কালোটাকা উড়ছে নারায়ণগঞ্জে! by শরিফুল হাসান ও আসিফ হোসেন

র মাত্র তিন দিন পরই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। জমে উঠেছে নির্বাচনী প্রচারণা। কিন্তু প্রচারণার শেষ মুহূর্তে এসে প্রার্থীদের প্রধান উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কালোটাকা। প্রধান তিন মেয়র পদপ্রার্থীর মধ্যে দুজন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও তৈমুর আলম খন্দকার তাঁদের এই উদ্বেগের কথা গতকাল গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। আইভী প্রথম আলোকে বলেন, কালোটাকা ছড়িয়ে একটি মহল সব ভোট কিনে নিতে চাইছে। এ ব্যাপারে কমিশনকে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার কালোটাকার পাশাপাশি সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়েও উদ্বিগ্ন।
এই দুই প্রার্থী যাঁকে নিয়ে উদ্বিগ্ন, সেই শামীম ওসমানও প্রথম আলোকে বলেছেন, কালোটাকা ছড়ানো হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমি নই, অন্য প্রার্থীরা এটা করছেন।’ তিন প্রার্থীই বলছেন, কালোটাকার ছড়াছড়ির কারণে ভোটের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। একই কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সম্মিলিত নাগরিক পরিষদও। আর নির্বাচন কমিশন বলছে কঠোর ব্যবস্থার কথা।
মেয়র পদপ্রার্থী আইভীর সমর্থনে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী ও স্বাধীনতার পক্ষের বিভিন্ন পেশাজীবী ও নাগরিক সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে সম্মিলিত নাগরিক পরিষদ।
গতকাল বিকেলে পরিষদের নেতারা শহরের দেওভোগে আইভীর বাসায় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তাঁরা বলেন, কালোটাকার ছড়াছড়ির কারণে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়েই শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ভয় দেখানোসহ বিভিন্ন কৌশলে জিম্মি করার চেষ্টা চলছে।
নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন গতকাল নারায়ণগঞ্জে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, কালোটাকার ছড়াছড়ি রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা বিশ্বাস লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কালোটাকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’
নাগরিক পরিষদের অভিযোগ: গতকাল সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে সম্মিলিত নাগরিক পরিষদ কালোটাকা ছড়াছড়ির জন্য সরাসরি শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে। তারা বিষয়টিকে ‘মারাত্মক’ আখ্যায়িত করেছে।
নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক ও জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক এস এম আকরাম বলেন, টানবাজার সুইপার কলোনি ও সিদ্ধিরগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে কালোটাকা ছড়ানো হচ্ছে। একজন প্রার্থী কালোটাকা ছড়িয়ে ৫০ হাজার ভোট কেনার মিশন নিয়ে নেমেছেন। তিনি বলেন, ‘সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, ঢাকা থেকে ছাত্রলীগের মেয়েদের আনা হচ্ছে প্রচারণা চালানোর জন্য। তাঁদের একেকজনকে এক হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন ১০০ মেয়েকে এক হাজার টাকা করে দেওয়া হলে খরচ হয় এক লাখ টাকা। এভাবে দিনের পর দিন চলছে। অথচ একজন মেয়র পদপ্রার্থীর নির্বাচনে সর্বোচ্চ ব্যয় ১৫ লাখ টাকা। তাহলে বাকি টাকা কোত্থেকে আসছে?’
এস এম আকরাম বলেন, কয়েক দিন আগে দেওভোগ লক্ষ্মীনারায়ণ আখড়া মন্দিরে দুই হাজার মানুষের ভোজের আয়োজন করা হয়। আচরণবিধি অনুযায়ী, কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের আয়োজন করার সুযোগ নেই।
নির্বাচনে কোন প্রার্থী কালোটাকা ছড়াচ্ছেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে নাগরিক পরিষদের সদস্যসচিব রফিউর রাব্বি বলেন, ‘শামীম ওসমান কালোটাকা ছড়িয়ে ভোট কিনতে চাইছেন। শুধু তা-ই নয়, একটি ওয়ার্ডে একটি ক্যাম্প করতে পারেন। কিন্তু ২৩ নম্বর ওয়ার্ডেই শামীম ওসমানের ছয়টি নির্বাচনী ক্যাম্প আছে।’
রফিউর রাব্বি বলেন, কয়েক দিন আগে বাবুরাইলের ঋষিপাড়ায় প্রতিমা ভাঙা হয়েছে। পুলিশ কেন তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করছে না। তাঁর মতে, প্রত্যেক নির্বাচনের আগে হিন্দুসম্প্রদায়কে জিম্মি করতে এ ধরনের অপকৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়।
