অগ্রাধিকারে রাখতে হবে রাষ্ট্র সংস্কার, অপরাধীদের বিচার এবং নির্বাচন: রাইট টু ফ্রিডমের ওয়েবিনারে দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞরা by গোলাম ইউসুফ

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশে গঠিত হয়েছে সে সরকারকে বিপ্লবী সরকার বলা যায়। সরকারকে জন আকাঙ্খার কথা মাথায় রেখে দেশে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পাশাপাশি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। বিপ্লবী এই সরকারের প্রতি দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। ভেঙে পড়া সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কারে অনতিবিলম্বে কাজ শুরু করতে হবে। গুম, খুন এবং দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের আনতে হবে সুষ্ঠু বিচারের আওতায়। সরকারের সংস্কার এজেন্ডা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐক্যমতের ভিত্তিতে একটি 'ন্যাশনাল চার্টার' স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অধিকার সংগঠন- রাইট টু ফ্রিডম (আরটুএফ) এর 'বাংলাদেশ: দ্য ওয়ে ফরওয়ার্ড' শীর্ষক ওয়েবিনারে আলোচকরা এসব কথা বলেন।

ওয়েবিনারে শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আরটুএফ'র প্রেসিডেন্ট অ্যাম্বাসেডর উইলিয়াম বি মাইলাম। সংস্থাটির বোর্ড মেম্বার ও ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ডেপুটি মিশন প্রধান জন এফ ড্যানিলোয়িচের সঞ্চালনায়  এতে বক্তব্য রাখেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)'র সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)'র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এবং উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান। ওয়েবিনারে আলোচকদের পরিচিতি তুলে ধরেন রাইট টু ফ্রিডমের নির্বাহী পরিচালক মুশফিকুল ফজল আনসারী।

বাংলাদেশের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এটি আরটুএফ'র প্রথম প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠান। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবার জন্য সাংবাদিক মুশফিককে আলোচনার শুরুর দিকে ধন্যবাদ জানান জন ড্যানিলোয়িচ।

মাইলাম তার স্বাগত বক্তব্যে বলেন, "আমি ছোট একটা ইতিহাস বলে আজকের এই সেশনের সূচনা করতে চাই। কারণ যদিও আমি প্রবীণ কিন্তু অনেক কিছু দেখেছি।" ৯০'র দশকে ঢাকায় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা এরশাদ পতনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আমি ঢাকায় অবস্থানকালে তখন এই দৃশ্য এর আগে দেখেছি। এটা হাসির কোনো বিষয় নয়। দুই বার নয় তিন বার, বিগত ৩৫ বছরে এই তিন বার বাংলাদেশকে নতুন করে যাত্রা শুরু করতে হয়েছে। আমরা এক অর্থে একই জায়গাতে ফিরে এসেছি আবার। আপনাদের সরকারকে এক জায়গায় রাখতে হয়েছে আবার জনগণকে আরেক জায়গায় ফিরে যেতে হয়েছে। বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশকে জানতে হলে বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে। দেশটিকে তিন বার নতুন করে যাত্রা শুরু করতে হয়েছে।"  তিনি নোবেলজয়ী ড. ইউনূস সরকারের সাফল্য কামনা করেন।

সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম তার বক্তব্যে বলেন, "বাংলাদেশে যে অভ্যুত্থান ঘটেছে সেটা ইতিহাসের সবচাইতে বড় অভ্যুত্থান। শুধু তরুণরাই নয়, গ্রাম-শহর-নগর সব জায়গা থেকে, ধনী, গরীব, মধ্যবিত্ত সবাই এতে অংশ নিয়েছে। এটা ছিলো সত্যিকারের একটা গণ-অভ্যুত্থান। এই গণ-অভ্যুত্থান আমাদের কী বার্তা দিলো? হাসিনা সরকার সন্ত্রাসীদের একটা সাম্রাজ্য বানিয়ে বসেছিলো। যারা এই সন্ত্রাসে জড়িত তাদের অবশ্যই সাজা দিতে হবে। এর যেন কখনো পুনরাবৃত্তি না হয়। ৫ আগস্টের আগে হাসিনা যে দুঃশাসন চালিয়েছে তা যেন আর না ফিরে আসে।"

