দলীয় রেজিস্ট্রেশন এবং সংবিধান by শেখ গোলাম মোস্তফা

কিছুদিন আগে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি টিভি টক শো দেখেছিলাম। একটিতে প্রধান বক্তা অর্থাৎ যাকে কেন্দ্র করে টক শো, তিনি ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হদুা। অন্য টক শোর কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বের কথা এ মুহহৃতরাউ মনে পড়ছে না। তবে অংশগ্রহণকারীদের অন্যতম ছিলেন ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর। রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্দন সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি সঙ্ষ্ঠভাবে বলেছিলেন, সংশ্লিষ্ঠ দলের নিবন্দনের ক্ষেত্রে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করা হবে।
ওই পরীক্ষার সময় দলের গঠনতন্ত্র আমাদের দেশের সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি-না সেটা বিবেচনায় অবশ্যই আসবে। সিইসি এর বেশি কিছু বলেননি। বলার প্রয়োজনও নেই। ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর বলেছিলেন, আমাদের দেশের কোনো কোনো দলের গঠনতন্ত্র দেশের সংবিধানের সঙ্গে একেবারেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এমনকি সংশ্লিষ্ঠ সেসব দলের গঠনতনে্পর কোনো কোনো অংশ আমাদের সার্বভৌম রাষ্ট্রের আদশরাউরও পরিপন্থী।
তবে ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ মুজিবনগরে স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঘোষণাপত্রে এ কথা সুসঙ্ষ্ঠভাবে বলা হয়েছিল যে, এ দেশের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী একমাত্র জনগণ। ১৯৭২ সালে প্রণীত আমাদের পবিত্র সংবিধানের মূল প্রস্তাবনায় একই কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের তিন যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে। সময়ের বির্বতনে ক্ষমতাসীনরা সংবিধানের অংশবিশেষ নিজ নিজ স্বার্থে পরির্বতন করেছেন। এমনকি রাষ্ঠ্রীয় চার মূলনীতির অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষতাকে পর্যন্ত বাদ দিয়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ায় রাষ্ট্রের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ পর্যন্ত কী অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, এ প্রশ্ন বারবার মনে জাগে। এতে যা হয়েছে তা হলো, রাষ্ঠ্রীয় মূলনীতি পরির্বতনে রাষ্ঠ্র তার চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্য হারিয়েছে। যে আদর্শকে সামনে রেখে দেশের আপামর জনগণ ইতিহাসের একটি শ্রেষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল সে কক্ষপথ থেকে আমাদের বিচু্যত করা হয়েছে। মুষ্টিমেয় স্বাধীন বা বিরোধী শক্তি বিচু্যতির ওই সোপান বেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের অভীষ্ঠ লক্ষে আঘাত হেনে চলেছে অবিরত। আমরা অসহায়ত্ব নামক এক অতল গহ্বরে পড়ে আছি।
তিন যুগ ধরে সংবিধানের নানা ধারা-উপধারা পরির্বতন করা হলেও জনগণই যে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার উৎস তা পরির্বতনের চেষ্ঠা কেউ করেনি। জনগণের হাতে সব ক্ষমতা ন্যস্ত বলেই নির্বাচন কমিশনের এত ব্যস্ততা। ভোটার আইডি কার্ড, ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স_ এমনি নানা ধরনের কর্মতাৎপরতায় লিপ্ত নির্বাচন কমিশন। কমিশনের একটাই উদ্দেশ্য এবং তা হলো, সুষ্ঠুভাবে আয়োজিত এবং জনগণের স্বতঃসম্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হওয়া নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোট সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করবে। এতে লক্ষণীয় বিষয়, যেটি সেটি জনগণই রাষ্ট্রের মূল শক্তি, অন্য কেউ নয়। ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর এই মৌলিক বিষয়টির প্রতি সেদিনের টক শোতে উপস্থিত শ্রোতাদের এবং অগণিত টিভি দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, যা আমার দৃষ্টি এবং শ্রবণশক্তি এড়ায়নি। এখন সংস্কার প্রশ্নে আওয়ামী লীগের তিনজন সিনিয়র নেতা এবং বিএনপির একজন বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। নিজস্ব দলের চেয়ারপারসন বা সভাপতির একক ক্ষমতা রহিত করা, সভাপতিম-লী, উপদেষ্ঠাম-লী অথবা কার্যনির্বাহী কমিটিকে পাশ কাটিয়ে দলীয় প্রধানের একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের দীর্ঘ প্র্যাকটিস রদ করা, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের দলে না রাখা, দলের তহবিলের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা_ এসব নানা বিষয়, নানা সংস্কার প্রস্তাবগুলোতে স্থান পাচ্ছে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে দেখতে পাচ্ছে সাম্প্রদায়িক দলগুলো, ধর্মই যাদের একমাত্র অবলম্বন এবং দলীয় গঠনতনে্পর বিভিন্ন ধারা-উপধারায় যেখানে রাষ্ঠ্র পরিচালনায় জনগণের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি একান্তভাবে অনুপস্থিত বলে জেনে এসেছি, রাষ্ঠ্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সংবিধানের মৌলিক ও অপরিহার্য উপাদান জনগণের ক্ষমতার স্বীকৃত সত্যকে প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে এখনো তারা সম্পূর্ণ নীরব। রাজনৈতিক দলের নিবন্দীকরণের প্রশ্নে নির্বাচন কমিশন এখন কী ভূমিকা নেয় সেটা দেখার বিষয়।
