রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া শুরু by আশরাফুল ইসলাম

আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ বছরে রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর অংশ হিসেবে গতকাল তিনটি ব্যাংকের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপন করা হয়। আগামী মঙ্গলবার আরো তিনটি ব্যাংকের পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হবে। পর্ষদ সন্তুষ্ট হলে ওই দিনেই নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যতগুলো শর্ত দেয়া হয়েছিল তার বেশির ভাগেই গোজামিল দিয়ে উদ্যোক্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রথমে পেশ করেছিলেন। যেহেতু সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক দিতে বদ্ধপরিকর, সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যেসব ক্ষেত্রে অসঙ্গতি ছিল ওই সব বিষয়ে ঠিক করতে বলা হয়। এমনো ব্যাংকের উদ্যোক্তা আছেন, যাদের আবেদন ৫ থেকে ১০ বার পর্যন্ত সংশোধন করান বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

নতুন ব্যাংক পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া শর্তের অন্যতম ছিল ৪০০ কোটি টাকার সাদা টাকা জমা দিতে হবে। যারা ব্যাংকের পরিচালক হবেন তারা কর খেলাপি বা ঋণখেলাপি হতে পারবেন না। একজন উদ্যোক্তা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে পারবেন এবং সর্বোচ্চ ২০ জন পরিচালক থাকতে পারবেন। ব্যাংক পাওয়ার আবেদন করার ছয় মাসের সময়সীমা শেষ হয় গত ১৬ অক্টোবর। ওই সময় প্রাথমিক অনুমোদন পাওয়া ৯টি ব্যাংকের মধ্যে সাতটি প্রস্তাবিত ব্যাংকের উদ্যোক্তারা তাদের আবেদন জমা দেন। সাতটি প্রস্তাবিত ব্যাংকের জন্য ১৪০ ব্যক্তি ২০ কোটি টাকা করে দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকা জমা দেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, আবেদপত্রগুলো ১৭ অক্টোবর থেকে বাছাই শুরু হয়। প্রস্তাবিত ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তাদের দেয়া আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই কালে তিনটি বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রথম বিষয়টি হলো উদ্যোক্তাদের জমা দেয়া অর্থ বৈধ কিনা। এ জন্য আবেদনের সাথে জমা দেয়া উদ্যোক্তাদের আয়কর সার্টিফিকেট নিয়ে তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে তাদের আয়কর বিবরণীগুলো মিলিয়ে দেখা হয়।

দ্বিতীয়ত উদ্যোক্তারা ঋণ বা কর খেলাপি কিনা। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইব) রক্ষিত ঋণ তথ্য খতিয়ে দেখা হয়। বিষয়টি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকেও যাচাই করা হয়। তৃতীয়ত ব্যাংকে উদ্যোক্তারা যে অর্থ জমা দিয়েছেন, তা ব্লকড করা হয়েছে কিনা। কেননা ব্যাংকে উদ্যোক্তারা মূলধন হিসেবে যে অর্থ জমা দিয়েছেন তা ব্লকড করা না হলে তারা যেকোনো সময় তা উত্তোলন করে নিয়ে যাবেন। আর ব্লকড করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া অর্থ উত্তোলন করা যাবে না; ব্যাংক কোম্পানি গঠন হয়ে গেলে পরে জমা দেয়া অর্থ মূলধন হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের হিসেবে স্থানান্তর হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের সময় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অসঙ্গতি পাওয়া যায় একং অসঙ্গতিগুলো দূর করার জন্য উদ্যোক্তাদের ডেকে তা সংশোধন করা হয়। একজন কর্মকর্তা জানান, দলীয় সমর্থকদের সরকার ব্যাংক  দেবে এ ধরনের নির্দেশনা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। তবে কাগজপত্রে অসঙ্গতি রেখে ব্যাংকের লাইসেন্স দিলে সরকার পরিবর্তন হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ফেঁসে যেতে পারেন। নিজেদের স্বচ্ছতা বজায় রাখার স্বার্থেই কাগজপত্রে অসঙ্গতি দূর করা হয়।

কাগজপত্র যাচাই-বাছাই চূড়ান্ত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তা মেমো আকারে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপন করছেন। একই সাথে প্রস্তাবিত ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছ থেকে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা শোনা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে গত ১৬ জানুয়ারি একটি ব্যাংকের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়। গতকাল তিনটি প্রস্তাবিত ব্যাংকের পরিচালকেরা তাদের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তুলে ধরেন। এগুলো হলো এনআরবি, ইউনিয়ন ও সাউথ বাংলা। আগামীকাল মঙ্গলবার মিডল্যান্ড, মেঘনা ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের প্রধানেরা তাদের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তুলে ধরবেন। পর্ষদ সন্তোষ হলে কেবলই তাদের ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হবে।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ব্যাংক দেয়ার এসব প্রক্রিয়া শুধুই নিয়ম রক্ষার জন্য। সরকার যাদের ব্যাংক দিতে চেয়েছেন তাদেরকেই ব্যাংক দেয়া হচ্ছে।

প্রস্তাবিত ব্যাংকের প্রধান উদ্যোক্তারা হলেন, ফার্মাস ব্যাংক যার অন্যতম উদ্যোক্তা হলেন আওয়ামী লীগ নেতা ও বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর। ইউনিয়ন ব্যাংক যার প্রধান উদ্যোক্তা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ‘সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক’-এর অন্যতম উদ্যোক্তা হলেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাবেক নেতা অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী। ব্যাংকটির আবেদনে চেয়ারম্যান হিসেবে নাম আছে এস এম আমজাদ হোসেনের। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড যার চেয়ারম্যান যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা ফরাসত আলী। মিডল্যান্ড ব্যাংক এই ব্যাংকের অন্যতম উদ্যোক্তা প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত এম মনিরুজ্জামান খন্দকার। মেঘনা ব্যাংকের অন্যতম উদ্যোক্তা সরকারদলীয় সংসদ সদস্য এইচ এন আশিকুর রহমান ও নসরুল হামিদ। ব্যাংকটির প্রস্তাবিত চেয়ারম্যান হলেন আশিকুর রহমান। আবেদন জমা দেয়ার সময় চাওয়া দু’টি প্রস্তাবিত ব্যাংকের একটির উদ্যোক্তা ঢাকার সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপসের প্রস্তাবিত ‘মধুমতি ব্যাংক’ রয়েছে। এই ব্যাংকের প্রস্তাবিত চেয়ারম্যান হিসেবে নাম আছে হুমায়ুন কবীরের। অন্যটি এনার্বি ব্যাংক।

No comments

Powered by Blogger.