বিটিসিএলের ১৫০ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ- জাইকার অর্থায়নে টিএনডি প্রকল্প

জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে রাষ্ট্র্রায়ত্ত বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) ৮০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পে ১৫০ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে।
প্রতিষ্ঠানটির টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট (টিএনডি) প্রকল্পের আওতায় প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার লাইন স্থাপনের কাজ নিয়ে প্রকল্প পরিচালকের নেতৃত্বে বিটিসিএল ও মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে এই টাকা লোপাট করা হয়।

টাকা লোপাটের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি নিশ্চিত করে কয়েক মাস আগে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। ওই প্রতিবেদনে প্রকল্পের লট ‘বি’-তে প্রত্যভাবে একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে ১০০ কোটি টাকা এবং লট ‘এ’-তে দরপত্রের শর্তাদির ব্যত্যয় ঘটিয়ে আরো ৫০ কোটি টাকা লোপাটের কথা জানানো হয়। এরূপ প্রস্তাবে শত কোটি টাকা অর্থ বাড়িয়ে দেখানোর পর এখন চলছে বিশেষ কোম্পানিকে কাজ দেয়ার প্রক্রিয়া। ইতোমধ্যে এ প্রক্রিয়ায় অনেক দূর এগিয়ে গেছে বিটিসিএল। এর সাথে বিটিসিএল-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সদস্য (রণাবেণ ও অপারেশন), প্রকল্প পরিচালক ও পরিচালকসহ (ক্রয়) এবং বাংলাদেশে কর্মরত জাইকার একটি বড় সিন্ডিকেট প্রত্যভাবে জড়িত রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) অভিযোগ এসেছে। অর্থ লোপাটের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্পের পিপিতে (প্রজেক্ট প্রপোজাল) দুই লটের কাজের প্রাক্কলনে শত কোটি টাকা বেশি দেখানো হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত শুরু করেছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে দুদক অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। এ ছাড়া খোদ জাপানি প্রতিষ্ঠান এনইসির অভিযোগেও বিষয়টি উঠে এসেছে।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, তারা ইতোমধ্যে বিটিসিএল-এর এমডি, পরিচালক (ক্রয়), পিডি, জাইকার একাধিক পরিচালক, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাওয়াবাতার একাধিক সহকারী পরিচালক, বিটিসিএল-এর সাবেক একজন এমডিসহ অনেক কর্মকর্তাকে দফায় দফায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। দুদকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঘটনাটি আসলে পদ্মা সেতুর মতো। ভেতরে ভয়াবহ কাহিনী রয়েছে।

সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় এক হাজার ৪৩১ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার  লাইন ও ১১টি মাইক্রোওয়েব লিংক বসানোর জন্য ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অনুমোদন দেয়। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে এই কাজের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩ দশমিক ৫৩ মিলিয়ন ডলার (১১১ কোটি টাকা)। পরের বছর এই ব্যয় ১১ দশমিক ১৭ মিলিয়ন ডলার (৯১ কোটি ৭২ লাখ) বাড়িয়ে ২৪ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (২০০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা) করা হয়। গত ২৬ ডিসেম্বর প্রকল্প পরিচালক বর্ধিত এই প্রাক্কলন অনুমোদনের জন্য পাঠান। অর্থাৎ প্রাক্কলনেই প্রায় শত কোটি টাকা বেশি দেখানো হয়েছে। বিটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের লট ‘বি’র টেন্ডারের কাজটি কেটি-মারুবেনী নামে একটি কোম্পানিকে দেয়ার প্রক্রিয়া এখন শেষপর্যায়ে। আদতে সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচিত হয়েও কাজটি পাচ্ছে না এনইসি করপোরেশন। কারসাজির মাধ্যমে কেটি- মারুবেনীকে সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচিত করার চেষ্টা চলছে।

বিটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, সময়পেণের মাধ্যমে কেটি মারুবেনীকে কার্যাদেশ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দেয়ার জন্যই এমনটা করা হচ্ছে। কারণ হিসেবে বিটিসিএল-এর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মারুবেনীর দর প্রস্তাব দাখিলের দিন এক ডলার সমান ৮০ ইয়েন ছিল, যা বর্তমানে ৯০ ইয়েন। এনইসি প্রায় তিন দশমিক ৪৪ বিলিয়ন জাপানি ইয়েন এবং ৪৫ কোটি টাকার দরপ্রস্তাব দাখিল করে। অন্য দিকে কেটি-মারুবেনী জেভি প্রায় ৪৫ মিলিয়ন ডলার এবং ২৫ কোটি টাকার দর প্রস্তাব দাখিল করে। বর্তমান ডলার-ইয়েন দরে এনইসির দর প্রস্তাব প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ইয়েন কম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটি জাপানি ইয়েনের ঋণে পরিশোধ হবে। তাই এ কার্যাদেশ দিলে অতিরিক্ত আরো ৫০ কোটি টাকা লাগবে। এ দিকে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্পের অধীন এই কাজের (লট-বি) প্রাক্কলিত ব্যয় ৯০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ২০০ কোটি টাকা করে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে দিতে এই প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিয়েছে বিটিসিএল। এ জন্য একটি অসাধু চক্র ফাইবার স্থাপনের মিটার প্রতি খরচ দ্বিগুণেরও বেশি দেখিয়ে শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করার পরিকল্পনা করেছে বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থাও কর্তৃপকে সতর্ক করে। গত ১ মে ডাক ও  টেলিযোগাযোগমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়ে এই অতি মূল্যায়িত প্রাক্কলন তৈরির পেছনে চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে গোয়েন্দা সংস্থাটি।

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্প পরিচালক, বিটিসিএলের কিছু পরিচালক, প্রধান কর্মাধ্য, সহকারী পরিচালক (ক্রয়), তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জাপানি পরামর্শকসহ বেশ কয়েকজন ওই অপতৎপরতার সাথে জড়িত। একনেক কর্তৃক অনুমোদিত এ প্রকল্পের প্রাক্কলিত মূল্য ছিল ১৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার। কিন্তু বিটিসিএলের কিছু শীর্ষ ব্যক্তি, ওই প্রকল্পের সাথে জড়িত কয়েকজন কর্মকর্তা এবং জাপানি পরামর্শক কাওয়াবাতা পরিকল্পিতভাবে ২৪ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারের অতি মূল্যায়িত প্রাক্কলন তৈরি করেন। অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপনের কাজে এর আগে মিটার প্রতি গড় ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা নির্ধারিত থাকলেও অতি মূল্যায়িত ওই প্রাক্কলনে তা মিটার প্রতি এক হাজার টাকার ওপরে নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে প্রকল্পে ১০০ কোটি টাকা অনিয়ম হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়, অসাধু চক্রটি যাতে নিয়মবহির্ভূতভাবে তাদের পছন্দের কোনো কোম্পানিকে ওই প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দিতে না পারে সে জন্য পুরো প্রক্রিয়াটি পুনর্বিবেচনা করে স্বচ্ছ টেন্ডারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে।

ওই দিকে লট ‘বি’র টেন্ডারটি নিয়ে আপাতত না এগুলেও লট ‘এ’ নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এ জন্য ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় এরই মধ্যে তৎপরতা শুরু হয়েছে। গত ২১ জানুয়ারি বিটিসিএল বোর্ডসভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, বিটিসিএল বোর্ড সদস্য এবং মন্ত্রীর দফতরের কিছু কর্মকর্তা এ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িয়ে গেছেন। তারা যেকোনো উপায়ে মারুবেনীকে কাজটি দিতে চাইছেন।
  

No comments

Powered by Blogger.