তবুও নির্বিকার বিএনপি by মঈন উদ্দিন খান

দলের চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে মামলা ঝুলছে, এগোচ্ছে তার গ্রেফতারের প্রক্রিয়া। রুদ্ধ হচ্ছে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর দেশে ফেরার পথ।
দুই মাস ধরে জেলে আছেন মহাসচিব। শীর্ষ নেতারা আদালতের বারান্দায় যাচ্ছেন আর আসছেন। তৃণমূল নেতাকর্মীরা বিপক্ষ দলের অবিরাম হুমকি-ধমকি-মারপিটে দিশেহারা। মামলার ঝুলি কাঁধে নিয়ে তারা কেবল দৌড়াচ্ছেন, অনেকেই ঘরবাড়ি ছাড়া। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে একাট্টা আমজনতা। কিন্তু দাবি আদায় হচ্ছে না। এমন এক পরিস্থিতিতে আন্দোলনের মাঠে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অনেকটাই নির্বিকার, নির্জীব। ধরি মাছ না ছুঁই পানি অবস্থা। বিলম্বিত আন্দোলন, মাসের পর মাস দল গোছানো আর গণসংযোগমূলক কর্মসূচিতে তৃণমূলেও তাই এখন বিরাজ করছে  চরম হতাশা।

সরকারি দল ইতোমধ্যে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নেমে গেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও জনসভা করছেন। সেখানে তিনি নৌকার পক্ষে ভোট চাইছেন। আহ্বান জানাচ্ছেন আরেকবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার। নির্বাচন কমিশনও আগামী নির্বাচন নিয়ে তাদের পূর্ণ প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সক্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে প্রতিভাত হচ্ছে না। বিভিন্ন জরিপে সরকারি দলের জনপ্রিয়তার পারদ নিম্নমুখী হলেও বিরোধী দল ইতিবাচক কিছু দেখাতে পারছে না। সরকারের শেষ বছরে এসেও তাই বিরোধী দলের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না।

জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। সংসদে যোগ না দেয়ার যৌক্তিক কারণ থাকলেও রাজনীতি বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে গত চার বছরে সরকারের ধারাবাহিকতা ব্যর্থতা রাজপথে জোরালোভাবে তুলে ধরতে পারেনি বিরোধী দল।

বিএনপির হাইকমান্ড অবশ্য আন্দোলনের ‘উপযুক্ত’ সময় খুঁজছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগামী  দুই মাস প্রায় ‘অবকাশ’ মুডেই কাটবে বিএনপির। ফেব্রুয়ারি-মার্চে কোনো কঠোর কর্মসূচি দিচ্ছে না তারা। এপ্রিল থেকে কঠোর কর্মসূচির কথা বলা হলেও তা শুরু করতে করতে এপ্রিল পার হয়ে মে’তে গিয়ে পড়তে পারে। সরকারের নির্বাচনী প্ল্যান অনুযায়ী অক্টোবর মাসে সংসদ ভেঙে দেয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে মে-জুন-জুলাই এই তিন মাস আন্দোলনের জন্য হাতে পাচ্ছে বিএনপি। এর পর থেকে  শুরু হবে রোজা, ঈদ ও পূজা।

দল যেভাবে কোণঠাসা, ঠিক সেভাবে আন্দোলন হচ্ছে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, বর্তমানে যে আন্দোলনের কর্মসূচি চলছে, তাতে ধার আছে বলে মনে নাও হতে পারে। কিন্তু এর যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। এসএসসি পরীক্ষা চলছে। এ সময়ে কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি দেয়া হলে জনগণ বিুব্ধ হবে। সামনে বিএনপির কাউন্সিল রয়েছে। এরপর বিএনপি নতুন করে আন্দোলন কৌশল নির্ধারণ করবে।

