মাদ্রাসায় আটকে জঙ্গি শিক্ষা by রেজোয়ান বিশ্বাস

মিশনারি স্কুলে ভালো খাবারদাবার আর উন্নতমানের শিক্ষার কথা বলে দুর্গম পাহাড়ের কোল থেকে ওদের নিয়ে আসা হয় ঢাকা শহরের বিভিন্ন মাদ্রাসায়। এরপর ওই শিশুদের অভিজ্ঞতা হয় ভয়ংকর। ধর্মান্তরিত করে শেখানো হতে থাকে জঙ্গিবাদ।
রাঙামাটির বিলাইছড়ির আদিবাসী শিশু রবিন ত্রিপুরা (১১) বাংলায় বলল, 'মাদ্রাসার হুজুররা আমাদের আরবি পড়াতেন। আর শেখাতেন আমেরিকা খুব খারাপ। তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে হবে। সব ইসলামের শত্রুদের ধ্বংস করতে হবে। এর পুরস্কার পাওয়া যাবে বেহেশতে।'
রবিন জানায়, মিশনারি স্কুলে লেখাপড়া ও থাকা-খাওয়ার কথা বলে রাঙামাটির বিলাইছড়ি থেকে তাদের ঢাকায় এনে মাদ্রাসার শিক্ষকরা আটকে রেখেছিলেন। তাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করানো হয়। নতুন নাম দেওয়া হয় শামসুল ইসলাম। তার ছোট ভাই হামজানা ত্রিপুরাকেও (৮) ধর্মান্তরিত করা হয়। তার নাম দেওয়া হয় সুমন।
চমকে ওঠার মতো এ রকম আরো তথ্য মিলেছে সম্প্রতি মিরপুর ও মোহাম্মদপুর তিনটি মাদ্রাসা থেকে উদ্ধার করা ২১টি আদিবাসী শিশুর কাছ থেকে। এই শিশুদের বয়স পাঁচ থেকে ১২ বছর। উদ্ধারের পর রাজধানীর সুবজবাগ থানার পুলিশের হেফাজতে থাকার সময় এসব শিশু কালের কণ্ঠকে জানায়, তাদের মা-বাবা গরিব, নিরক্ষর। পাহাড়ে জুম চাষ (পাহাড়ের ঢালে বিশেষ চাষাবাদ) তাদের পেশা। মা-বাবাকে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ঢাকায় এনে মাদ্রাসাগুলোতে আটক রাখা হয়েছিল। কথার অবাধ্য হলেই চলত শারীরিক নির্যাতন।
রাঙামাটির বিলাইছড়ির সংরাছড়ির বালেশ্বরী গ্রামের আরেক শিশু সারথি ত্রিপুরা (৯) কালের কণ্ঠকে জানায়, সে যখন আরো ছোট তখন তার বাবা আনন্দ ত্রিপুরা মারা যান। সংসারে খুব অভাব। মা রাঙামাটির ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে তিন বেলা খাবার চেয়ে আনতেন। পরে মাদ্রাসার শিক্ষকরা তাকে ঢাকায় এনে ধর্মান্তরিত করেন। নাম রাখা হয় মতিয়ার রহমান। সারথি ত্রিপুরা বলল, 'হুজুররা বলতেন, তোমরা সবাই ইসলামের সৈনিক। তাই তোমাদের ইসলামের শত্রুদের কতল করতে হবে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওবামা কাফের, মোনাফেক। সে ইসলামের শত্রু। তাঁরা স্লোগান শেখাতেন ওবামার চামড়া, তুলে নেব আমরা। আমেরিকার আস্তানা জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও। বিশ্ব নবীর অপমান মানব না, মানব না।'
রোহিত (১১) নামের আরেক শিশু বলল, 'দুই বছর আগে আমাকে মুসলমান বানানো হয়। হুজুররা বলতেন, যারাই ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলে, তাদের হত্যা করতে হবে। প্রয়োজনে শহীদ হতে হবে।'
হুজুরদের এ রকম নিগড় থেকে পালিয়ে মা-বাবার কাছে ফিরতে সক্ষম হয় কয়েকটি শিশু। তাদের এক শিশু কর্ণজয় ত্রিপুরা বলল, 'পাহাড়ি মাটিতে আমার জন্ম। আমি সেখানেই থাকতে চাই। কিন্তু আমাকে ঢাকায় এনে ধর্মান্তরিত করে মিরপুরের ১৬ নম্বর আকবর কমপ্লেক্স মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়। শেখানো হয় ইসলাম ধর্ম ভালো। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হবে। ইসলামের শত্রুরা কাফের। ওদের খতম করতে হবে। প্রয়োজনে মেরে ফেলতে হবে। আমেরিকানরা ইসলামের শত্রু। ওবামার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাতে হবে। অস্ত্র দিয়ে ওদের মোকাবিলা করতে হবে। আফগানিস্তানে যেতে হবে।'