একই কথা বারবার ঘুরেফিরে আসছে গত ৩৬ বছর ধরে এবং তা হলো, আমরা মুক্তিযুদ্ধে জীবনকে বাজি রেখে অস্ত্র ধরেছিলাম। এ দেশের ধর্ম-র্বণ, গোত্র-শ্রেণী নির্বিশেষে সবার সার্বিক মুক্তির জন্য, কোনো বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীর উন্নয়ন বা অপরকে পদানত করে রাখার জন্য নয়। পবিত্র সংবিধানে সে অধিকার সুনিশ্চিত করা হলেও সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থেই দীর্ঘকাল ধরে তা উপেক্ষা করে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠকে প্রথম শ্রেণীর নাগরিক, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয়, এমনকি তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মর্যাদা দিয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের বদলে এই যে দৈ্বতনীতি তা ভোট প্রয়োগের ক্ষেত্রে, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এবং সামাজিক সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়নের কাজে রাষ্ঠ্র পরিচালকদের ওপর কার্যকরভাবে প্রভাব বিস্তার করে এসেছে ওই ধর্ম ব্যবসায়ীরা_ যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ধর্মকে পুঁজি করে ধাপে ধাপে রাষ্ঠ্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দেশকে অনেক পেছনে নিয়ে যাওয়া। এই ধর্ম ব্যবসায়ীরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি শুধু বিরোধিতাই করেনি, তারা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধা নিধন উৎসবে মেতে উঠেছে, অগণিত মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠন করেছে, দেশকে প্রগতিশীল নেতৃত্বশহৃন্য করতে বেছে বেছে তাদের হত্যা করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে নেতৃত্বের অদূরদর্শিতার সুযোগ নিয়ে তারা মেধা বিকাশের পথ রদুব্দ করে তরুণ শ্রেণীকে বিপথগামী করার জন্য ধর্মাশ্রয়ী অন্দ চেতনায় উৎসাহ জুগিয়ে চলেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলো, এখন সংস্কার নামক বস্থুটির দিকে ছোটার সুযোগে দেশের বড় দলগুলোর ঘোষিত সংস্কার কর্মসূচিতে এদের প্রতিহত করার যে মহৌষধ '৭২ সালের সংবিধান পুরোপুরি পুনরুজ্জীবন, সে প্রশ্নে বাম দলগুলোর কেউ কেউ কথা বললেও বড় দলগুলোর যেন এ নিয়ে তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। বিএনপির পক্ষে '৭২ সালের সংবিধান পুনরুজ্জীবনে বাধা কোথায়? তাদের সঙ্গে ধর্মীয় প্রতিযোগিতায় নেমে আওয়ামী লীগ নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশকে সরাসরি আঘাত করেছে। ধর্মীয় রাজনীতি দেশের সার্বিক উন্নয়নে কী অবদান রেখেছে সে সম্পর্কে সবার আত্নোপলব্ধির সময় সমুপস্থিত। শিল্প, কৃষি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, খনিজসম্পদ আহরণ, উন্নত প্রযুক্তির উদ্ভাবন, সমদু্রসম্পদ আহরণ, জনসম্পদের সঠিক ব্যবহারে ধর্ম-র্বণ-নির্বিশেষে সমশক্তির সঠিক ব্যবহার এবং সর্বোপরি দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে ধর্ম ব্যবসায়ীরা কী অবদান রেখেছে, এ প্রশ্ন সংশ্লিষ্ঠ সবারই। ধর্ম ব্যবসায়ীদের ্টারা যারা এতকাল ব্যবহূত হয়েছেন তাদের চৈতন্যোদয় হওয়া প্রয়োজন। রাজনীতির একমাত্র উদ্দেশ্য হলো_ দল ক্ষমতায় গিয়ে হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট বা মানব উন্নয়নের সরল পথগুলো অনুসন্ধান ও তা বাস্তবায়নে আত্ননিয়োগ করবে। ধর্মচর্চার জন্য গৃহ-অভ্যন্তর এবং সংশ্লিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপাসনাগুলোর স্ট্যবহারই উত্তম জায়গা। উদারপন্থিরা মনে করেন, সাম্প্রদায়িক দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণে বাধা হবে না, যদি তারা তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরির্বতন করে; তারা যদি পবিত্র সংবিধানকে মান্য করে দলীয় গঠনতনে্প জনগণের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়; যদি তারা যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থার জন্য গঠনতনে্প সুসঙ্ষ্ঠ দিকনিদরাউশনা সম্পর্কিত ঘোষণা দেয় এবং সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার জন্য জনগণের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে। দলীয় গঠনতনে্প এসব বিষয় বিশেষত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবলিত পবিত্র সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে এ দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মহীরুহ উপড়িয়ে ফেলতে পারে একমাত্র নির্বাচন কমিশন, দলীয় রেজিস্ট্রেশনের সময়। ওই ধর্মান্দরা এখন কৌশল পাল্কেল্ট নিচ্ছে। স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে নাকি নতুন মূল্যায়ন করবে। এসবই ভাঁওতাবাজি এবং চক্রানেস্নর ফাঁদ। ধর্ম ব্যবসায়ীরা এখন চুপ আছে বটে কিন্তু অপকৌশল আঁটতে বসে নেই। নির্বাচন কমিশন সংবিধান সামনে রেখে রেজিস্ট্রেশনের খাতা খুললে অনেকেরই রাজনীতি বন্দ হয়ে যাবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের প্রয়োজন দেশের সমৃদ্ধি এবং তা স্বল্প সময়ের মধ্যেই। ধর্ম ব্যবসায়ীদের মস্তিষ্ফে্ক সে উর্বরতা অনুপস্থিত।

No comments

Powered by Blogger.