বিরোধীদলীয় নেতাকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে

যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে 'বিচার কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করার' অপরাধে বিরোধীদলীয় নেতাকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়েছে। একই সঙ্গে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করার এবং সংসদ অবমাননার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি তোলা হয়। বুধবার জাতীয় সংসদে আড়াই ঘণ্টা এ বিষয়ে আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।


'নিজামী-মুজাহিদ-সাঈদী-সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীরা যুদ্ধাপরাধী নন, দেশ বাঁচাতে প্রয়োজনে আরেকটি যুদ্ধ করতে হবে'_ সম্প্রতি বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার জাতীয় সংসদে এ আলোচনা হয়। কার্যপ্রণালির ৬৮ বিধি অনুসারে জরুরি জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে আওয়ামী লীগের সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের উত্থাপিত নোটিশের
পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনার সূত্রপাত।
আলোচনায় অংশ নিয়ে মহাজোটের ১৪ সাংসদ ধিক্কার ও নিন্দা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত ছিলেন না। কার্যপ্রণালি বিধির ৬৮ বিধির ২ উপবিধি অনুসারে এ আলোচনার জন্য সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা সময় বরাদ্দ থাকলেও আড়াই ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। পরে ডেপুটি স্পিকার ৬৮ বিধির ২ উপবিধি স্থগিত করেন।
নোটিশ উত্থাপনকারী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিচার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করার অপরাধে বিরোধীদলীয় নেতাকে বিচারের মুখোমুখি করতে আদালতের প্রতি আহ্বান জানান। বিরোধীদলীয় নেতাকে 'ছায়া সরকারের প্রধানমন্ত্রী' উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং ছায়া সরকারের প্রধানমন্ত্রী কোনো অবস্থাতেই অপরাধী ও অপরাধের পক্ষে দাঁড়াতে পারেন না।
আলোচকরা বলেন, বিশ্বের যেখানে যখন যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে কোথাও জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে কাজটি হয়নি। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে ম্যান্ডেট নিয়েই আওয়ামী লীগ বিচার শুরু করেছে। সে বিবেচনায় যুদ্ধাপরাধের বিচারে এটি সর্বশ্রেষ্ঠ বিচার।
চলতি অধিবেশনের প্রথম দিন বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্য নিয়ে পয়েন্ট অব অর্ডারে বেশ ক'জন সাংসদ কথা বলেন। তখন স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট এ বিষয়ে নোটিশ দিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেন। সোমবার সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কার্যপ্রণালি বিধি অনুসারে আরও পাঁচ সাংসদের পক্ষে সম্মতি নিয়ে নোটিশ জমা দেন। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, আওয়ামী লীগের শেখ ফজলুল করিম সেলিম, অ্যাডভোকেট ফজলে রাবি্ব মিয়া, সাবেক ডেপুটি স্পিকার অধ্যাপক মোঃ আলী আশরাফ এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম এতে স্বাক্ষর করেন।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে জাতীয় সংসদে একটি বেসরকারি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব পাস হয়। সেদিন বিরোধী দলও সংসদে ছিল। তখন তারা ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। তারপরই সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম শুরু করে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নোটিশের প্রস্তাবে ব্যাখ্যামূলক টোক (নোট) দেন। এতে বলা হয়, সংসদে পাস হওয়া কোনো প্রস্তাব আইনের মতোই কার্যকর; কিন্তু বিরোধীদলীয় নেতা দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত থেকে যেভাবে সংসদে পাস হওয়া প্রস্তাবের তোয়াক্কা না করে স্বাধীনতাবিরোধী, খুনি রাজাকারদের রক্ষায় সারাদেশে মিথ্যাচার ও আইন বহির্ভূত কাজে লিপ্ত হয়েছেন, তা নির্ধারণের জন্য সংসদে আলোচনা করে ধিক্কার ও নিন্দা জানানো প্রয়োজন। নোটে আরও বলা হয়, সংসদে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত প্রস্তাবের প্রতি বিরোধিতা করা সংসদ অবমাননার শামিল। যেহেতু বিষয়টি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন সে কারণে এটি সাবজুডিস। তবে সাফাই সাক্ষী দিতে চাইলে আদালতে উপস্থিত হয়ে তথ্য হাজির করতে পারেন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় নোটিশটি উত্থাপন করেন। এ সময় যুদ্বাপরাধীদের বিচারের কাজে যাতে কোনো বাধা না থাকে সে জন্য নতুন প্রজন্মকে জেগে ওঠার আহ্বান জানান তিনি। সুরঞ্জিত বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে রাজনীতি এবং ক্ষমতায় যাওয়ার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। এর সঙ্গে কেবল আইন এবং বিচারের শাসন প্রতিষ্ঠা করার সম্পর্ক রয়েছে। রাজনীতির ক্ষেত্রে বিকল্প চিন্তা থাকতে পারে; কিন্তু অপরাধীকে বাঁচানো নিয়ে কোনো রাজনীতি হতে পারে না। তাছাড়া সংসদে পাস হওয়া সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের বিরুদ্ধে যদি কিছু বলার থাকে, তাহলে সংসদে আরেকটি প্রস্তাব আনতে পারেন।
বক্তৃতার এক পর্যায়ে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, এদেশে কি আইন নেই? কোনো কোর্ট-কাছারি নেই? তাদের কথায় অন্তত তাই মনে হয়। বিরোধীদলীয় নেতার 'যুদ্ধ ঘোষণা'র বিষয়ে সুরঞ্জিত বলেন, কার বিরুদ্ধে এবং কাদের নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে? ডানপন্থিরা যুগে যুগে এদেশে পরাজিত হয়েছে। এবারও এর বিকল্প হবে না।
