‘ভাগ্যবান জামির’ ২১ জেলা স্থবির

লচ্চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদ আর শিক্ষক-সাংবাদিক মিশুক মুনীরদের বহনকারী মাইক্রোবাসের সঙ্গে যে বাসটির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল, সেই বাসের চালক জামির হোসেনের মুক্তিসহ সারা দেশে অন্য চালকদের বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় করা মামলা বাতিলসহ কয়েকটি দাবিতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় পরিবহন ধর্মঘট চলছে। গত ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকায় ওই ঘটনায় পাঁচজন নিহত হন।

ঢাকায় গতকাল বুধবার সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা যোগাযোগমন্ত্রীর কাছে ১১ দফা দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন। লিখিত দাবিগুলোর মধ্যে বাসচালক জামিরের মুক্তির প্রসঙ্গ ছিল না। তবে স্মারকলিপি দেওয়ার সময় পরিবহনের নেতারা জামিরের মুক্তির জন্য চাপ সৃষ্টি করেছেন বলে জানা গেছে।
নৌপরিবহনমন্ত্রী ও সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী উপদেষ্টা শাজাহান খানসহ নেতারা যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের কার্যালয়ে গিয়ে ওই স্মারকলিপি দেন।
একপর্যায়ে যোগাযোগমন্ত্রীর মৌখিক আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে সড়ক পরিবহনের নেতারা গতকাল সকাল থেকে শুরু হওয়া ধর্মঘট দুপুর ১২টার দিকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন বলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়। কিন্তু পরে দেখা যায়, সব জেলায় ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়নি। ফলে বিকেল পর্যন্ত ঢাকা থেকেও ওই সব জেলায় বা জেলাগুলোর ওপর দিয়ে চলাচলকারী আন্তজেলা বাস ছেড়ে যায়নি। ফলে দেশের এক-তৃতীয়াংশ জেলার যাত্রীদের গতকাল দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।
গতকাল দুপুরে রেল ভবনে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা কাউন্সিলের সভার পর সংবাদ সম্মেলনের সময় সাংবাদিকেরা কথিত ধর্মঘট প্রত্যাহার এবং আলোচিত বাসচালক জামিরের মুক্তির বিষয়ে চাপ সৃষ্টির প্রসঙ্গে নৌমন্ত্রী শাজাহান খানকে প্রশ্ন করতে চাইলে যোগাযোগমন্ত্রী বাদ সাধেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, উপদেষ্টা কাউন্সিলের সভা যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একটি অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানে নৌপরিবহনমন্ত্রী অতিথি। এখানে তাঁকে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।
বাস ধর্মঘট প্রসঙ্গে যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন বলেন, কিছু দাবি নিয়ে এ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছিল। দাবি পূরণের আশ্বাসের ভিত্তিতে ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি, দাবিগুলো সুনির্দিষ্টভাবে জেনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইনের বাইরে গিয়ে আমরা কোনো সহযোগিতা করতে পারব না।’
তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের নিহত হওয়ার ঘটনায় করা মামলার আসামি বাসচালককে মুক্তি দেওয়ার দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসে বাস ধর্মঘট প্রত্যাহার হয়েছে কি না—জানতে চাইলে যোগাযোগমন্ত্রী ও উপস্থিত নৌপরিবহনমন্ত্রী উভয়েই বলেন, বিষয়টি তেমন নয়।
ছাত্র-শিক্ষক-পেশাজীবী জনতার ব্যানারে নিরাপদ সড়ক ও স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চেয়ে আন্দোলন করছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। পরিবহনের মালিক-শ্রমিকদের ধর্মঘট, স্মারকলিপি, ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা ও আংশিক বাস্তবায়নের বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে জনবিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করছে। এ ঘটনার বিষয়ে আমার মন্তব্য হলো, আমরা জাতি হিসেবে দুর্ভাগা হয়ে পড়লেও বাসচালক হিসেবে একজন জামির অনেক ভাগ্যবান হয়ে উঠছেন।’
স্মারকলিপি: স্মারকলিপিতে প্রধান দাবি হিসেবে উল্লেখ করা হয়: টায়ার-টিউবের দাম কমানো, ফেডারেশনের সঙ্গে আলোচনা না করে একতরফাভাবে বিআরটিএর ভাড়া না বাড়ানো, চালকসংকট নিরসনে জেলায় জেলায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, সড়ক পরিবহন খাতকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা, এ খাতকে চাঁদাবাজিমুক্ত করা, যানবাহন রিকুইজিশনের হয়রানি বন্ধ করা প্রভৃতি। এ দাবিগুলোই মূলত শহীদ মিনারের সমাবেশে উল্লেখ করা হয়।
সূত্রগুলো জানায়, শাজাহান খানের নেতৃত্বে ফেডারেশনের প্রতিনিধিদল যোগাযোগমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার পর চালক জামিরের মুক্তির দাবি জানায়। তাঁরা বলেন, জামিনযোগ্য ধারায় মামলা হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে জামিন দেওয়া হচ্ছে না। ফলে সড়ক পরিবহন খাতে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। তার প্রকাশ ঘটছে ধর্মঘটের মাধ্যমে।
এ সময় সেখানে উপস্থিত সড়ক বিভাগের সচিব মো. মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘মামলা জামিনযোগ্য ধারায় হলেও ম্যাজিস্ট্রেট সমস্যা আছে বলে মনে করলে জামিন না-ও দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে পুনরায় জামিনের আবেদন করার সুযোগ আছে।’
যোগাযোগমন্ত্রী তাঁদের বলেছেন, জামিনের বিষয়টি আইনগতভাবে মীমাংসা করতে হবে। আর যেসব দাবি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত, সেগুলোর ব্যাপারে তিনি পদক্ষেপ নেবেন।
উপদেষ্টা পরিষদের সভা: জাতীয় ও আঞ্চলিক সব মহাসড়কের ওপর থেকে অস্থায়ী হাটবাজার সরিয়ে দেওয়াসহ সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কতিপয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদ।
গতকাল দুপুরে রেল ভবন মিলনায়তনে যোগাযোগমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পরিষদের ৩৫তম সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সভা শেষে যোগাযোগমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, মহাসড়কের ওপর যেসব অস্থায়ী হাটবাজার আছে, সেগুলো সরিয়ে দেওয়া ও নতুন করে যাতে হাটবাজার বসতে না পারে, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসনকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। মহাসড়কে অতিরিক্ত ভারী যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে ওজন স্কেল স্টেশন স্থাপন, প্রয়োজনীয়সংখ্যক রেকার কেনা, অবৈধভাবে স্থাপিত স্পিডব্রেকার অপসারণ, গাড়িতে ফিটনেস স্টিকার বাধ্যতামূলক করা, মহাসড়কে নছিমন চলাচল বন্ধ করা এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে দীর্ঘসূত্রতা নিরসনের সিদ্ধান্ত হয়।
ঈদে মানুষ নির্বিঘ্নে ঘরে ফিরতে পারবে দাবি করে যোগাযোগমন্ত্রী বলেন, গত ঈদের সময় রাস্তার যে অবস্থা ছিল, তার চেয়ে এখন অবস্থা অনেক ভালো। রাস্তার কোথাও চলাচলের অনুপযোগী থাকলে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পরিষদের সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক, সড়ক বিভাগের সচিব, বিআরটিএর চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান খান, বিভাগীয় কমিশনার ও পুলিশের বিভিন্ন রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠন, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.