মামলায় জর্জরিত বিএনপিঃ রাজনৈতিক মামলার ফাঁদে আটকা পড়ে বিএনপি এখন ঘায়েল। শীর্ষস্থানীয়দের পাশাপাশি সারা দেশে ৩০ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলার তরবারি ঝুলছে। মামলার রায় বিরুদ্ধে গেলে খালেদা জিয়া-তারেক রহমানসহ শতাধিক নেতার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংস ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা পুনরুজ্জীবিত, তদন্তাধীন মামলা দ্রুত চার্জশিট দেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সাথে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংস ঘটনায় ওই সময় কোনো মামলা হয়ে না থাকলে নতুন করে মামলা দায়ের করতে ভিকটিমকে উদ্বুদ্ধ করতে বলা হয়েছে। তাতে কাজ না হলে পুলিশকে বাদি হয়ে মামলা নথিভুক্ত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ রয়েছে। কোনো মামলায় প্রথমে আসামি হিসেবে দেখানো না হলেও আদালতে অভিযোগপত্র দেয়ার সময় বিএনপির প্রথম সারির নেতাদের হুকুমের আসামি করার প্রক্রিয়া চলছে।

এ ছাড়াও সারা দেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্ত শেষ করে দ্রুত চার্জশিট দাখিলের জন্য পুলিশ সদর দফতর থেকে বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। এসব মামলার আসামিদের গ্রেফতার করতে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর জন্য নির্দেশ রয়েছে। এ নির্দেশনা অনুযায়ী গত এক মাসে বিএনপির প্রায় দেড় হাজার নেতাকর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। আত্মগোপনে থাকা দলের শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতার বাসা-বাড়ি ও কর্মস্থলে হানা দেয়া হয়েছে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত চার বছরে বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ লক্ষাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ৩০ হাজারের বেশি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলার আসামির তালিকায় বিএনপির প্রভাবশালী এবং কেন্দ্রীয় থেকে তৃণমূল ও অঙ্গদলের ৯০ শতাংশ নেতা রয়েছেন। এসব মামলার বেশির ভাগেরই বাদি পুলিশ।

এ ছাড়াও দুর্নীতি, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি, মানহানি, চাঁদাবাজি, লুটপাট, নারী নির্যাতন, হত্যা ও হত্যা প্রচেষ্টা, ভয়ভীতি প্রদর্শন, সংঘর্ষের অভিযোগে বিপুলসংখ্যক মামলা করা হয়েছে। চোরাচালান, অপহরণ, ৭০ বছরের বৃদ্ধাকে ধর্ষণ, জমিজমাসংক্রান্ত, মন্দির ভাঙা, চুরি, পুকুরের মাটি চুরি, অন্যের পুকুরের মাছ চুরি, মোবাইল ফোনসেট ও ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনতাই, সরকারি গাছ চুরির অভিযোগেও বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের প্রতিষ্ঠিত নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা রুজুরও নজির রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির ১৫ জন নেতার বিরুদ্ধেই ১৫৬টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে দলটির স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক ভূমি উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর বিরুদ্ধেই রয়েছে ৩২টি মামলা। সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক আ ন ম এহছানুল হক মিলনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৩১টি। এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের ১৬টি, বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী এমপির বিরুদ্ধে ১৪টি, যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমানের ৯টি, আন্তর্জাতিক সম্পাদক নাজিম উদ্দিন আলমের ৯টি, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের ৭টি, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও সাদেক হোসেন খোকার ৬টি করে, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) হান্নান শাহের ৫টি, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, সাবেক ধর্মবিষয়ক সম্পাদক নবী সোলায়মান ও ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর বিরুদ্ধে ৫টি করে, স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে ৩টি করে মামলা রয়েছে।

সর্বশেষ গত বছরের ৯ ডিসেম্বরের অবরোধে বড় সংখ্যার মামলা রুজু করা হয়েছে। ওই দিনের গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ঢাকাসহ সারা দেশে ৭২টি মামলা করা হয়। এসব মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ ১৮ দলীয় জোটের ২০ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে ৩৮টি। আসামি করা হয়েছে চার হাজার ৫৪০ জনকে।

গ্রেফতারের তালিকায় খালেদা জিয়া, জেলে ফখরুলঃ এক-এগারোর জরুরি সরকারের সময় শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া উভয়ের বিরুদ্ধেই বেশ কিছু মামলা দায়ের করা হয়। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা থেকে খালাস পেলেও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সব ক’টি মামলা ঝুলে আছে। গত মাসে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাতের মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুদকের দেয়া চার্জশিট আমলে নিয়েছেন আদালত। এ মামলার পরিণতি এখনো অজানা। তবে নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করার শঙ্কা ততই বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী গতকালও রাজধানীতে একটি জনসভায় খালেদা জিয়ার বিচার করার কথা বলেছেন।

