লালবাগ কেল্লার ৪ একর 'নেই', পুকুর শুকিয়ে মাঠ by নওশাদ জামিল

ইফেল টাওয়ার বললে প্যারিস আর বিগবেন বললে লন্ডন শহরের নাম আসে। প্রাচীন ঢাকার কথা বললে ভাসে লালবাগ কেল্লার প্রতিচ্ছবি। তবে ঢাকার এই গর্ব ও ঐতিহ্যকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ, সংস্কার এবং এর দখল ঠেকাতে পারেনি সরকার। মুঘল আমলের এই ঐতিহাসিক স্থাপনার চার একর জায়গা ইতিমধ্যেই 'নেই' হয়ে গেছে। কেল্লার জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।গত ৩ মার্চ লালবাগ কেল্লাকে দখলমুক্ত করতে হাইকোর্ট পাঁচ দফা নির্দেশনা দেন। হাইকোর্ট কেল্লাটির ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্তি্বক স্থাপনাগুলোর প্রকৃত অবস্থান (পরী বিবির মাজার, চারপাশের দেয়াল ইত্যাদি) যেভাবে আছে সেভাবে সংরক্ষণ করতেও নির্দেশ দেন।


এ ছাড়া তিন মাসের মধ্যে এর সম্পত্তি ও সীমানা জরিপ করতেও সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
জানা যায়, দখলকারীরা এ বিষয়ে রিট আবেদন করলে আদালত স্থগিতাদেশ দেন। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক আবদুল খালেক বলেন, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে অধিদপ্তর আপাতত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
ইতিহাসবিদ, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও নগর উন্নয়নবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রতিবেদন ১৯১৭ অনুযায়ী লালবাগ কেল্লার আয়তন ছিল ২২ একর। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাগজপত্র ও দলিলেও কেল্লার জায়গার পরিমাণ ২২ একর। এ ছাড়া ব্রিটিশ আমলে ডয়েলির অঙ্কিত চিত্র এবং ভূমি জরিপেও ২২ একর জায়গার উল্লেখ রয়েছে। কেল্লার পশ্চিম ও পূর্ব পাশে দখলদাররা দেয়াল ভেঙে কিংবা দেয়াল ঘেঁষে নতুন স্থাপনা নির্মাণ করায় এর আয়তন এখন দাঁড়িয়েছে ১৮ একর।
জানা যায়, অর্ধশত বছর আগে থেকেই শুরু হয় কেল্লার প্রাচীর ভেঙে জায়গা দখল। দখলদারদের কালো থাবা ২০১১ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে অনেক গুণ। বছরের পর বছর চোখের সামনে কেল্লা দখল অব্যাহত থাকলেও টনক নড়েনি প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, কেল্লার সীমানা নির্ধারণকারী দেয়ালটি বেখাপ্পাভাবে ভেতরের দিকে ঢোকানো। সেখানে দেয়াল ভেঙে দাঁড়িয়ে তিনটি দালান। ১৯৫৪ সালে মাহবুবা খাতুন সারিবদ্ধভাবে তিনটি দালানের মাঝখানেরটি ফিরোজা বেগমের কাছে বিক্রি করে দেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় ফিরোজা বেগম পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসেমের কাছে এগুলো বিক্রি করেন। উত্তর পাশের ভবনটি দ্বীন মোহাম্মদের ডস কম্পানির কারখানা হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। অন্য ভবনটি বিএনপির প্রভাবশালী নেতা জনৈক লেনিনের দখলে রয়েছে। পূর্ব পাশেও কেল্লার জায়গায় কয়েকটি স্থাপনা গড়ে উঠেছে।
লালবাগ কেল্লা কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, ভবনগুলোর কারণে কেল্লার স্বাভাবিক অবকাঠামো ও সৌন্দর্য ব্যাহত হয়েছে। জমির পূর্ববর্তী দখলদার ফিরোজা বেগম ওই স্থানে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য রাজউকের কাছে নকশা চাইতে গেলে রাজউক তাঁকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাছ থেকে অনুমতিপত্র নিয়ে আসতে বলে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর তাঁর দাবিটি নাকচ করে দেয়। কিন্তু তারপর কিভাবে ভবন উঠেছে_এ বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
সরেজমিনে এর সত্যতাও মেলে। কেল্লার সীমানার ভেতরে এবং দেয়ালের গায়ে দেয়াল গেঁথে দখলদাররা তিনটি বাড়ি নির্মাণ করেছে অনেক আগেই। বাড়ি তিনটির মালিক মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক আবুল হাসেম, স্থানীয় বিএনপির নেতা লেনিন ও বাবুল চৌধুরী।
নগর বিশেষজ্ঞ ও স্থপতি সামসুল ওয়ারেস কালের কণ্ঠকে বলেন, কেল্লার নিজস্ব চার একর জায়গা স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এটা জানে। রাজউকও তা জানে। কিন্তু ওই জায়গা পুনরুদ্ধারের কোনো উদ্যোগ নেই। