বিরোধিতা করেছিল তারাই জিয়াউর রহমানের 'জাগদল'-এর ঝান্ডা উড়িয়েছিল।

দল ভেঙে দল গঠন কীভাবে করতে হয় তা জিয়াউর রহমান শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। সল্ফপ্রতি শেখ হাসিনা দল ভাঙার সরকারি অপচেষ্ঠার তীব্র সমালোচনা করেছেন। এ নিয়ে যথরীতি সরকারি প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। শেখ হাসিনা এমনকি শুধু আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে বলেননি; এমনকি বিএনপির নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদের কিশোরী মেয়ে গ্রেফতারের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাছাড়া কর্মীদের প্রতি ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন, প্রয়োজনে তারা তাঁর বিরুদ্ধে বলতে পারেন। রামকৃষষ্ণ পরমহংস দেব তাঁর প্রিয় শিষ্য গিরিশ ঘোষকে 'বকলমা' দিয়ে দিতে বলেছিলেন। আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মীরা এখনো মনে করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী যা কিছু বলার, সে কেবল অপমানিত মনুষ্যত্বের দিকে তাকিয়ে। একথা সবাই স্বীকার করবেন, সরকারের কেউ কেউ স্ববিরোধী কথা বলছেন। একবার বলা হচ্ছে, দলীয় সংস্কার সল্ফঙ্হৃর্ণ দলের ব্যাপার। আবার বলা হচ্ছে, দলীয় সংস্কার সল্ফঙ্ন্ন না হলে ঘরোয়া রাজনীতি চালু করা যাবে না। একবার বলা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক এই পরিস্থিতিতেও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ করতে প্রস্থুত; আবার বলা হলো রাজনৈতিক দল সংস্কার কার্যক্রম শেষ না করলে আলাপ করবেন না। এক উপদেষ্ঠা বলছেন, 'দুই নেত্রী ব্যর্থ, তাদের র্বজন করা উচিত।' আবার তিনি এর আগে বলেছেন, দলের নেতা-নেত্রী নির্বাচন করবে দলগুলো। একমাত্র সৃষ্টিকর্তায় জানেন এ অবস্থা কতদিন চলবে। আওয়ামী লীগের নেতা চতুষ্ঠয় এখন অভ্যন্তরীণ সংস্কার নিয়ে ব্যস্ত। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমার্বতন অনুষ্ঠানে গভর্নর মোনায়েম খানের সভাপতিত্ব সেই সময়কার ছাত্র সমাজ মেনে নেয়নি। ছাত্ররা তাদের ডিগ্রি মোনায়েম খানের হাত থেকে গ্রহণ করবে না বলে জানিয়েছিল। এ নিয়ে হাঙ্গামা ঘটে। প্যান্ডেল ভেঙে তছনছ করা হয়। এ ঘটনায় অনেকে জখমও হয়। ছাত্রদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গৃহীত হয়। বেশ কয়েকজন ছাত্রকে গুরুতর অসদাচরণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এদের অন্যতম ছিলেন ছাত্রলীগের শেখ ফজলুল হক মনি। চারজন ছাত্রকে ৫ বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। ছয়জন ছাত্রকে তিন বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয় ও ১৪ জনকে করা হয় দুই বছরের জন্য। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আজকের আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক। আমরা জানি, আবদুর রাজ্জাক সাহেব অনেক আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছেন। আজকে বাংলাদেশে সব জায়গায় 'সংস্কার সংস্কার' জিকির করা হচ্ছে। আবদুর রাজ্জাকসহ আওয়ামী লীগের বড় বড় কয়েকজন নেতা যেন সংস্কারের সোল এজেন্সি নিয়েছেন। আমাদের ভাবতে আশ্চর্য লাগে এই নেতারা বেশ কয়েক দশক দেশের রাজনীতিতে অবদান রেখেছেন। এক্ষেত্রে আবারো ড. হুমায়ুন আজাদকে স্মরণ করতে হয়। তিনি বলেছিলেন, 'বিপল্গবীদের বেশিদিন বাঁচা ঠিক নয়। বেশি বাঁচলেই তারা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।' একবিংশ শতাব্দীর এ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা প্রকৃত রাজনৈতিক নেতার চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে বলে দলের কর্মীরা মনে করে। বঙ্গবন্দুর মৃত্যুর পর জাতীয় চার নেতা আপস করেননি বলে তাঁদের হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু কর্মীরা আজ কষ্ঠ পাচ্ছে দলের নেতাদের অসংলগ্ন আচরণ দেখে। বঙ্গবন্দুর ত্যাগের মহিমার কথা সবাই জানেন। তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তার কথা তাঁর চরম শত্রুও স্বীকার করবে। ১৯৬৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারিতে দৈনিক সংবাদে বঙ্গবন্দুর ভাষণের একটা অংশ ছাপা হয়েছিল। পাঠকদের জন্য এই পরিসরে তার কিছুটা উলেল্গখ করছি। 'আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করছে কায়েমি স্বার্থবাদীরা। কেন করছে তা ওরা ভালো জানে। আওয়ামী লীগের সামনে এমন গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক কাজ রয়েছে যা একমাত্র আওয়ামী লীগকেই করতে হবে। বাঙালি জাতির মুক্তিই আমাদের শেষ কথা। এজন্য দীর্ঘদিনব্যাপী আমাদের লড়াই করতে হবে এবং সেজন্যই আমাদের প্রস্থুত হতে হবে সব রকম ত্যাগের জন্য।' আর তাই তো বঙ্গবন্দুর আদশরাউর এই বিচু্যতি দেখলে কর্মীরা গুমরে গুমরে কেঁদে ওঠে। বইতে পড়েছি, রাজনৈতিক নেতাদের জেলে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। বঙ্গবন্দু শেখ মুজিব জীবনের প্রায় অধরাউক সময় জেলে কাটিয়েছেন। নেলসন ম্যান্ডেলা জেলখানার ভেতরে বলতে গেলে সমগ্র জীবনটাই কাটিয়ে দিয়েছেন। কবি নজরুলের জেল জীবনের কথাও আমরা জানি। এই জেলখানার ভেতরে পৃথিবীর একমাত্র কবি নজরুল একটানা ৩৯ দিন অনশন করেছিলেন। কবিকে কলকাতার জেল থেকে হুগলি জেলে আনা হয়েছিল কোমরে দড়ি বেঁধে।
জেলখানায় ঢুকেই উদাত্ত স্বরে 'দে গরুর গা ধুইয়ে' বলে হাঁক ছেড়েছিলেন। এখন আমাদের নেতাদের অনেকে জেলখানায় বন্দি। কিন্তু এই জেলখানার ভেতরের কাহিনী জেলখানার ভেতরে থাকছে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল জেলখানা থেকে এক ঢাউস চিঠি পাঠিয়েছেন। সবসময় শুনে এসেছি জেলখানার বাইরে চিরকুট আসে। জেলখানা এখন এত উন্নত হয়েছে যে, কম্পিউটার কম্পোজ করা চিঠি এখন বাইরে বাজারজাত করা হচ্ছে। গত ৭ জুলাই এটিএন বাংলার রাতের 'লিড নিউজ' অনুষ্ঠানে সাপ্তাহিক ২০০০-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক গোলাম মোতর্জা আলোচনার এক প্রসঙ্গে বলেছেন, আবদুল জলিল সাহেবের চিঠির ভাষায় যদি সরকারের সমালোচনা থাকত তাহলে এই চিঠি এভাবে প্রচারিত হতো নমুনা আরো দেখা যাবে।

No comments

Powered by Blogger.