চোর ধরতে গিয়ে প্রাণ দিলেন সাহসী এসআই শরিফুল

মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার জামালদি এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গতকাল রবিবার ভোরে বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার চোরচক্রের হামলায় ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এক উপপরিদর্শক (এসআই) নিহত হয়েছেন। তাঁর নাম শরিফুল ইসলাম খান (৩৮)।
ডিবি পুলিশের ওই অভিযানকালে আবদুল মতিন শিপন (৩০) নামের চোরচক্রের এক সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেছে পুলিশ। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি এলাকার রাস্তা থেকে হাইওয়ে পুলিশ একটি ট্রান্সফরমার, ১৮টি কাঠের গুঁড়ির বস্তা ও তিনটি কাটারসহ চোরদের ব্যবহার করা ট্রাকটি পরিত্যক্ত অবস্থায় আটক করেছে। ঘটনাস্থল থেকে পিস্তলের এক রাউন্ড তাজা গুলি উদ্ধার করেছে গজারিয়া থানা পুলিশ।
ডিবি কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীর ডেমরার সারুলিয়া এলাকা থেকে ট্রন্সফরমার চোরচক্রের একটি ট্রাককে ধাওয়া করে ডিবির দুটি গাড়ি। ডিবি পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পালানোর সময় ট্রাকটি আটকাতে সাহসিকতার সঙ্গে ট্রাকের ওপর উঠে পড়েন এসআই শরিফুল। চোরদলের সদস্যরা মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করে তাঁকে রাস্তায় ফেলে দেয়। হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা শরিফুলকে মৃত ঘোষণা করেন।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আরো জানান, ট্রান্সফরমার চোরচক্রের গন্তব্য ছিল গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকা। গতকালই ওই এলাকায় ট্রান্সফরমার বিক্রির একটি কারখানার সন্ধান পেয়েছে ডিবি।
এদিকে সহকর্মীরা জানিয়েছেন, শরিফুল কবিতাও লিখতেন। সাহসিকতার জন্য কয়েকবার পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এ কর্মকর্তার মৃত্যুর সংবাদে ঢাকা মহানগর পুলিশ সদস্যদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শরিফুলের লাশ দেখতে ছুটে যান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শোক প্রকাশ করেছেন।
ডিবির উপকমিশনার (ডিসি) মোল্লা নজরুল ইসলাম ও অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মশিউর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁদের কাছে গোপন খবর ছিল, একটি ট্রান্সফরমার চোরচক্র ডেমরার সারুলিয়া এলাকা হয়ে মহাসড়কের দিকে যাবে। তাই রাতের শেষভাগে ওই এলাকায় দুই ভাগে অবস্থান নেয় ডিবির একটি মাইক্রোবাস ও একটি পিকআপ। দুই বাহনে ডিবির ১৩ সদস্য (চালকসহ) ছিলেন। ভোর পৌনে ৫টার দিকে একটি ট্রাক শনাক্ত করে পিছু নেয় ডিবির দল। ট্রাকটির গন্তব্য গাজীপুরের কোনাবাড়ী থাকলেও ডিবির ধাওয়া খেয়ে চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলে যায় সেটি। ডিবির গাড়িও ট্রাকটিকে ধাওয়া করে। ট্রাক থেকে ডিবির গাড়ি লক্ষ্য করে ইট ছোড়া হয়।
ডিবির কর্মকর্তারা আরো জানান, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া এলাকায় ডিবির দুটি গাড়ি সামনে ও পেছন থেকে চোরের ট্রাকটি আটকানোর চেষ্টা করে। ওই সময় গতি কমলে এসআই শরিফুল দৌড়ে ট্রাকের পাশের দিকে উঠে চাবি নিয়ে ট্রাকটি থামানোর চেষ্টা করেন। ওই ট্রাকে চোরচক্রের ১৫ থেকে ২০ জন সদস্য ছিল। তারা শরিফুলের ওপর হামলা চালায়। ইট দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করে রাস্তায় ফেলে দেয়। চোররা ট্রাকটি থামিয়ে পেছন দিয়ে ডিবির মাইক্রোবাসটিকে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে মাইক্রোবাসটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই সময় শরিফুলকে বাঁচাতে এবং চোরচক্রকে ধরতে ডিবি পুলিশ গুলি ছোড়ে বলে দাবি করেন কর্মকর্তারা।
অভিযানে থাকা ডিবির পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলম জানান, চোরচক্রের ট্রাকটি আটকানোর জন্য কয়েক জায়গায় ব্যারিকেড দিয়েও তাঁরা ব্যর্থ হন।
গতকাল বিকেলে এডিসি মশিউর রহমান জানান, গাজিপুরের কোনাবাড়ীতে যে কারখানায় ট্রান্সফরমারটি নেওয়ার কথা ছিল সেটি শনাক্ত করেছেন তাঁরা।