বিএনপির মহাসচিব প্রায় দুই মাস ধরে জেল খাটছেন। গত ১০ ডিসেম্বর অবরোধে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। ৯ ডিসেম্বর ১৮ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধে গাড়ি ভাঙচুর, পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধা ও বিস্ফোরক আইনে রাজধানীতে ৩৮টি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলার দু’টিতে মির্জা ফখরুলকে সরাসরি আসামি করা হয়। অপর মামলাগুলোর এজাহারে থাকলেও এফআইআরে তার নাম নেই। প্রথম দু’টি মামলায় তার জামিন হওয়ার পরও এখন একটির পর একটি মামলায় তাকে আসামি দেখানো হচ্ছে। মির্জা ফখরুলের মুক্তির দাবিতে ঢাকায় একটি আধাবেলা হরতাল আর একটি বিক্ষোভ ছাড়া বিএনপি কঠোর কোনো কর্মসূচি দেয়নি। এ নিয়ে দলের ভেতরেও  বেশ সমালোচনা আছে।

মানিলন্ডারিং ও একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা ঝুলছে। দেশে ফিরলেই তাকে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এসব মামলার কারণে তারেক রহমানের দেশে ফেরাও তাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

মার্চে কাউন্সিলঃ মামলা-হামলার এমন পরিস্থিতি সামনে রেখে আবারো দল গোছানোর উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। আগামী মার্চে দলটি কাউন্সিল করার ঘোষণা দিয়েছে। মার্চের প্রথম অর্ধেই কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন। বিএনপি সূত্র মতে, আসন্ন কাউন্সিলে দলের পদ-পদবিতে তেমন কোনো পরিবর্তন আসছে না। স্থায়ী কমিটির দু-একটি পদ, পূর্ণ মহাসচিব, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদের নিষ্পত্তি হতে পারে এই কাউন্সিলে। এ ছাড়া নির্বাহী কমিটির ৩৮৬টি পদের মধ্যে প্রায় ২০০ নেতা নিষ্ক্রিয় থাকায় তাদের স্থলে নতুনদের অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। আর এসব পদ পেতে এরই মধ্যে হাইকমান্ডের কাছে সরাসরি বা বিভিন্ন মাধ্যমে তদবির শুরু করেছেন আগ্রহীরা। বিশেষ করে ১/১১’র প্রেক্ষাপটে যারা দলে কোণঠাসা তারা নানাভাবে চেষ্টা করছেন দলের মূল স্রোতে ভিড়তে। আন্দোলন-সংগ্রামের বিষয়টি বিবেচনা করে এবার তাদের অন্তর্ভুক্তির সম্ভবনাও বেশি। চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ, এর দায়ে সাজাপ্রাপ্ত এবং ট্রুথ কমিশনে নিজের দুর্নীতির দায় স্বীকার করা নেতারা ছাড়া সক্রিয় বেশির ভাগ রাজনীতিবিদ আসন্ন কাউন্সিলে দলের চেয়ারপারসন পদ দিয়ে মূল্যায়ন করবেন বলে জানা গেছে।

বড় চ্যালেঞ্জ তত্ত্বাবধায়ক দাবি আদায়ঃ মার্চে কাউন্সিলের পর সুসংগঠিত দল নিয়ে এপ্রিল থেকে আন্দোলনের চিন্তাভাবনা করছে বিএনপি। আন্দোলনের পথে এখন তাদের মূল চ্যালেঞ্জ তত্ত্বাবধায়ক দাবি আদায়। এ দাবি বহালে বিএনপি সরকারকে তিন মাসের আলটিমেটাম দিয়েছিল, এ পর্যন্ত হরতাল ডেকেছে ৫-৬টি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক দাবির পক্ষে জনসমর্থন রয়েছে। আওয়ামী লীগ ছাড়া দেশে প্রতিনিধিত্বশীল সব ক’টি রাজনৈতিক দল নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার সরকারি দলের অনড় মনোভাবের কারণে বিএনপি কোন পথে তত্ত্বাবধায়ক দাবি আদায় করবে সেটাই অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
       

No comments

Powered by Blogger.