তিনি বলেন, "তারা (শেখ হাসিনা সরকার) আট থেকে নয় শতাধিক মানুষকে হত্যা করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। ধারণা করা হচ্ছে সংখ্যাটা হাজারের বেশি হবে। শিশু-তরুণ-বৃদ্ধসহ সব শ্রেণির মানুষ এই গণ-অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছে। কারণ এতে সব শ্রেণির মানুষ অংশ নিয়েছিলো। এটা হলো এক ধরনের অপরাধ। দ্বিতীয় অপরাধ হলো, বিগত ১৫ বছর ধরে তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। সহিংসতা, গ্রেফতার, বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, আয়না ঘর তৈরি-  এসব অকল্পনীয় কাণ্ড ঘটিয়েছে। এগুলো গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। এগুলোর অবশ্যই বিচার হতে হবে।"

সুজন সম্পাদক আরও বলেন, "তাদের অন্য অপরাধটা ছিলো অর্থনৈতিক অপরাধ। লুটপাট, চুরি এবং টাকা পাচার করা-এসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। দেশ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা পাচার করা হয়েছে। এই পাচারকারীদের শাস্তি দিতে হবে। এদের শাস্তিটা হলো একটা গুরুত্বপূর্ণ দাবি। আরেকটা দাবি উঠেছে রাষ্ট্র সংস্কারের। নিরাপদ সড়কের আন্দোলন থেকে এ দাবি তুলেছিলো তরুণেরা। স্কুলের ছোট ছেলে-মেয়েরা এ দাবি তুলেছিলো। যারা এ দাবি তুলেছিলো তারা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে।"

অন্তর্বর্তী সরকারকে তিনটি কাজ করতে হবে উল্লেখ হাঙ্গার প্রজেক্ট পরিচালনা পরিষদের এই সদস্য  বলেন, "আমাদেরকে তিনটি কাজ করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়েছে সেগুলো পুনরায় সুসংগঠিত করতে হবে। হাসিনা পুলিশকে তার ব্যক্তিগত বাহিনী বানিয়ে বসেছিলো। দল এবং নিজের স্বার্থে সে পুলিশকে ব্যবহার করেছে। পুলিশ রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ভূমিকা পালন করেনি। এ প্রতিষ্ঠানটির অধঃপতন হয়েছে। আমলাতন্ত্রের অবস্থাও খুব বাজে। যারা অপরাধ করেছে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে এবং শাস্তি দিতে হবে। দ্বিতীয়, এসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন করে সাজাতে হবে।  এগুলোকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। এগুলো না করে এই অন্তর্বর্তী সরকার সঠিকভাবে কোনো কাজ করতে পারবে না। তৃতীয়ত, বিভিন্ন জায়গায় বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। এখন কথা হচ্ছে সংস্কারের পরিধি নিয়ে। এই অন্তর্বর্তী সরকার কতটুকু সংস্কার করার সুযোগ পাবে সেটা হচ্ছে কথা। কেউ কেউ বলছেন, বিপ্লব সংঘটিত হবার পর সংবিধান অকার্যকর হয়ে পড়েছে, এর আর কোনো কার্যকারিতা নেই, নতুন করে শুরু করতে হবে। অপর পক্ষ বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার এই সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়েছে। এটা পুরোপুরি সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় হয়নি, আমাদেরকে এই সংবিধান সংশোধন করতে হবে। বড় ধরনের কিছু সংস্কার প্রয়োজন যাতে করে সেই পুরনো সরকার আবার ফিরে আসতে না পারে।"