এদিকে সকাল ৮টার দিকে শরিফুল ও শিপনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন ডিবির সদস্যরা। ওই সময় জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা শরিফুলকে মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শরিফুলের মাথা ছাড়া শরীরের কোথাও জখম নেই। এদিকে শিপনের ডান পায়ে দুটি গুলি বিদ্ধ হওয়ায় গতকাল তার দুই দফা অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, শিপন চোরচক্রের ট্রাকটির চালক। তার বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনিতে। বাবার নাম আবদুর রাজ্জাক।
এলাকাবাসী ও মুন্সীগঞ্জ পুলিশের ভাষ্য : ঘটনাস্থলের পাশের বাড়ির বাসেত সরকার বলেন, 'গতকাল খুব ভোরে গোলাগুলির শব্দ শুনে আমি জেগে উঠি। দরজা খুলে দেখতে পাই, পুলিশের গুলি খেয়ে একজন আমার বাড়ির উঠানে এসে পড়ে আছে। পরে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকায় নিয়ে যায়। ওই সময় বেশ কয়েকটি পিস্তলের গুলির খোসা পড়ে ছিল বাড়ির উঠানের পাশে। তা ছাড়া আহত চোরের শরীর থেকে ঝরে পড়া রক্তের দাগও লেগে ছিল উঠানে।'
মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার শাহাবুদ্দিন খান জানান, ধাওয়া খেয়ে ট্রাক ফেলে চোরের দল পালিয়ে গেলেও গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন ধরা পড়েছে।
পুলিশ কত রাউন্ড গুলি ছুড়েছে জানতে চাইলে মুন্সীগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাকির হোসেন মজুমদার জানান, বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়। চোরের দল গুলি ছুড়েছিল কি না, তাও নিশ্চিত নয়।
গজারিয়ার ভবেরচর হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সার্জেন্ট জয়নাল আবেদিন জানান, ঘটনাস্থলের কাছ থেকেই হাইওয়ে পুলিশ ট্রাকটি পরিত্যক্ত অস্থায় উদ্ধার করেছে। ট্রাকটিতে বিদ্যুতের একটি ট্রান্সফরমার, কাঠের গুঁড়ির ১৮টি বস্তা ও তিনটি কাটার পাওয়া গেছে।
গজারিয়া থানার ওসি জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, এলাকাবাসী সাত-আট রাউন্ড গুলির আওয়াজ শুনেছে। বাসেতের বাড়ির কাছ থেকে পিস্তলের এক রাউন্ড তাজা গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।
শরিফুলের পরিচিতি : সহকর্মী ও স্বজনরা জানায়, শরীফুল ডিবির পশ্চিম বিভাগের অবৈধ মাদকদ্রব্য উদ্ধার ও প্রতিরোধ টিমে কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৯৯৯ সালে কনস্টেবল হিসেবে পুলিশে যোগ দেন। এরপর পদোন্নতি পেয়ে এএসআই এবং এসআই হন। ২০১১ সালের ৬ আগস্ট শরিফুল ডিবিতে যোগ দেন। শরিফুলের বাবার নাম গাজী আবদুর রশিদ। তাঁর বাড়ি সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানার চন্দনগাঁতী গ্রামে। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে শরিফুল ছিলেন তৃতীয়। তিনি রাজধানীর দক্ষিণ গোড়ানের ৩৩৩/ডি/এ/৩ নম্বর বাড়িতে স্ত্রী জেসমিন আক্তার ও দুই শিশুকন্যা নিয়ে থাকতেন। শরিফুলের দুই মেয়ে সাফিয়ান ইসলাম নোভা (৬) ও হুমায়রা ইসলাম স্বাজীন খিলগাঁওয়ের সাউথপয়েন্ট স্কুলে কেজি ওয়ান ও নার্সারিতে পড়ে।
ময়নাতদন্ত ও জানাজা : গতকাল সকালে শরিফুলের মৃত্যুর খবর পেয়ে ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদসহ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ছুটে যান। সেখানে বেনজীর আহমেদ বলেন, 'সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শরিফুল নিহত হয়েছেন। এমনিভাবে দায়িত্ব পালনকালে ৪০ জনের বেশি পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। তাঁরা আমাদের অহংকার। কাজের অনুপ্রেরণা।'
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে শরিফুলের লাশ রাজারবাগ পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দুপুর পৌনে ২টার দিকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে শরিফুলের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার, অতিরিক্ত আইজিপি (প্রশাসন) এ কে এম শহীদুল হক, ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
জানাজার পর শরিফুলের লাশ তাঁর গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার চন্দনগাঁতী গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.