শোয়েবকে এখনো তাড়া করছেন টেইট by আরিফুল ইসলাম

আই অ্যাম নট ইয়েট ডান...মেট!’ খানিকটা চমকে তাকাতে হলো। হাসি-ঠাট্টাতে এগিয়ে চলছিল আড্ডা। এ কথাটা বলার সময়ও ঠোঁটের কোণে হাসি। কিন্তু চাহনি আর মুখভঙ্গিই বলে দিচ্ছিল, কথাটা মোটেও ঠাট্টা নয়।
শন টেইট সত্যিই বিশ্বাস করেন, শোয়েব আখতারের গতির রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার সামর্থ্য তাঁর এখনো আছে!
ইচ্ছাটা সব সময়ই ছিল। সব সময়ই চেয়েছেন, ক্রিকেট ইতিহাসের দ্রুততম বোলার হিসেবেই লোকে তাঁকে মনে রাখুক। কিন্তু ক্যারিয়ারজুড়ে নিজের সঙ্গেই এত লড়াই করতে হয়েছে, শোয়েবের সঙ্গে লড়াইয়ের সুযোগ সেভাবে পেলেন কোথায়! লড়াইটা যখন গতির, সবচেয়ে ভরসা নিজের শরীর। কিন্তু টেইটের শরীর যে বিদ্রোহ করত হরহামেশাই! ‘পুরোপুরি ফিট’ শব্দটা ক্যারিয়ারে কতবার শুনেছেন, বলতে পারবেন হয়তো আঙুল গুনে। তবে এর ফাঁকেই জানিয়ে দিয়েছেন নিজের সামর্থ্য। অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের দ্রুততম বলটি তাঁর হাত থেকেই বেরিয়েছে। ২০১০ সালে লর্ডসের ওয়ানডেতে ১৬১ কিলোমিটারের (১০০.১ মাইল) গোলা ছুড়ে পেছনে ফেলেছিলেন ব্রেট লিকে (১৬০.৮ কিমি)। কিন্তু শোয়েবের (১৬১.৩ কিমি) রেকর্ডটি আর ছুঁতে পারেননি।
এই প্রসঙ্গেই শুরুর সেই উত্তর। বিপিএলে চিটাগং কিংসের হয়ে খেলতে আসা ফাস্ট বোলারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল চট্টগ্রামের টিম হোটেলে। কিছুটা আক্ষেপ তাঁর আছে, তবে সেটাকে ঢাকা দেওয়ার জন্য আছে স্বপ্নও, ‘এ বছর হয়তো নয়...ফিটনেস নিয়ে কাজ করে চলেছি। কে জানে, হয়তো আগামী বছর ছাড়িয়েও যেতে পারি শোয়েবকে। শোয়েব দারুণ এক ফাস্ট বোলার ছিল, ব্রেট লিও। তবে গতি আমারও কম ছিল না। এখনো আমি শোয়েবের গতির রেকর্ডের দিকে তাকাই। মনে মনে বলি, ওই রেকর্ড একদিন ভেঙে দেব। ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা তো আছেই, তবে শরীরের ধকল সামলে এখনো যে খেলে যাচ্ছি, সেটার একটা বড় কারণ এই তাড়না।’
গতির নেশা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা! ২০০৮ সালে এই টেইটই না অবসাদের কথা বলে অনির্দিষ্টকালের বিরতি নিয়েছিলেন ক্রিকেট থেকে। দুঃসহ সময়টার কথা মনে করে টেইটের মুখ থেকেও যেন হাসি হারিয়ে যায় ক্ষণিকের জন্য, ‘মানসিক ও শারীরিকভাবে স্রেফ বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলাম। ক্রিকেট উপভোগ করছিলাম না, মাঠে যেতে ভালো লাগছিল না। মনে হয়েছিল “এনাফ ইজ এনাফ।” পরে অবশ্য মনে হয়েছে, ব্যাপারটা ওভাবে প্রকাশ্য না করলেও পারতাম। সব আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারই ক্যারিয়ারের কোনো না কোনো পর্যায়ে অবসাদে ভুগেছে। কিন্তু সমালোচনা, ভুল বোঝার ভয়ে খোলাখুলি বলতে পারে না। সংবাদমাধ্যম খোঁচাখুঁচি করে...আমাকেই যেমন অস্ট্রেলিয়ায় তুলোধোনা করা হয়েছে, বলা হয়েছে মোমের মতো নরম...।’
‘বিষণ্নতা’ ব্যাপারটার সঙ্গে ক্রিকেট পরিচিত হয়েছে মূলত মার্কাস ট্রেসকোথিকের মাধ্যমে। লু ভিনসেন্ট, মাইকেল ইয়ার্ডি, টেইটদের মাধ্যমে বোঝা গেছে এটার ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা। টেইট অবশ্য নিজেকে অতটা গুরুতর ‘রোগী’ ভাবতে নারাজ, বরং বিষণ্নতা বা অবসাদের প্রতি খানিকটা ঋণ স্বীকারও করে নিলেন, ‘আমার পরিস্থিতিটা লু বা মার্কাসের মতো ছিল না। আমাকে কিন্তু চিকিৎসা করাতে হয়নি। আমার শুধু ক্রিকেটে অভক্তি ধরে গিয়েছিল। এ ছাড়া সবই ঠিক ছিল...তবে বিরতিটা আমার খুব কাজে লেগেছিল। আবার ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা ফিরে পেয়েছি।’
সমস্যাটা গুরুতর ছিল না বলেই ‘অনির্দিষ্টকাল’ বিরতি দীর্ঘ হয়নি। মাস তিনেকের মধ্যেই চনমনে হয়েছেন। তবে ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা তখনো ফেরেনি। ২০১১ বিশ্বকাপের পর ওয়ানডে ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর সময় যিনি বলেছিলেন, ‘আমি ক্রিকেটপাগল নই।’ সেই টেইটের মুখেই এখন ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসার কথা! নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরেকবার জিজ্ঞেস করতে হলো। হোটেল পেনিনসুলার লবি কাঁপিয়ে হেসে ওঠেন টেইট, ‘ক্রিকেট ফ্যানাটিক ছিলাম না, তবে এখন হয়ে উঠেছি, উঠছি। বয়সের সঙ্গে এটা এসেছে। আর টি-টোয়েন্টিও এখানে আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। নিজের খেলার বাইরেও আমি প্রচুর টি-টোয়েন্টি দেখি টিভিতে, রেকর্ড নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি। টি-টোয়েন্টি আমাকে ক্রিকেট উপভোগ করতে শিখিয়েছে।’
এ জন্যই এখন তিনি শুধু টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার। মাত্র ৪ ওভার বোলিং, শরীরের ওপর তেমন ধকল নেই। খেলে বেড়াচ্ছেন বিগ ব্যাশ থেকে বিপিএল, আইপিএল, নিউজিল্যান্ড থেকে জিম্বাবুয়ের টি-টোয়েন্টি। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার লম্বা করতে না পারার আক্ষেপে সান্ত্বনা বুলিয়ে দেয় ‘২০০৭ বিশ্বকাপ জয়ে ২৩ উইকেট পাওয়া, সর্বকালের সেরা ওয়ানডে দলগুলোর একটির অংশ হতে পারা।’ আর ক্যারিয়ারের এই টি-টোয়েন্টিময় নতুন অধ্যায়ে নিরন্তর অনুপ্রেরণা জোগায় একটি স্বপ্ন—শোয়েবের কাছ থেকে গতিসম্রাটের মুকুটটি জয় করা!

No comments

Powered by Blogger.