ড. বদিউল আলম বলেন, "আমরা যদি সবকিছু পরিবর্তন করতে চাই, নতুন করে শুরু করতে চাই, যেমন প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেছেন, সংবিধান নতুন করে লিখতে হবে। এরকম হলে বিষয়টা হবে দীর্ঘ মেয়াদি, জটিল এবং সহজ হবে না। এক্ষেত্রে আমাদের সংবিধানের খসড়া প্রস্তুতকারী কমিটি লাগবে। এরপর নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচনের পর সাংবিধানিক অধিবেশন বসাতে হবে, সেখানে খসড়া উত্থাপন হবে এবং তা নিয়ে আলোচনা হবে। আলোচনার পর নতুন সংবিধান পাস হবে। অনেক আইন রয়েছে সেগুলো বদলাতে হবে, প্রতিষ্ঠান সংস্কার করতে হবে এবং সেগুলো থেকে অনেককে সরিয়ে দিতে হবে। নির্বাচন কমিশন পুর্নগঠন করতে হবে, বিচার বিভাগের সংস্কার করতে হবে। অনেক বিচারক পদত্যাগ করেছেন, তবে যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে যাদের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে তাদের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে।"

তিনি আরও বলেন, "আমরা যদি ব্যাপক পরিবর্তন আনতে চাই তাহলে প্রথমে এই সরকারকে ঘোষণা দিতে হবে যে তারা বিপ্লব পরবর্তী সরকার। অতীতে যেসব  ঘটনা ঘটেছে তা যুক্তিযুক্ত নয়, এটা তাদের বলতে হবে এবং নতুন করে শুরু করতে হবে। অরেকটা কাজ তারা করতে পারে তা হলো বর্তমান সংবিধান সংশোধন করা, তারা গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তন আনতে পারে, যেমন প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য নিয়ে আসা এবং প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্ধারণ করা। আমাদের এ বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে। এর জন্য হয়তো সংবিধানে কিছু বিষয় সংশোধন করতে হবে এবং কিছু বিষয় নতুন করে যোগ করতে হবে।"

সুজন সম্পাদক বলেন, "সরকারকে তাদের ভিশন জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। তাদেরকে বলতে হবে তারা কী সংবিধান সংশোধন করবে নাকি নতুন করে সংবিধান প্রণয়ন করবে। এই সরকার প্রয়োজনে রেফারেন্ডাম করতে পারে অথবা তাদের নিজস্ব সংস্কার এজেন্ডা নিয়ে অগ্রসর হতে পারে। সরকার তাদের সংস্কার এজেন্ডার কথা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐক্যমতের ভিত্তিতে 'ন্যাশনাল চার্টার' স্বাক্ষর করতে পারে। এরপর পুর্নগঠিত নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে নির্বাচন হবে। যে দল ক্ষমতায় আসবে তারা সেই চার্টার বাস্তবায়নে বাধ্য ধাকবে।"

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, "আমরা সবাই দেখেছি জুলাই এবং আগস্টে ছাত্রদের নেতৃত্বে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কীভাবে ৫ আগস্ট সরকারের পতন হয়েছে। এই পালাবদলে ছাত্র এবং জনতার  বৈষম্যহীন সমাজের আকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রায় সব বিষয় নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে। বিগত ১৫ বছরে প্রাতিষ্ঠানিকতা ভেঙে পড়ায় এই কাজটি খুব চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে।"

তিনি বলেন, “অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে- মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ কমে যাওয়া, জনগণের প্রজেক্ট বাস্তবায়নে দুর্নীতি, ট্যাক্স জিডিপির নিম্ন হার, ব্যক্তিগত এবং বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়া, দুর্বল অর্থনৈতিক খাত, ব্যাংকে খেলাপি ঋণ, অবৈধ টাকার সরবরাহ, বেকারত্ব, দারিদ্র এবং বৈষম্য। খুব অল্প সময়ে এই চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করা কঠিন।”

ফাহমিদা হক বলেন, "অর্থনীতি বিগত দশকে যৌক্তিক প্রবৃদ্ধির দেখা পেয়েছে। যদিও আমরা আগের সরকারের দেখানো প্রবৃদ্ধির হারকে কম করে দেখিয়েছি কারণ আমরা ডাটার স্বচ্ছতা এবং সততার উপর গুরুত্বারোপ করেছি। আগের সরকারের সময়ে ৩০ টি ডাটাতে ঘাটতি ছিলো। কারণ এগুলোতে সংখ্যার পরিমাণ বেশি করে দেখানো হয়েছিলো যেগুলোর বাস্তবতার সঙ্গে কোনো মিল নেই। প্রবৃদ্ধির হার ৫ থেকে ৬ শতাংশ দেখানো হলেও তার সুবিধা কিন্তু এদেশের নাগরিকেরা সমানভাবে পায়নি। আমি এর আগে এটা বলেছি যে, বাংলাদেশের যে প্রবৃদ্ধির হার দেখানো হয়েছে তাতে ন্যায় বিচার এবং মানবতাবোধের ঘাটতি রয়েছে।"

