দেশে কৃষকের দুর্দিন- কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করুন

আধুনিক প্রযুক্তির সুফল হিসেবে দেশে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বেড়েছে। তবে এতে কৃষকদের তেমন লাভ হয়নি। তারা উৎপাদনব্যয় পোষাতে পারছেন না।
কারণ ফলন ও সরবরাহ আশানুরূপ হলেও বাজারে পণ্যের দাম উৎপাদক তথা কৃষকদের জন্য হতাশাব্যঞ্জক। ধারাবাহিক লোকসানে কৃষিজীবীদের হতাশা ক্রমেই বাড়ছে। গত শনিবার নয়া দিগন্তের এক রিপোর্টে এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করা হয়, এক দিকে কৃষি উপকরণের পাশাপাশি কৃষি শ্রমিকের মজুরি বেড়ে চলেছে, অন্য দিকে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। পরপর কয়েক বছর লোকসান দেয়ায় অনেকে দেনার দায়ে বিপর্যস্ত। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে কৃষিকাজ ছেড়ে অন্যান্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। এমন অবস্থায় কৃষি খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দুঃখের বিষয় হলো, কৃষকের উৎপাদিত ফসল তার কাছে যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ দাম থাকে কম। ফসল তার হাত থেকে ফড়িয়া-আড়তদার অর্থাৎ মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে গেলেই দাম বাড়তে থাকে। মাত্র দুই মাসেই চালের দাম প্রতি মণে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। এর অর্থ, এক কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকার বেশি। জানা গেছে, উৎপাদনব্যয়ের অর্ধেক দামে ধান-চাল বিক্রি করে বহু কৃষক বড় ধরনের লোকসান দিয়েছেন। গত বছর উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় কয়েক লাখ টন আলু কোল্ডস্টোরেজে পচে নষ্ট হয়েছে। ফলে চাষি ও হিমাগার মালিকদের কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। তদুপরি, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা বর্তমান মওসুমে দেশের প্রধান খাদ্যশস্য ধান, পাট ও আলুর চাষাবাদ কমিয়ে দিয়েছেন। এ কারণেই এখন আলুর ভরা মওসুমেও আমাদের অন্তত ২৫ টাকা কেজি দরে আলু কিনতে হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের সবজিচাষিদের লোকসান হয়েছে বিপুল পরিমাণে। মাছ, মুরগি ও গরুর খামারের মালিকেরাও রেহাই পাচ্ছেন না লোকসানের কবল থেকে। এ পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে তারা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন। আর এটা অনিবার্য যে, উৎপাদন বা ফলন কমলে বাজারে সরবরাহ কমে যায়। ফলে বেড়ে যায় চাহিদা ও দাম। এতে সাধারণ ক্রেতাদের দুর্ভোগ চরমে ওঠে।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে পরিচিত। আমাদের এ দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কৃষিকাজের স্থান গ্রামাঞ্চলেই বাস করেন। বাংলাদেশের অর্থনীতি আজো অনেকটা কৃষির ওপর নির্ভরশীল। শিক্ষক ছাড়া যেমন শিক্ষাব্যবস্থার কথা কল্পনাও করা যায় না, তেমনি কৃষক ব্যতীত কৃষির কথা ভাবা অসম্ভব। কৃষককে বঞ্চিত করে দেশের কৃষি খাতে উন্নয়ন সম্ভব নয়। কারণ ‘উন্নয়ন’ মানে শুধু বাম্পার ফলন আর এজন্য কৃতিত্ব দাবি করে সরকারের ঢাকঢোল পেটানো নয়, কৃষকসমাজ কৃষির প্রাণ। ন্যায্য পাওনা তথা ন্যায়সঙ্গত অধিকার কৃষিজীবীরা যদি না পান, তাহলে কৃষির প্রাণরস শুকিয়ে তা বিপন্ন হয়ে পড়বে। এর ফলে কেবল কৃষি খাতের উৎপাদকেরাই নন, গোটা দেশ ও জাতি হবে বড় ধরনের ক্ষতির শিকার। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, কৃষকেরা লোকসান দিয়ে সামান্য দামে বিভিন্ন ধরনের ফসলসহ কৃষিপণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। আর ভোক্তা জনসাধারণ বাধ্য হচ্ছেন চড়া দামে এই পণ্যগুলো কিনতে। অথচ এর বিনিময়ে লাভের টাকা যাচ্ছে ফড়িয়া ও আড়তদারের পকেটে।

আমাদের দেশের জনগণকে ‘গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ’-সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে বহু বছর ধরে। কৃষি ও কৃষকের স্বার্থরক্ষা ও পর্যাপ্ত বিকাশ ব্যতিরেকে এই সুন্দর স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ প্রবচনটির সত্যতা বজায় রাখতে হলে কৃষিজীবীদের অবহেলা করা যাবে না কিছুতেই। অথচ এখন দেশের লাখ লাখ কৃষক বঞ্চনা-বৈষম্য, হয়রানি ও শোষণের কারণে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি।

আমরা মনে করি, কৃষকের দুর্দিন ও কৃষির সঙ্কট ঘোচাতে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে মাঠপর্যায়েই। এর সাথে কৃষি উপকরণের দাম যাতে সহনীয় পর্যায়ে থাকে, সে জন্য প্রয়োজনে ভর্তুকির ব্যবস্থা থাকতে হবে। সহজ শর্তে ও বিনাসুদে কৃষিঋণ ছাড়াও পণ্য সংরক্ষণ ও বিপণনের সুবিধা নিশ্চিত করা আবশ্যক। বিশেষ করে মুনাফাখোর মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.