পুলিশ এমন ২১ আদিবাসী শিশুকে গত শনিবার সবুজবাগের আবুজর গিফারি মাদ্রাসা ও মসজিদ কমপ্লেক্স এবং দাওয়া বাংলাদেশ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্ধার করে। পরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং আদিবাসী ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের সহায়তায় তাদের ফেরত পাঠানো হয় গ্রামের বাড়িতে।
এদিকে গতকাল রবিবার বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড় থেকে ১৯ ত্রিপুরা শিশুকে পিরোজপুরের একটি মাদ্রাসায় পাচারকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড়ি ছাত্রকর্মীরা ছয়জনকে উদ্ধার করে। রাজধানীর একটি বাসের কাউন্টার থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়। বাকি ১৩টি শিশু ঢাকায় আসার পথে চট্টগ্রামে বাস থেকে নেমে পালিয়ে যায়। তাদের সবারই বয়স পাঁচ থেকে ১২ বছর।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, সবুজবাগ এলাকার অন্তত পাঁচটি মাদ্রাসায় আদিবাসী শিশুদের আটক রেখে জঙ্গিবাদ শেখানো ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। বাসাবোর আবুজর গিফারি ও মিরপুরের ১৬ নম্বর আকবর কমপ্লেক্স নামে মাদ্রাসাসহ আরো দুটি মাদ্রাসা থেকে গত মাসে ১১ আদিবাসী শিশু পালিয়ে যায়। গত দুই বছরে কয়েকটি মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে রক্ষা পেয়েছে এমন অর্ধশতাধিক শিশু। প্রশিক্ষিত জঙ্গি বানানোর গোপন মিশন নিয়েই এসব শিশুকে দুর্গম পাহাড় থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। এ জন্য সাদা কাগজে মাদ্রাসা শিক্ষকরা তাদের কাছ থেকে নিয়েছেন টিপসই। পরে এসব কাগজে ধর্মান্তরিত করার পক্ষে মা-বাবার বয়ান লিপিবদ্ধ করা হতো। রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির দুর্গম পাহাড় থেকে এমন শতাধিক শিশুকে প্রথমে আনা হয় রাঙামাটির একটি ইসলামী সংস্থার কমপ্লেক্সে। পরে তাদের ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন মাদ্রাসায় পাঠানো হয়। মাদ্রাসায় নেওয়া অনেক শিশুর সন্ধানও মিলছে না বলে জানিয়েছে উদ্বিগ্ন পরিবার।
একটি সূত্র জানিয়েছে, অনেক দিন খবর না পেয়ে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সগুরাম, দয়কম, জুলিমা, সায়নি, সেনিপতি, আব্রাহাম, পিতর, সুজন ও সোহেল চাকমাকে তাদের পরিবার এখন হন্যে হয়ে খুঁজছে। ঢাকায় থাকা পাহাড়ি লোকজনের মাধ্যমে তারা শিশুদের সন্ধানে টেলিফোন ও সশরীরে ধরণাও দিচ্ছে। কয়েকটি পরিবারকে সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসাগুলো থেকে 'বেশি বাড়াবাড়ি না করার' জন্য হুমকি-ধমকিও দেওয়া হচ্ছে।