মতবিনিময় সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, সহসভাপতি শেখ হায়দার আলী, সাংগঠনিক সম্পাদক মনির হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শহিদুল্লাহ, ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সম্পাদক হিমাংশু সাহা, জেলা ন্যাপ সভাপতি এ বি সিদ্দিক, শহর ন্যাপ সভাপতি আওলাদ হাসান, গণফোরাম নেতা মাহতাব আলী, জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক রোকনউদ্দিন আহমেদ, জাতীয় হকি দলের সাবেক খেলোয়াড় খাজা রহমতউল্লাহ, সাম্যবাদী দলের হানিফুল কবির প্রমুখ।
এসব নেতা বলেন, আইভী এই নির্বাচনে একা লড়ছেন না। ১৪ দলসহ স্বাধীনতার পক্ষের সবাই ‘সন্ত্রাসমুক্ত নারায়ণগঞ্জ’ গড়তে আইভীর পক্ষে মাঠে নেমেছেন। কোনো কোনো প্রার্থীর পক্ষে ঢাকা থেকে যত বড় নেতাই আসুন না কেন, এতে এখানকার ভোটাররা প্রভাবিত হবেন না। কারণ সবাই জানে, কে কেমন মানুষ।
তৈমুরের অভিযোগ: তৈমুর আলম খন্দকার কাল সকালে নির্বাচনী প্রচারকালে ও দুপুরে বিএনপির কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, নির্বাচন সামনে রেখে সমানে কালোটাকা ছড়ানো হচ্ছে।
বারবার কালোটাকার অভিযোগ কেন তুলছেন? জবাবে তৈমুর বলেন, ‘কালোটাকা ছড়ানোর বিষয়ে আমাদের উদ্বেগের কথা বলছি। কিন্তু কমিশন তথ্য-প্রমাণ চাইছে। কিন্তু এটি খুঁজে বের করা তাদের দায়িত্ব।’
অভিযোগ শামীম ওসমানেরও: জানতে চাইলে গতকাল সন্ধ্যায় শামীম ওসমান প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে কালোটাকা ছড়ানো হচ্ছে বলে তাঁর কাছেও অভিযোগ রয়েছে। তিনি এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার দাবি জানান।
সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে অন্য দুই প্রার্থীর আশঙ্কা সম্পর্কে শামীম ওসমান বলেন, তাঁদের এ আশঙ্কা অমূলক। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে সব নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। এই নির্বাচনও সুষ্ঠু হবে।
শামীম ওসমান বলেন, আইভী ও তৈমুর একই ভাষায় কথা বলছেন। দুজনেই সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলছেন। দুজনেই নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। এর মানে অন্য কোনো ষড়যন্ত্র আছে।
শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি সরাসরি বলতে চাই, বিএনপির প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার বিআরটিসি উজাড় করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। তিনি এখন নির্বাচনে কালোটাকা ছড়াচ্ছেন।’
আরেক প্রার্থী আইভীর বিরুদ্ধেও কালোটাকা ছড়ানোর অভিযোগ করেন খোকন। তাঁর দাবি, শামীম ওসমানই একমাত্র প্রার্থী, যিনি কালোটাকা ছড়াচ্ছেন না।
নির্বাচন কমিশনার যা বলেন: কাল দুপুরে সিদ্ধিরগঞ্জের তাঁতখানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইভিএমে ভোট গ্রহণের মহড়া দেখেন নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এ নির্বাচনে কালোটাকার ছড়াছড়ি রোধে নির্বাচন কমিশন কঠোর ব্যবস্থা নেবে। প্রয়োজনে চেকপোস্ট বসিয়ে প্রার্থীদের গাড়ি তল্লাশি করা হবে। কোনো প্রার্থীর গাড়িতে অতিরিক্ত টাকা পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইভিএম নিয়ে যত অভিযোগ: ইভিএম নিয়ে নির্বাচন কমিশনে কাল লিখিত অভিযোগ করেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। বলেন, ভোটারদের সচেতন করার উদ্দেশ্যে গতকাল মহড়া ভোট অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রার্থীদের প্রতীক হিসেবে শুধু ‘ঘড়ি’ ব্যবহার করা হয়েছে। মেয়র পদপ্রার্থীদের মধ্যে একজনের প্রতীক দেয়ালঘড়ি। এ জন্য বিষয়টি নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন বিশেষ একজন প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, এতে তার কিছুটা সত্যতা পাওয়া গেল। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
ইভিএমের বিষয়ে আইভী বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের প্রতি আমার আস্থা আছে। তবে আমার মনে হয়, যেসব কেন্দ্রে ভোটার বেশি, সেখানে ইভিএম ব্যবহার না করে যেখানে ভোটার কম, সেখানে ব্যবহার করা যেতে পারে।’
ইভিএম নিয়ে আপত্তি তুলেছেন তৈমুর আলম খন্দকারও। তিনি বলেন, ‘আমাদের জয় নিশ্চিত জেনেই ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে।’ তৈমুরও বলেন, ইভিএমের মহড়ায় প্রতীক হিসেবে শুধু ঘড়ি থাকাটা উদ্দেশ্যমূলক।
অবশ্য ইভিএমকে স্বাগত জানিয়েছেন শামীম ওসমান। তিনি বলেন, আধুনিক এই পদ্ধতিতে ভোট কারচুপির কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এটিকে ইস্যু বানানো হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.