‘নাতিগারে কেউ কদ্দুরা দুধ দেয়ন আন্নে লইদে না বায়াজি’ by নাজমুল হক শামীম

‘বায়াজি নাতিকে কিছু খাইতে ফারে না, কদ্দুরা দুধের লাই কতোজনের কইলাম কেউ দিলো না। পাগল কই বেকে তারাই দিলো, আন্নে আরে কদ্দুরা দুধ লই দেন না, দোয়া করমু বায়াজি।’ নিজের নাতির জন্য দুধ চেয়ে না পেয়ে এভাবেই আক্ষেপ করে জানাচ্ছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব জাহানারা বেগম। ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের বারোয়ানী গ্রামের স্বামী পরিত্যক্তা জাহানারা বেগম। পানি ঢোকার পর থেকে গত ১০ দিন ধরে তিনি তার মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়ে জামিলা ও চার বছরের এক নাতনিকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন এলাহীগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে। বলেন, মেয়ে ও নাতনিকে নিয়ে অভাবের সংসার। ছোট যে ঘরটিতে তারা থাকতেন তা পানির নিচে। ঘর থেকে কিছুই বের করতে পারেননি। যেখানে আশ্রয় নিয়েছেন সেই স্কুল আঙিনায় বুক সমান পানি। আশপাশের মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যে খাবার দিয়ে যাচ্ছেন তা দিয়ে তাদের কোনোরকম জীবন কাটছে। তিনি বলেন, ত্রাণের গাড়ি দেখলেই ছুটে যাই। নাতিনের দুধের প্রয়োজন। কেউ দুধ দিচ্ছে কিনা খোঁজ নিতে। আজ একটি চিকিৎসক প্রতিষ্ঠান ওষুধের সঙ্গে শিশুদের দুধ দিচ্ছিলো। আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি, সবাই পাগল বলে তাড়িয়ে দিয়েছে। আপনি সাংবাদিক আমাকে একটু দুধ নিয়ে দেন।

জাহানারা গ্রামের মতো আশপাশের আরও তিনটি ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রাম বিগত ১০ দিনের বেশি সময় ধরে পানিবন্দি। মানবেতর জীবনযাপন করছেন এসকল গ্রামের বাসিন্দারা। ফেনী সদর উপজেলার শর্শদা ইউনিয়নের দক্ষিণ আবুপুর, উত্তর আবুপুর, কুমিরা, নতুনবাড়ী, পিয়ার আলী মসজিদ, সদর  উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের জগরগাঁও, এলাহীগঞ্জ, ধলিয়া  বারোয়ানী, উত্তর ডোমুরিয়া, দক্ষিণ ডোমুরিয়া, দাগনভূঞা উপজেলার সিন্দুরপুর ইউনিয়নের কৈখালী, ছোট কৈখালী, গৌতম খালিতে কোথাও হাঁটু সমান পানি তো কোথাও কোমর সমান পানি। এলাহীগঞ্জ বাজারে কথা হয় আব্দুল মতিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, তিনটি ইউনিয়নের সংযোগস্থল এই এলাহীগঞ্জ বাজার। আশপাশের সকল গ্রাম পানিতে ডুবে থাকায় এলাহীগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও এলাহীগঞ্জ মমতাজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় ১৫০ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। বানভাসি এ মানুষগুলোর চোখে মুখে শুধু হতাশার ছাপ।
ছোট ধলিয়া গ্রামের খামারপাড়ার বৃদ্ধ হারিস মিয়া জানান, ১০ দিন ধরে পানিবন্দি থাকায় পাশের একটি মার্কেটের ছাদে আশ্রয় নিয়েছেন। পাঁচ ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতিনদের নিয়ে ছাদে ত্রিপল দিয়ে রাত যাপন করছেন। ছেলে হুমায়ুন, পেয়ার আহমেদ, সালেহ আহমেদের বেশ কয়েকটি মাছের খামার ও পোল্ট্রি ফার্ম পানিতে ভেসে গেছে। ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তার পরিবারটি একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র আব্দুল কাদের জিলানী ও তার ছোট ভাই মাদ্রাসা পড়ুয়া তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র আব্দুর রহমান সৈকত বলেন, ঘরে এখনো হাঁটু সমান পানি। পড়ার সকল বই ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। কিছুদূর এগুতেই বাজারের একটি দোকানে দেখা গেল জেনারেটর দিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় মোবাইলে চার্জ দিচ্ছেন স্থানীয়রা। কথা হয় আব্দুল্লাহ আলিফ নামে এক যুবকের সঙ্গে। তিনি বলেন ১০ দিনের উপরে এলাকায় কারেন্ট নেই। কারও মোবাইলেই চার্জ নেই। বাজারে যে দোকানটিতে জেনারেটর দিয়ে মোবাইল চার্জ দেয়া হচ্ছে দোকান মালিক প্রতি মোবাইল চার্জ দিতে ৪০ টাকা করে রাখছেন।

এলাহীগঞ্জ বাজারের একটি দোকানে বানভাসি মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন ঢাকা থেকে আগত ‘বাংলাদেশ সচেতন নাগরিক সমাজ ফোরাম’ নামে একটি সংগঠন। ওই সংগঠনের চিকিৎসক সাব্বির আহমেদ জানান, তাদের দলে ৮ জন চিকিৎসক রয়েছেন। চিকিৎসা পত্রের পাশাপাশি পানিবাহিত রোগ ও প্রাথমিক চিকিৎসার সকল ওষুধ বিনামূল্যে রোগীদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে। দিনব্যাপী তারা ৪ শতাধিক রোগীকে সেবা দিতে পেরেছেন।

নদী থেকে গলিত লাশ উদ্ধার: গতকাল বিকালে ফেনী সদর উপজেলার লেমুয়া এলাকায় নদী থেকে এক ব্যক্তির অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ফেনী জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মোরশেদ আলম মিলন বলেন, ফেনী নদীর লেমুয়া ব্রিজের নিচে এক নারীর মরদেহ ভাসতে দেখে স্থানীয় এক নেতা তাকে কল করে বিষয়টি জানায়। পরে তিনি ‘আল মারকাজুল ইসলাম’ নামে লাশ দাফনের সংগঠনকে অবগত করলে তারা তাদের পিকাআপ নিয়ে মরদেহটি উদ্ধার করে। পরে ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহটি ফেনী জেনারেল হাসপাতালে প্রেরণ করে। মিলন আরও বলেন, বৃদ্ধ মহিলার বয়স সত্তরোর্ধ্ব। মাথার চুলগুলো সাদা। পরনে লাল রঙের ম্যক্সি ছিল।

বাড়ছে মৃতের সংখ্যা: ফেনীতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে নতুন নতুন মৃতদের সংখ্যা। শুক্রবার বিকালে জেলা প্রশাসন থেকে প্রেরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, জেলায় বন্যায় এ পর্যন্ত ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। জেলা প্রশাসক মোসাম্মৎ শাহীনা আক্তার জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিএসবি) বরাতে বলেন, শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত বন্যায় ফেনী সদর উপজেলায় ৩ জন, পরশুরাম উপজেলায় ২ জন, ফুলগাজী উপজেলায় ৭ জন, ছাগলনাইয়ায় ৩ জন, দাগনভূঞা উপজেলায় ২ জন ও সোনাগাজী উপজেলায় ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.