বিভিন্ন দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রমের বর্ণনা করে সুরঞ্জিত বলেন, ভিয়েতনাম, বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে; কিন্তু কোথাও এ ধরনের বিচারের ক্ষেত্রে কোনো বেইলের বিধান নেই; কিন্তু বাংলাদেশে এটি রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিচারপতিরা ঢাকায় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এসে এ বিচার প্রক্রিয়াকে সর্বাধুনিক বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার দেশের কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের পাওনা। এটি না করা পর্যন্ত স্বাধীনতা পূর্ণাঙ্গ হবে না। শহীদদের কাছে দেশের মানুষের দায়মুক্তি হবে না। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার হলে বঙ্গবন্ধু এবং চার নেতাকে অকালে প্রাণ দিতে হতো না। এমনকি ওয়ান-ইলেভেনের সরকার ক্ষমতা দখল করতে পারত না।
আমির হোসেন আমু বলেন, খালেদা জিয়ার এ বক্তব্য রাজনৈতিক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। জিয়াউর রহমান যে কাজটি শুরু করেছিলেন এগুলো তারই ধারাবাহিকতা। দেশের রাষ্ট্রদ্রোহের সংজ্ঞা জানতে চেয়ে তিনি বলেন, দেশের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টাকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ হিসেবে আনা উচিত। দেশের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা কোনো অবস্থায় মেনে নেওয়া যায় না। আমু বলেন, গৃহযুদ্ধ ঘোষণার পরও যদি রাষ্ট্রদ্রোহ না হয় তাহলে এর সংজ্ঞা বদলানো দরকার। একই সঙ্গে সংসদ থেকে একটি কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত যাতে দেশ নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেলতে না পারে।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, বিশ্ববাসীও জানে নিজামী-মুজাহিদ-সাঈদী-সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীরা যুদ্ধাপরাধী; মানেন না কেবল বিরোধীরা। যুদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে আজ দেশকে তিনি গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে চান। '৭১ সালের পরাজয়ের গ্গ্নানি থেকে মুক্ত হওয়ার পথ খুঁজছেন তারা। একই সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্যের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব আনার প্রস্তাব করেন তিনি।
বিরোধীদলীয় নেতার হুমকি প্রসঙ্গে শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, আওয়ামী লীগকে হুমকি দিয়ে লাভ নেই। আওয়ামী লীগ যুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করেছে। '৭১ সালে যুদ্ধাপরাধীরা যে অপরাধ করেছে তা কখনও তামাদি হয় না। জিয়া দেশে জামায়াতকে ফিরিয়ে এনেছেন। এখন তিনি তাদের রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন।
মতিয়া চৌধুরী বলেন, বিরোধীদলীয় নেতা অবশেষে তার মুখের নেকাব সরিয়েছেন। তিনি যে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিদের 'মা' তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিরোধীদলীয় নেতার উদ্দেশে তিনি বলেন, যাদের নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, '৭১ সালেও তারা পরাজিত হয়েছে। এর জন্য নিশ্চয়ই তিনি ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন।
পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, জনরায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার অধিকার তাকে কে দিয়েছে? এর বিচার করবে জনগণ। সংসদের বিরুদ্ধে তিনি অবস্থান নিয়েছেন তাই সংসদকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন বলেন, বিরোধীদলীয় নেতা যে যুদ্ধের ঘোষণা দিচ্ছেন তা দেশের মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জনের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, রোডমার্চের মাধ্যমে তিনি যুদ্ধের মহড়া শেষ করছেন।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, এ বিচার প্রক্রিয়ায় কোনো অস্বচ্ছতা বা অস্পষ্টতা নেই। নানাভাবে একটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কী ধৃষ্টতা এবং জোর পেয়ে বিরোধীদলীয় নেতা এমন কথা বলতে শুরু করেছেন, সেটিও খুঁজে দেখতে হবে।
অধ্যাপক মোঃ আলী আশরাফ বলেন, ক্ষমতা থাকতে এবং ক্ষমতার বাইরে থেকেও একটি সম্ভাবনাময় দেশকে সবদিক দিয়ে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করছেন বিরোধীদলীয় নেতা। এবার তার অন্যতম হাতিয়ার যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করা।
অ্যাডভোকেট ফজলে রাবি্ব মিয়া বলেন, যে আইনে দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে তা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ডমেস্টিক ল'। তিনি বলেন, সংসদে পাস হওয়া একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কথা বলে বিরোধীদলীয় নেতা একদিকে সংসদের অবমাননা করেছেন, অন্যদিকে বিচারাধীন বিষয়ে প্রশ্ন তুলে আদালত অবমাননা করেছেন। দুটি অভিযোগেই তার বিচার হতে পারে।
আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, বিরোধীদলীয় সদস্যরা দেশের বিচারব্যবস্থা এবং উচ্চ আদালত নিয়ে এমনসব কথা বলছেন তাতে প্রতিদিন একটা করে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হতে পারে। সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখাতেই বিরোধীদলীয় নেতা হুমকি দিচ্ছেন।
জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, যে রাজাকার আমার ভাইকে হত্যা করেছে, বোনের ইজ্জত লুট করেছে, তার বিচারের বিরুদ্ধে যখন কেউ কথা বলে তখন মনে হয় '৭১ সালের যুদ্ধ শেষে শত্রু খতম না করে যে ভুল করেছিলাম তা শুধরে নিই। যুদ্ধাপরাধের বিচারের এ ইস্যুতে জাতীয় পার্টির অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, তারা জনগণের মতামতের সঙ্গে রয়েছেন। এর বিরুদ্ধে তারা নন।
এ বিষয়ে নিন্দা জানিয়ে অন্যদের মধ্যে বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগের আবদুল মান্নান, জাসদের মাঈনউদ্দিন খান বদল প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.