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি আরো জানান, ভারত সরকার তাজমহলকে রক্ষা ও সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে আশপাশের সব কারখানা ও ভারী যানবাহন বন্ধ করে দিয়েছে। সেখানের এক ইঞ্চি জমিও দখলদারদের হাতে নেই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, লালবাগ কেল্লার পশ্চিম পাশে মূল সীমানাপ্রাচীর ভেঙে কেল্লার ভেতরে নির্মাণ করা বাড়িগুলো কেল্লার মূল নকশা অনুসারে অবৈধ। এ ছাড়া কেল্লার আশপাশে ভবন নির্মাণের সময় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অনুমতি নেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু কেল্লার আশপাশে গড়ে ওঠা প্রায় ৩০টি ভবন বা বাড়ির কোনোটিরই অনুমতি নেওয়া হয়নি। পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইন অনুসারে এগুলোও অবৈধ। এসব ভবনে রাজউকের কোনো প্রকার অনুমতি নেই বলেও রাজউক জানিয়েছে। কিন্তু অবৈধ এই স্থাপনা ভাঙা কিংবা এর কোনো প্রকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি কর্তৃপক্ষ। বরং অনুমতিহীন এসব ভবনে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ সব ধরনের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে প্রমাণ হয়, কর্তৃপক্ষের জ্ঞাতসারেই এসব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছিল।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, 'আদি নকশা অনুসারে লালবাগ কেল্লার অনেক জায়গাই এখন আর নেই। সেটা মোটামুটি চার একর হবে। মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে আমরা জানিয়েছি।'
কিভাবে লালবাগ কেল্লার মতো একটি জাতীয় ঐতিহ্য ও স্থাপনার জায়গায় এসব ভবন নির্মিত হলো_এ প্রশ্ন করলে রাজউক ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে কোনো উত্তর মেলেনি। অভিযোগ আছে, কেল্লার দেয়াল ঘেঁষে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণে রাজউক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কিছু কর্মকর্তারও সহযোগিতা রয়েছে।
শিল্প সমালোচক অধ্যাপক মইনুদ্দীন খালেদ বলেন, চার শ বছরের পুরনো ঢাকার অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন লালবাগ কেল্লা। এর সীমানার মধ্যে অবৈধভাবে তিনটি বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ রক্ষার জন্য ব্যক্তিমালিকানার বাড়ি উচ্ছেদ করতে হবে।
লালবাগ কেল্লার কাস্টডিয়ান নাসিমা শাহীন বলেন, 'দখল শুরু হওয়ার পর থেকে বাধা দেওয়ার পাশাপাশি কেল্লার জমিতে স্থাপনা নির্মাণ না করার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু দখলদাররা এ বিষয়ে গুরুত্ব তো দেয়ইনি, উল্টো স্থাপনা নির্মাণে বাধা দেওয়ায় তারা মামলা করেছে।'
জানা যায়, ঐতিহ্য সংরক্ষণে দেশে তিনটি আইন আছে। এগুলো হচ্ছে অ্যান্টিকিউটিস অ্যাক্ট-১৯৭০, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-২০০৬ এবং সিটি করপোরেশন অধ্যাদেশ। সব আইনেই পুরাকীর্তি সংরক্ষণের ব্যাপারে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। লালবাগ কেল্লা সরকার ঘোষিত হেরিটেজ এলাকা। ১৯৭২ সালে লালবাগ কেল্লা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
কেল্লার বেহাল দশা : সরেজমিনে দেখা গেছে, লালবাগ কেল্লার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দক্ষিণ পাশের তিনতলা তোরণটি (১০০ টাকার নোটে মুদ্রিত) জরাজীর্ণ অবস্থায় কোনোমতে টিকে আছে। তোরণদ্বার বন্ধ। বাইরে দেয়াল ঘেঁষে কয়েকটি দোকান। একটি দোকানে চুলা জ্বালিয়ে পুরি ও পেঁয়াজু বানিয়ে বিক্রি করা হয়। কেল্লার দেয়াল ঘেঁষে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। চারপাশের দেয়ালে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার পোস্টার ও ব্যানার শোভা পাচ্ছে।
কেল্লার ভেতরের অবস্থাও করুণ। পূর্ব দিকে ২৩৫ বর্গফুট পুকুরটি পানিহীন, শুকনো। বেড়াতে যাওয়া অনেক শিশু পুকুরের শুকনো তলায় নেমে ছোটাছুটি করে। পাশের হাম্মামখানা ও দরবার হলকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। জাদুঘরের মুঘল নিদর্শন দেখতে প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক দর্শক আসে। লোকসংখ্যা বেশি হলে তাদের পদচারণে দরবার হলের দোতলায় মৃদু কম্পন অনুভূত হয় বলে জানা যায়। প্রায় সোয়া তিন শ বছরের পুরনো দরবার হলটি এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। দর্শকদের ভিড়ে যেকোনো দিন বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
মাঠের মাঝখানে পরী বিবির মাজার। পশ্চিম প্রান্তে শাহজাদা আজমের তৈরি মসজিদ। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, মসজিদটি দুর্গের ভেতরে অবস্থিত হলেও এর পরিচালনার দায়িত্ব দুর্গের বাইরের স্থানীয় একটি কমিটির। মসজিদে যাতায়াতের জন্য কেল্লার উত্তর দেয়ালের পশ্চিম প্রান্ত কেটে একটি সরু পথ করা হয়েছে। লালবাগ মসজিদটি মুঘল স্থাপত্য নিদর্শন হলেও এর ওপর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, লালবাগ কেল্লা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, বিশ্বের ইতিহাসেও এক অনন্য স্থাপত্য। এ ধরনের স্থাপত্যের দখল সভ্য সমাজ মেনে নিতে পারে না। কেল্লা দখলমুক্ত ও যথাযথ সংস্কার করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.