ছাত্র আন্দোলনটা ছিলো দেশের বড় সংকটগুলোর প্রতিবাদের একটা অংশ, দেশের নীতিনির্ধারকরা দশকের পর দশক ধরে সেগুলো এড়িয়ে যাচ্ছিলেন উল্লেখ করে সিপিডির এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, "কোটা সংস্কারের দাবিটা ছিলো বরফের বড় অংশ থেকে বরফ টুকরোর ভাঙনের সূচনা মাত্র যেটি বিগত সরকার অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছিল। আসলে কোটা আন্দোলনের পিছেন সক্রিয় ছিলো চাপিয়ে রাখা ক্ষোভ এবং দীর্ঘ সময় ধরে জমে থাকা বঞ্চিত জনগণের অধিকারের দাবি। যার কারণে ভোটের অধিকার সংস্কারের দাবিটা বৈষম্যহীন আন্দোলনে পরিণত হয়। সব শ্রেণির মানুষ এই আন্দোলনে অংশ নেয়।"

তিনি বলেন, "আমরা দেখেছি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেভাবে হয়েছে একইভাবে বৈষম্যও বেড়েছে। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের তথ্য বলছে, ৫ শতাংশ শীর্ষ ধনীদের বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের ৩০ শতাংশের অর্থ রয়েছে। অথচ তাদের মালিকানায় রয়েছে জাতীয় আয়ের ০.৭ শতাংশ পরিমাণ অর্থ। ২০১৬ সালের তুলনায় তাদের অর্থের পরিমাণ বেড়েছে।"

ফাহমিদা হক আরও বলেন, "অন্তর্বর্তী সরকারকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরায় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ এগুলো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং প্রবৃদ্ধির পূর্ব শর্ত।"

উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, "সামনের দিনগুলোতে পররাষ্ট্রনীতির বিষয়টি এই অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, সংস্কারসহ অন্যান্য বিষয়গুলো এ সরকারের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। আমি এটা বলছিনা যে পররাষ্ট্রনীতি এ সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমি ভারতের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক নিয়ে কথা বলবো। ক্ষমতাচ্যুত হবার পর শেখ হাসিনা চার সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ভারতে রয়েছেন। মিয়ানমার পরিস্থিতিও গুরুত্বপূর্ণ, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সেখানে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে দেখেছি। দেশটির যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশের উপর পড়ছে। এগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়ে কীভাবে সাড়া দিবে এটা গুরুত্বপূর্ণ।"

তিনি বলেন, "আমার প্রথম কথা হচ্ছে, এই সরকারের সুবিধা এবং অসুবিধা দুটোই রয়েছে। পররাষ্ট্রনীতিটা এই সরকারের অনুকূলে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইউনূস ফ্যাক্টর গুরুত্বপূর্ণ। তিনি একজন তারকা খ্যাতির মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রের হাউস তাকে খুব সম্মান করে। বিশ্বের মনযোগ এবং শ্রদ্ধা পেতে তাকে খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না। অন্যদিকে, বাংলাদেশ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি, কারো সঙ্গে পক্ষপাত না থাকায় বড় শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশটির গুরুত্ব রয়েছে। এথেকে বুঝা যায় বিশ্বের অধিকাংশ দেশই এই অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চাইবে।"

