বাংলাদেশ যেভাবে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত হতে পারে
এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের এই দ্বিতীয় মুক্তির সফলতা নিশ্চিত করতে এখন দরকার আমূল সংস্কার। তার জন্য গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষায় বসে থাকা উচিত নয়। পুরনো ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে ভবিষ্যতে, নবনির্বাচিত সরকার তাদের সুবিধার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের চেষ্টা করতে পারে। মূল প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন এখন যেকোনো ভবিষ্যতের সরকারের অধীনে গণতান্ত্রিক পথ গঠনে সাহায্য করবে। এক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য তিনটি ক্ষেত্র বেশ গুরুত্বপূর্ণ: তা হচ্ছে- পুলিশ ও সামরিক বাহিনী, সংবিধান এবং বিচার বিভাগ।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিভাগের বৈধতা আজ গুরুতর সংকটের সম্মুখীন। ছাত্র আন্দোলনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত ছিল। হাসিনার শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অত্যন্ত রাজনীতিকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। দেশের অধিকাংশ মানুষ এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর তাদের আস্থা হারিয়েছে। অনেক পুলিশ অফিসার প্রতিশোধের ভয়ে হাসিনার দেশ ছাড়ার পর আত্মগোপনে চলে যায়। যাতে দেশের নিরাপত্তা বলয়ে শূন্যতা তৈরি করে। আস্থা ও বৈধতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপটি হতে হবে সহিংসতার সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা। বিশেষ করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) সদস্যদের যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত ছিল তাদের অতীত রেকর্ডের ভিত্তিতে বিচার করা। এক্ষেত্রে সেখানে নারী, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে হবে। সেইসঙ্গে যাদের যোগ্যতা রয়েছে কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার তাদের পদোন্নতি দেয়নি তাদেরও সামনে আনতে হবে।
এতদিন বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী এবং নির্বাহী শাখার হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল। ফলত দেশে শুধুমাত্র নামমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ছিল। সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে একটি সম্পূর্ণরূপে নির্দলীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রেসিডেন্ট পদের পুনর্গঠন করা উচিত। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নিয়োগের প্রথা কার্যত বাতিল করতে হবে। বর্তমান আইন প্রেসিডেন্টকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে কাজ করতে বাধ্য করে, তা অবশ্যই বাতিল করা উচিত। প্রেসিডেন্টকে বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ মেনে মূল রাষ্ট্রীয় সংস্থার প্রধানদের নিয়োগের ক্ষমতা দেয়া উচিত। এটি করা হলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক চাপমুক্তভাবে কাজ করতে পারবে। সংবিধানে সরকারের ওপর আরও আইনি তদারকি প্রবর্তন করতে হবে। একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো-সংসদ সদস্যদের নিজ দলের পক্ষে ভোট দেয়ার ক্ষমতা বাতিল করা।
ড. ইউনূস এরই মধ্যে বিচার বিভাগীয় সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নিয়োগ এবং পদোন্নতি বাহ্যিক পছন্দের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। অন্তর্বর্তী সরকারকে বিতর্কিত দুই বছরের মেয়াদ বৃদ্ধির নিয়ম বাতিল করতে হবে যা অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের পুনরায় নিয়োগের অনুমতি দেয়। সিনিয়র বিচারকদের ক্ষমতাসীন সরকারের কাছ থেকে সুবিধা পাওয়ার পথ বন্ধ করতে হবে। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব থেকে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন এবং মানবাধিকার কমিশন-সহ সমস্ত প্রধান রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করা অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমে মানুষের হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করতে হবে।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ পর্যায়ের নিয়োগ অবশ্যই রাজনৈতিক দল, বিচার বিভাগ এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী একটি স্বাধীন কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে করা উচিত। এই নিয়োগের জন্য বিরোধীদের সমর্থন সহ সংসদীয় অনুমোদনেরও প্রয়োজন, যাতে কোনো একক দল প্রক্রিয়াটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে। পরিশেষে, ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের সাফল্য বাংলাদেশকে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। অর্থনীতির চাকা গতিশীল এবং সুশীল সমাজকে শক্তিশালী করার সুযোগ দিয়েছে। ড. ইউনূস এই মুহূর্তটা কাজে লাগাতে পারেন। যারা সূচনাকাল থেকে রাজনৈতিক সহিংসতার মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্ষতি করেছে তাদের হাত থেকে ক্ষমতার লাগাম ছাড়িয়ে নিতে হবে। কেননা সময় এসেছে জনগণের নেতৃত্বে এবং জনগণের জন্য একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার।
No comments