আদিবাসী শিশুদের ধর্মান্তরিত করার নেপথ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক মহাপরিচালক শামসুল আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। উদ্ধার পাওয়া আদিবাসী শিশু ও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাদের অভিভাবকরা সব অপকর্মের হোতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তাঁকে। শামসুল আলমের সবুজবাগের আবুজর গিফারি মসজিদ কমপ্লেক্স থেকেই বেশ কয়েকটি আদিবাসী শিশু উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া রাঙামাটি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একজন সহকারী পরিচালকসহ আরো কয়েক ব্যক্তির বিরুদ্ধেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শামসুল আলম তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। পর পর তিন দিন সাক্ষাতের জন্য সময় চেয়েও তাঁর দেখা মেলেনি। চতুর্থ দফায় টেলিফোনে কথা বলতে রাজি হন তিনি। শামসুল আলম বলেন, 'পার্বত্যাঞ্চলের ওই সব শিশুর পরিবার গরিব ও অসহায়। পরিবারের সম্মতিক্রমেই শিশুদের ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। তাদের ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা হচ্ছে। অনেক পাহাড়ি আদিবাসী পিতা-মাতাও মুসলিম হয়েছেন। তাঁদের তাঁরা আর্থিক সহযোগিতা দেন।' তিনি দাবি করে বলেন, তাঁদের মাদ্রাসা কমপ্লেক্সে কোনো জঙ্গি প্রশিক্ষণ চলে না। একটি মহল চক্রান্ত করে শিশুদের দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, আদিবাসী শিশুদের প্রতারণা করে ঢাকায় এনে ধর্মান্তরিত করা একটি চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। কোমলমতি শিশুদের মগজ ধোলাই করে জঙ্গি প্রশিক্ষণও দেওয়া মারাত্মক ফৌজদারি অপরাধ। তিনি এর বিরুদ্ধে তৎপর হওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।
মিজানুর রহমান জানান, কমিশনের সহায়তায় দুটি আদিবাসী শিশুকে মাদ্রাসা থেকে উদ্ধার করে মা-বাবার কাছে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাদের কাছে নিশ্চিত তথ্য রয়েছে, মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের কয়েকটি মাদ্রাসায় এখনো ১২টি আদিবাসী শিশু আটক আছে। আরো কয়েকটি মাদ্রাসায় এমন বহুসংখ্যক শিশুকে আটক রাখার অভিযোগও তাঁরা পেয়েছেন। আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় তাদের উদ্ধারে তৎপরতা চলছে।
র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, ঢাকার অনেক মাদ্রাসা ছাত্রদের রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে ব্যবহার করছে। আদিবাসী শিশুদের ধর্মান্তরিত করে জঙ্গি প্রশিক্ষণের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
মাদ্রাসা থেকে শিশু উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন সবুজবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. বাবুল। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'পুরনো বা নবগঠিত কোনো কোনো জঙ্গি সংগঠন এসব অপতৎপরতার সঙ্গে জড়িত, আমরা তা খতিয়ে দেখছি। আমরা চাইছি, পুরো চক্রটিকে হাতেনাতে আটক করতে।'
আদিবাসী ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের ঢাকা শাখার সাধারণ সম্পাদক বরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা কালের কণ্ঠকে জানান, মিথ্যে প্রলোভনে যেসব শিশুকে দুর্গম পাহাড় থেকে ঢাকায় আনা হয়েছে, তাদের মধ্যে শতাধিক শিশুর খোঁজ-খবর চলছে। অনেক শিশুরই হদিস মিলছে না। আবার বেশ কয়েকটি শিশুকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.