নতুন সরকারের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে কুগেলম্যান বলেন, "অন্তর্বর্তী সরকারের চ্যালেঞ্জ হলো- দেশ পরিচালনায় তাদের কম অভিজ্ঞতা রয়েছে, এই সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্ব যাকে দেওয়া হয়েছে তিনি অবসরপ্রাপ্ত একজন কূটনীতিক, তিনি সম্মানিত কিন্তু সাবেক একজন কূটনীতিক এবং বাংলাদেশে এখন এক ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা রয়েছে যা বিশ্ব নেতাদের এবং বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন করবে, দেশটির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি হয়তো আরও স্থিতিশীল হবে কিন্তু এখন তা নাজুক রয়েছে। এই বিষয়গুলো বিশ্বের বিনিয়োগকারী এবং অন্যদের ওপর প্রভাব ফেলবে।"

তিনি বলেন, "সামনের সপ্তাহ এবং মাসগুলোতে বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা কেমন হবে তা নিয়ে ভাবাটা দেশটির পররাষ্ট্রনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে। বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে।  দেশটির বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত পরিসরের অংশীদার রয়েছে। যেমন অবকাঠামোতে উন্নয়নে কাজ করা চীন এবং জাপান, বাণিজ্যিক অংশীদার ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র এবং জ্বালানি সরবরাহকারী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত রাখতে হবে। এই অংশীদারদের এখন কিছু উদ্বেগ রয়েছে। বাংলাদেশকে এটা দেখাতে হবে যে তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরায় স্বাভাবিক করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে। যদিও অনেক পদক্ষেপে অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে তবুও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।"

কুগেলম্যান বলেন, "ঢাকার সঙ্গে যখন পশ্চিমাদের সংলাপের প্রসঙ্গ আসে তখন মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের প্রতি বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতির বিষয়টি গুরুত্ব পায়। পশ্চিমে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক মিত্র রয়েছে। তারা চাইবে না মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র নিয়ে তাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো হাসিনার শাসনামলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যেরকম ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি করেছিল সেরকম প্রেক্ষাপট তৈরি হোক। ড. ইউনূসের গণতন্ত্রের প্রতি জোর সমর্থনের যে পরিচিতি পশ্চিমা বিশ্বে রয়েছে এ ক্ষেত্রে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশের সরকারকে সোচ্চার হতে হবে।"

তিনি বলেন, "কয়েক সপ্তাহ পরই জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন। এটা ড. ইউনূসের জন্য বড় সুযোগ। আমার ধারণা তিনি বিশ্বের বৃহৎ প্লাটফর্মে যোগ দিতে নিউইয়র্কে আসবেন। সেখানে তিনি তার সরকারের লক্ষ্য, ভিশন, সংস্কার নিয়ে পরিকল্পনা এবং গণতন্ত্রসহ অন্যান্য বিষয়ে কথা বলতে পারেন। আমি মনে করি তিনি সেখানে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়েও কথা বলবেন। কোন কোন জায়গায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল করতে ভূমিকা রাখতে পারে তা নিয়ে কথা বলবেন। তিনি সেখানে বাংলাদেশের সবচাইতে বড় মানবিক চ্যালেঞ্জ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে কথা বলার সুযোগ পাবেন। তিনি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আহ্বান জানাতে পারবেন। বিষয়টা দুটো কারণে গুরুত্বপূর্ণ, প্রথমত, মিয়ানমারের যুদ্ধ ক্রমাগত বাড়ছে এবং সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে দেখা গেছে বাংলাদেশে নতুন করে আশ্রয় নিয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। দ্বিতীয়ত, এখানে দাতাদের মনযোগ আকর্ষণ করা যাবে কারণ গাজা, ইউক্রেনে যুদ্ধ এবং অন্যান্য কারণে তাদের দৃষ্টি অন্য দিকে সরে গিয়েছিলো। কত কয়েক বছর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয়টি দাতাদের কাছে যেভাবে গুরুত্ব পেয়েছিলো সেটি গুরুত্ব হারিয়েছে। এই চ্যালেঞ্জের বিষয়ে কথা বলার একটা ভালো সুযোগ পাবেন ড. ইউনূস।"

