রিয়াজকে হাসপাতালে নিতেও বাধা দেয়া হয় by শরিফ রুবেল
রিয়াজ হোসেন। বয়স ২১ বছর ৪ মাস। বাড়ি কেরানীগঞ্জ ছোট ভাওয়াল এলাকায়। ভালো ফুটবলার হওয়ায় নিজ এলাকায় জনপ্রিয় ও পরিচিত মুখ ছিলেন। কেরানীগঞ্জ সরকারি ইস্পাহানী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন। গত ১৯শে জুলাই আন্দোলনে যোগ দিয়ে বছিলা ব্রিজের ঢালে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় রিয়াজ। এরপর থেকেই পুরো ভাওয়াল জুড়ে শোকের মাতম চলছে। রিয়াজের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে মহল্লায় ব্যানার- ফেস্টুন টাঙানো হয়েছে। আশপাশের অনেক সড়কের নাম বদলে শহীদ রিয়াজ সড়ক নামকরণ করা হয়েছে। ওইদিনের ঘটনা সম্পর্কে রিয়াজের পরিবারের অভিযোগ, সেদিন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরে আহত রিয়াজকে হাসপাতালে নিতেও বাধা দেয়া হয়।
বছিলা ব্রিজের পশ্চিম পাশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গুলিবিদ্ধ রিয়াজকে বহন করা সিএনজি আটকে দেন। সে সময় তার সহপাঠীদের মারধরও করা হয়। পরে মূল সড়ক এড়িয়ে অলিগলি ডিঙিয়ে একটি ক্লিনিকে নেয়া হয় রিয়াজকে। সেখানেও চিকিৎসা পাননি রিয়াজ। সূত্রমতে, ১৯শে জুলাই দুপুরের খাবার খেয়ে বের হয়ে বিকাল ৩টায় বছিলা ব্রিজ এলাকায় আন্দোলনে যোগ দেন রিয়াজ। সে সময় তার সঙ্গে ইস্পাহানী কলেজের ২০ থেকে ২৫ জন বন্ধুও ছিল। তবে জুমার নামাজের পর থেকেই রণক্ষেত্রে পরিণত হতে থাকে মোহাম্মদপুর এলাকা। এদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। বছিলা ব্রিজের ঢালে দফায় দফায় তাদের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ বাধে। এ সময় শিক্ষার্থীরা এলোপাতাড়ি ইটপাটকেল ছোড়েন। সংঘর্ষের সময় বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে গুলিবিদ্ধ হোন রিয়াজ হোসেন। মাথার পেছনে দিক দিয়ে গুলি ঢুকে চোখের মণিতে এসে বিঁধে গেলে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন রিয়াজ। কয়েক মিনিট রাস্তায় পড়ে থাকলে সহপাঠীরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা করেন। তবে বছিলা ৪০ ফিট এলাকায় এপিবিএন ও পুলিশের মুহুর্মুহু গুলির মুখে ঢাকায় যেতে পারেনি রিয়াজের স্বজনরা। পরে গুলিবিদ্ধ রিয়াজকে নিয়ে আটিবাজার আয়েশা ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে গভীর রাতে তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরদিন বিকালে পারিবারিক কবরস্থানে রিয়াজকে দাফন করা হয়। এরপর থেকেই রিয়াজের বাড়িতে শোকের মাতম চলছে। রিয়াজের পিতা-মাতা ছেলে হারানোর শোকে বিহ্বল। প্রতিদিনই তার কলেজের বন্ধুরা বাড়িতে এসে পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। খোঁজখবর নিচ্ছেন। মঙ্গলবার আন্দোলনে নিহত রিয়াজের বাড়িতে গেলে রিয়াজের মা শেফালী বেগম মানবজমিনকে বলেন, অনেক কষ্ট করে ছেলেটাকে পড়িয়েছি। আমাদের পরিবারের সব স্বপ্ন ছিল রিয়াজকে ঘিরেই। এত কষ্টের মধ্যেও ওরে আমরা কোনো অভাব বুঝতে দেইনি। রিয়াজ খেলাধুলায় খুব ভালো ছিল। আমার ছেলে অনেক মেডেল জিতেছে। আমি এখন ওই মেডেল ধরেই বসে থাকি। ঘটনার দিন আমাকে ভুলে ধরেছিলো। দুপুরে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে গেছিলাম। কিন্তু আমি কখনো দুপুরে ঘুমাই না। সেদিন ঘুমিয়ে গেছিলাম। জেগে থাকলে আমি ছেলেকে আন্দোলনে যেতে দিতাম না। ছেলেটা আমাকে না জানিয়ে আন্দোলনে চলে যায়। আন্দোলনে গিয়ে জীবন দিয়ে দিলো। আমি ওরে ছাড়া এখন কেমনে বাঁচবো? আমার পোলাডা অনেক কষ্ট পেয়ে মরেছে। ওরা আমার পোলাডারে মেরে ফেললো? মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কীভাবে? আমার সোনার টুকরো ছেলেটাকে মেরে ফেললো। শেফালি বেগম বলেন, আমার ছেলে একদিন আগে থেকেই মোবাইল ফোনে বলাবলি করতেছিল আন্দোলনে যাবে। আমি বলেছি, বাবা তোমার যদি কিছু হয়ে যায়, আমি কি নিয়ে বাঁচবো? তখন রিয়াজ আমাকে বলে, মা তোমার মতো আরও ১০ জন মা যদি এমন কথা বলে, তাইলে তো আমাদের দেশের কোনো সমাধান হবে না। আমাদের দেশ স্বাধীন করতে হবে। ওই যে গেল আমার পাখিটা আর ফিরে আসলো না। ১৯শে জুলাই সন্ধ্যায় আমি ছেলেকে খুঁজতে রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করছিলাম। আমি পাগল হয়ে গেছিলাম। আমার ছেলে যে মারা গেছে কেউ আমাকে বলেনি। সবাই সত্যটা গোপন করেছে। কিন্তু মায়ের মন সব বুঝে গেছিলো। আমরা এখন শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করবো। আপনারা দয়া করে আমার ছেলেকে কোনো দলের মধ্যে ভিড়াবেন না। আমার ছেলে একটা ছাত্র ছিল। এটাই তার পরিচয়।
আন্দোলনে রিয়াজের সঙ্গে থাকা তার বন্ধু ফাহিম আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, ১৯শে জুলাই শুক্রবার আমরা প্রথমে ঘাটারচর যাই। ওখান থেকে বছিলা ব্রিজের ওপারে যাই। গিয়ে দেখি ওখানে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলছে। সে আন্দোলনে আমরা যোগ দেই। হঠাৎ গুলি করা হয়। গুলি রিয়াজের মাথায় লাগে। গুলিতে ঘটনাস্থলেই রিয়াজ শহীদ হোন। সেদিন বছিলায় অধিকাংশই কেরানীগঞ্জের ছাত্র ছিল। আমরা কারও নেতৃত্বে যাইনি। আমাদের কোনো সমন্বয়ক ছিল না। ব্যক্তি উদ্যোগেই গিয়েছিলাম।
No comments