গুমের ঘটনা জাতিসংঘের অধীনে তদন্ত চান ফখরুল
গতকাল রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষে ‘গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে’ এক সংহতি সভায় তিনি এ দাবি জানান। এতে বিএনপিসহ অঙ্গ-সংগঠনের গুম হওয়া পরিবারের সদস্যরা তাদের কষ্টের আর্তি এই সংহতি সভায় মর্মস্পর্শী ভাষায় প্রকাশ করলে হাজার হাজার নেতাকর্মী অশ্রুসজলে সহমর্মিতা জানান দেয়।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, দীর্ঘকাল রাজনীতিতে আছি, অ্যারেস্ট হয় জানতাম, হত্যা হয় জানতাম- কিন্তু গুম করে দেয়া এটা আমাদের জানা ছিল না। এই আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহার করে তারা ভয়াবহ মানবতা বিরোধী যে অপরাধ, সেই অপরাধ সংঘটিত করেছে। আজকে অত্যন্ত ভালো কথা যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস তিনি গুম বিরোধী জাতিসংঘের যে সনদ আছে তাতে সই করেছেন। আমরা জানতাম আগের সরকার এটাতে (জাতিসংঘ সনদে) সই করে নাই। আজকে আরও ভালো লাগছে যে, এই প্রথম বাংলাদেশে এই স্বৈরাচারের অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করার জন্য জাতিসংঘ থেকে একটি দল এসেছে। গত দুই মাসে যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, সেটা তারা তদন্ত করবে।
তিনি বলেন, আমি সরকারের কাছে আহ্বান জানাতে চাই যে, আপনারা জাতিসংঘের যে মানবাধিকার কমিশন আছে তাদের সঙ্গে কথা বলেন। গত ১৫ বছর ধরে আজ পর্যন্ত যতগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, হত্যা হয়েছে, গুম হয়েছে- প্রত্যেকটির তদন্তের ব্যবস্থা করুন। এটা আপনারা (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) বললে জাতিসংঘ অবশ্যই করবে। এটা (জাতিসংঘের অধীনে তদন্ত) অত্যন্ত জোরের সঙ্গে, দৃঢ়তার সঙ্গে আমি মিডিয়ার ভাইদের বলতে চাই, ২০০৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যে অত্যাচার-নিপীড়ন-হত্যাকাণ্ড, গুমের ঘটনা হয়েছে, প্রত্যেকটির তদন্ত এই জাতিসংঘের কমিটি দিয়ে করতে হবে এবং তার ব্যবস্থা সরকারকে নিতে হবে।
গুমের ঘটনায় ব্যক্তিদের সন্ধানে সরকারের তদন্ত কমিশন গঠন প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, একটা কমিশন গঠন করেছেন।
এটা একটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু একইসঙ্গে আজকে আমি আহ্বান জানাতে চাই, এই সরকার যেন প্রত্যেকটি গুম হওয়া পরিবারকে ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। কারণ আমরা জানি এখানে অনেক পরিবার আছে, যারা অনেক কষ্ট করে তাদের পরিবার চালাচ্ছে, ছেলে-মেয়েদেরকে মানুষ করছে, স্কুল-কলেজে পড়াচ্ছে, এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব যে- এই পরিবারগুলোর পাশে এসে দাঁড়ানো। গণতন্ত্র এসেছে, আমরা গণতন্ত্র উপভোগ করবো- কিন্ত এই গুম হওয়া পরিবারের বাচ্চাগুলো তাদের যে ক্ষতি হয়েছে, পিতাকে হারিয়েছে- তা কোনোদিন ফেরত পাবে না। যে তার স্বামীকে হারিয়েছে, সে তা ফেরত পাবে না। তাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে, এই পরিবারগুলোর দায়িত্ব গ্রহণ করা। আজকে তাদের সেই অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। যারা গুমের ঘটনার জন্য দায়ী আমরা তাদের কমবেশি চিনি। যারা দায়িত্বে ছিলেন, র্যাবের দায়িত্বে ছিলেন, পুলিশের বিশেষ বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন- তাদেরকে খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা খুব কষ্ট পাই যখন দেখি রাজনৈতিক নেতাদেরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু ওই সমস্ত ভয়ঙ্কর ব্যক্তি, যারা আমাদের হত্যা করেছে, খুন করেছে, গুম করেছে তাদের একজনকেও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। আমরা আশা করি, খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাদের গ্রেপ্তার দেখতে পারবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দেখতে পারবো। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশ যেন একটা জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে তারজন্য আমরা কাজ করতে সক্ষম হবো।
দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে ফখরুল বলেন, সন্তুষ্টির কোনো কারণ নাই। এখনো অনেক ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এখনো দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্রের অভাব নেই। অপেক্ষা করে আছে কখন সুযোগ পাবে, সেই সুযোগে তারা স্বাধীনতাকামী মানুষের উপর অ্যাটাক করবে। তাই আজকে যে ঐক্য, ইস্পাতকঠিন ঐক্য তৈরি হয়েছে, সেটাকে আরও সুদৃঢ় করতে হবে। আমরা এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাফল্য চাই, আমরা চাই, তারা অতিদ্রুত এই গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন, সংস্কারের ব্যবস্থা করবেন।
স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এই গুম-হত্যার প্রকল্প, আমি এটা বলি একটা প্রকল্প। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার জন্য একটা সার্বিক প্রকল্প করেছিল, গুম তার একটি প্রকল্প ছিল। অর্থাৎ গুমের মাধ্যমে ভয়-ভীতি সঞ্চার করে সাধারণ মানুষ যাতে তার (শেখ হাসিনা) স্বৈরশাসনের বিরোধিতা করতে না পারে, সেজন্য এই প্রকল্পে সে নিয়েছিল। সুতরাং এই প্রকল্পের মূল উদ্যোক্তা মূল নায়ক শেখ হাসিনা। এই প্রকল্পের যারা নেতৃত্বে দিয়েছেন তাদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে হবে, এই প্রকল্পে যারা সহায়তা দিয়েছে সেই সত্য উদ্ঘাটন করতে হবে। এই প্রকল্পে যারা জেনে শুনে চোখ বন্ধ করেছিল, যে জেনে না জানার ভান করেছিল, যে দেখে না দেখার ভান করেছিল তাদেরকেও সামনে আনতে হবে। মোট কথায় এই প্রকল্পের সার্বিক সত্যতা জনসমক্ষে আনতে হবে।
৬১ দিন গুম থাকার পর ভারতের শিলংয়ে উদ্ধার হওয়ার পর ৯ বছর নির্বাসিত থাকা বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমি আজকে খোলাসা করে বলতে চাই, আয়নাঘরের প্রধান খলনায়ক ছিল বেনজীর (বেনজীর আহমেদ) ও জিয়াউল হাসান। একজন চাকুরিচ্যুত হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছে। একজন বলে গেছেন, জিয়াউল হাসানকে কোনো ইন্টারোগেশন করা হচ্ছে না। আমি একমত। তখন কর্নেল ছিল, এখন মনে হয় তাকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে রিটায়ার করে তারপর তাকে গ্রেপ্তার করে নাটক সাজিয়েছে, ডিবিতে নিয়ে গেছে ইন্টারোগেশনের জন্য। জিয়াউল হাসানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এখন এমনভাবে তাকে ইন্টারোগেশন করা হোক আগামী ২/৩ দিনের মধ্যে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশে যত গুম-খুন-অপহরণ হয়েছে- তা বলতে যেন সে বাধ্য হয়।
বিএনপি মহাসচিবের সভাপতিত্বে ও প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সঞ্চালনায় কর্মসূচিতে বিএনপি’র মানবাধিকার কমিটির সদস্য এডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল, গুম হওয়া ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদির লুনা, চৌধুরী আলমের মেয়ে খাদিজা আখতার, মায়ের ডাকের সমন্বয়ক সানজীদা ইসলাম তুলিসহ গুম হওয়া পরিবারের কয়েকজন সদস্য বক্তব্য রাখেন। কর্মসূচির শুরুতে গুম হওয়া সদস্যদের স্মরণ করে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।
No comments