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে কুগেলম্যান বলেন, "বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কথা বলা দরকার। এটা বাংলাদেশের এখন সবচাইতে জটিল সম্পর্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটাই একমাত্র ঘনিষ্ঠ দেশ এবং বন্ধু যেটি না পারছে নতুন সরকারকে আলিঙ্গন করতে, না পারছে স্বাগতম জানাতে। যদিও ড. ইউনূস এবং মোদির মধ্যে সংক্ষিপ্ত কথা হয়েছে তবুও সেটা বিশদ বলা যায় না। বাংলাদেশ ভারতের সরকারকে একটা বিষয়ে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারে যে, তারা নতুন করে যাত্রা শুরু করতে চায়। ভারত তাদের পররাষ্ট্রনীতি, অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং শাসন ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। আমি মনে করি বাংলাদেশের উচিত নয় ভারতের সঙ্গে দরকষাকষিতে ব্যর্থ হওয়া। তাদের এই অংশীদারিত্বের প্রয়োজন রয়েছে। বাণিজ্য, সীমান্ত এবং ভূ-রাজনৈতিক কারণে এই সম্পর্ক প্রয়োজন। ভারতের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ট সম্পর্কের চাইতে বাংলাদেশের কার্যকর একটা সম্পর্ক দরকার।"

স্বল্প এবং দীর্ঘ মেয়াদে অন্তবর্তী সরকার দেশের সংকটের সমাধান করতে পারবে কীনা- এমন প্রশ্নের জবাবে  বদিউল আলম বলেন, "আমার মতামত অন্তর্বর্তী সরকারের মতামতের চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। তাদেরকে ভিশন এবং কর্ম পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। যদি তারা দীর্ঘ মেয়াদে কিছু করতে চায় তাহলে বলতে হয়, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে খুব দ্রুত সেটা ঘোষণা করতে হবে। আমার মনে হয় না তারা বিষয়টা লম্বা করবেন, আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে তারা সংবিধান সংশোধনে মনযোগ দিবেন। এ ক্ষেত্রে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ এবং আমরা ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ের জন্য অপেক্ষা করছি। তারা যদি ঘোষণা করতো এটা বিপ্লবের সরকার, সংবিধান কার্যকর নয়, নতুন করে সবকিছু করতে হবে তাহলেই ভালো হতো। কিন্তু এ সরকার তা করেনি।"

শেখ হাসিনা ভারত ছেড়ে কোথাও যাচ্ছেন না। তার এই অবস্থান দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্কে কী প্রভাব ফেলবে-এমন প্রশ্নের জবাবে কুগেলম্যান বলেন, "আমার মনে হয় হাসিনা শাসনামল পরবর্তী এই সময়ে হাসিনা যত দীর্ঘ সময় ভারতে থাকবেন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক স্বাভাবিকের বিষয়টি ততই কঠিন হয়ে পড়বে। ভারত হাসিনাকে কত সময় আশ্রয় দিবে সেটা বলা মুশকিল তবে ভারতের বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত তাদের বন্ধুকে ফিরিয়ে দেবে না এবং যত সময় প্রয়োজন তত সময় আশ্রয় দিবে। আমি মনে করি ভারত সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক কার্যকর রাখার বিষয়টিতে বাস্তববাদী হবে যদিও বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ভারতে উদ্বেগ রয়েছে। আর এ কারণেই ভারত সরকার চাইবে হাসিনাকে আশ্রয় দিবে এমন কোনো দেশ খুঁজে নিতে। এতে কত সময় লাগবে তা জানিনা। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্দি বিনিময় চুক্তি রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনাকে ফেরত চাইবে কীনা তা জানিনা। তাকে দেশে পাঠালে অবশ্যই গ্রেফতার করা হবে। এটা ভারতের জন্য খুব কঠিন একটা বিষয়।"

তিনি বলেন, "আমার ধারণা ভারত সরকার চাইবেনা হাসিনা দীর্ঘ সময় তাদের দেশে অবস্থান করুক। কারণ তারা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এবং পরবর্তী যে সরকার আসবে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে চায়। কিন্তু একইসঙ্গে আমি মনে করি ভারত এমন কিছু করবেনা যাতে হাসিনা অস্বস্তি অনুভব করেন এবং এমনটা ভাবেন যে তাকে যেকোনো সময় দেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে।"

No comments

Powered by Blogger.