হতাশ কৃষক বোরোবিমুখ by রাজীব আহমেদ

টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার পিচুরিয়া গ্রামের হজরত আলী বরাবরই বর্গাচাষি। প্রতি বোরো মৌসুমে তিনি ১২০ শতাংশ জমিতে ধান বোনেন। তবে কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে এ বছর তিনি মালিককে ৭০ শতাংশ জমি ফেরত দিয়েছেন। অন্য ৫০ শতাংশে করেছেন গমের চাষ।
প্রতি কেজি আটার দাম আগের বছরের তুলনায় এখন ২১ শতাংশ বেশি। অথচ একই সময় মোটা চালের দাম প্রায় ৫ শতাংশ কমে গেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) বলছে, এ মৌসুমে বোরোর বিকল্প হিসেবে গমের আবাদ প্রায় ২৪ শতাংশ বেশি হয়েছে। পাশাপাশি ভুট্টাচাষও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়াবে। সরিষা এরই মধ্যে টার্গেট ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে এখন পর্যন্ত বোরোচাষ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩০ শতাংশ জমিতে।
বর্গাচাষি হজরত আলীর মতো ২৮ জেলার এক হাজার কৃষকের ওপর সম্প্রতি জরিপ চালায় বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক। এতে দেখা গেছে, কৃষকরা তাঁদের আবাদি জমির প্রায় ৮ শতাংশে এবার বোরোর পরিবর্তে অন্য ফসল ফলাবেন। সে ফসল হতে পারে গম, ভুট্টা, সরিষা অথবা পেঁয়াজ।
একদিকে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, অন্যদিকে ভালো দাম না মেলায় কৃষকরা ধানচাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। সারা দেশ থেকে কালের কণ্ঠের প্রতিবেদকদের পাঠানো প্রতিবেদন ও কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারের কৃষি বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণ করে একই রকমের তথ্য মিলেছে। দেখা গেছে, এবার ধানে আগ্রহ কমলেও কৃষকদের হাতে খুব বেশি বিকল্প নেই। কেউ কেউ কিছু জমিতে গম, ভুট্টা, সরিষা, সবজির চাষ করছেন। তবে সব জমিতে তা করা যাচ্ছে না। কারণ ওই সব বিকল্প ফসল আবাদে অপেক্ষাকৃত উঁচু জমি দরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের প্রধান খাদ্যশস্য ধান চাষে কৃষক আগ্রহ হারালে তা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেবে। ধানের ভালো দাম দিতে সরকারের যেকোনোভাবে একটি কৌশল বের করা উচিত।
আউশ, আমন ও বোরো মিলিয়ে দেশে বছরে প্রায় সোয়া তিন কোটি টন চাল উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে বোরো মৌসুমেই উৎপাদিত হয় প্রায় পৌনে দুই কোটি টন। ডিএইর হিসাবে, গত মৌসুমে এক কোটি ৮৭ লাখ ৫৯ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়েছে।
এ মৌসুমে গত ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৯ শতাংশ জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে, যা কাঙ্ক্ষিত হারের চেয়ে কম। ডিএইর কর্মকর্তারা মনে করেন, শীতের কারণে আবাদ কমেছে। এখন শীত চলে যাওয়ায় আবাদ পুরো দমে শুরু হবে। গত মৌসুমে ৪৮ লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিল। এ বছর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৭ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর, যা আগের বছরের চেয়ে ৩০ হাজার হেক্টর কম। তবে এ লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সরাসরি আবাদ ও উৎপাদন পর্যবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত ডিএইর মনিটরিং বিভাগের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ধানের দাম কম হওয়ায় এবার বোরোর আবাদ কম হবে। কিছু জমি গম, সরিষা, ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসল চাষে চলে গেছে।
ওই কর্মকর্তা আরো জানান, গত বছর গমচাষ হয়েছিল তিন লাখ ৫৮ হাজার হেক্টরে। এ বছর ওই ফসলটি তিন লাখ ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হবে বলে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল। তবে গত ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত হিসাবে চার লাখ ৪৩ হাজার হেক্টর জমিতে গমের আবাদ হয়েছে। আরো কিছু জমিতে এর আবাদ হতে পারে।
ডিএই সূত্রে আরো জানা যায়, ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সরিষার আবাদ হয়েছে পাঁচ লাখ ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৩৩ হাজার হেক্টর বেশি। অথচ লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার লাখ ৯০ হাজার হেক্টর। ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে ভুট্টা আবাদ হবে। এখন পর্যন্ত দুই লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে দুই লাখ পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে ভুট্টাচাষ হয়েছে।
বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার চামরুল ইউনিয়নের জোহালমাটাই গ্রামের প্রান্তিক কৃষক আক্কাস আলী (৫৫) বুঝিয়ে দিলেন কেন তিনি এবার বোরো ধান লাগাবেন না। তাঁর যুক্তি, ১ বিঘা জমিতে বোরো লাগালে বীজ, সার, সেচ, নিড়ানি, কাটা-মাড়াইসহ কীটনাশক বাবদ খরচ পড়বে প্রায় ১০ হাজার টাকা। ধান মিলবে বিঘায় সর্বোচ্চ ১৮ মণ। গত বছরের বাজার দর অনুসারে এই ১৮ মণ ধানের দাম দাঁড়ায় প্রতি মণ ৬০০ টাকা হিসাবে ১০ হাজার ৮০০ টাকা। আর একই জমিতে সরিষা ফলালে বিঘায় খরচ পড়বে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা। ফসল মিলবে সাত মণ। বাজারে বিক্রি করলে আসবে ১২ হাজার টাকা।
ব্র্যাকের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা বিভাগের কর্মসূচি প্রধান সুধীর কুমার নাথ কালের কণ্ঠকে বলেন, ব্র্যাকের এক হাজার কৃষকের ওপর করা জরিপে দেখা যায়, ৭.৮২ শতাংশ জমিতে এবার বোরোর পরিবর্তে অন্য ফসলের চাষ হবে। তবে পুরো দেশের বিষয়টি বিবেচনা করে বলা যায়, ধানের দামের ওঠা-নামার কারণে ৩ থেকে ৪ শতাংশ জমির আবাদ কম-বেশি হয়।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মীর্জা মোফাজ্জল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বোরো আবাদকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ, এটি আমাদের দেশের অন্যতম প্রধান ফসল। আমাদের দৃষ্টি এ জন্য বোরোর দিকে।' তিনি বলেন, 'ধানচাষ না হলে আমাদের দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে। দেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে ভালো জাতের বীজ সরবরাহ থেকে শুরু করে প্রয়োজনে বিদ্যুৎ, তেল, সেচ, সারসহ যাবতীয় সহায়তা দিয়ে কৃষককে সহযোগিতা করতে হবে।'
বগুড়ায় ভরা মৌসুমেও জমিতে ভিন্ন ফসল
মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত বোরো আবাদের সময়। সেই হিসেবে হাতে মাত্র দেড় মাস সময়। কিন্তু বৃহত্তর বগুড়ার অধিকাংশ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত আবাদ হয়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ জমিতে।
বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার জিয়ানগর ইউনিয়নের কৃষক মতলুব মিয়ার নিজের জমি আছে তিন বিঘা। গত বছর সেই জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন তিনি। জমি তৈরি থেকে শুরু করে সার, সেচ, কীটনাশক ও শ্রমিকের ব্যয় মিলে তাঁর খরচ পড়েছিল বিঘায় ১০ হাজার টাকা। ধান পেয়েছিলেন প্রতি বিঘায় ১৮ মণ করে। নিজেদের খাওয়ার জন্য এক বিঘার ধান রেখে তিনি অবশিষ্ট ধান বিক্রি করেন। বাজারে দাম দেখে গত বছর বস্তায় আগুন দেওয়ার ইচ্ছা হয়েছিল তাঁর। এ বছর তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এক বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করবেন, অন্য দুই বিঘায় করবেন সরিষার আবাদ।
সেচ পাম্পের মালিক ছানোয়ার হোসেন জানান, গত বছর ডিজেলের দাম কম থাকায় তিনি বোরোর একটি মৌসুমে প্রতি বিঘা জমিতে পানি দিতে দুই হাজার ৫০০ টাকা নিয়েছেন। এখন তেলের দাম বাড়ায় বাধ্য হয়েছেন সেটা চার হাজার করতে। কিন্তু এখন তাঁর কাছে কোনো কৃষক আসছেন না। তিনি মৌসুমের শুরু থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ২০ বিঘা জমির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন।
দেরিতে আবাদ হলেও বগুড়ায় বোরো উৎপাদনে সমস্যা হবে না উল্লেখ করে বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক বজলুর রশিদ জানান, বাজার থেকে উচ্চমূল্যে বীজ কেনার কারণে কৃষকের খরচ কিছুটা বেড়ে যাবে।
ঝিনাইদহে গম, ভুট্টা ও সবজির চাষ বেশি
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের শস্য সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ কৃষিবিদ আলিমুজ্জামান জানান, জেলায় এবার ৮৩ হাজার ৬৩৬ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। তবে ধানের দাম কম থাকায় কৃষকরা এবার অন্য ফসলে ঝুঁকছেন। ফলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, রোপা আমন মৌসুমে ধানের চাষ করে অধিকাংশ কৃষক লাভবান হতে পারেননি। অন্যান্য ফসল এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে। ভুট্টার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ হাজার ৯৭৪ হেক্টর। আবাদ হয়েছে ১৩ হাজার ৩৭০ হেক্টর। গম আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল পাঁচ হাজার ৮৯৬ হেক্টর, সেখানে হয়েছে সাত হাজার ২৫০ হেক্টর। সবজির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ হাজার ১৬০ হেক্টর, আবাদ হয়েছে ১০ হাজার ৬০৫ হেক্টর।
যাদবপুর গ্রামের কৃষক গোলাপ সর্দার বলেন, 'দুই বিঘা জমিতে রোপা আমন ধান লাগিয়ে খরচের টাকা পর্যন্ত ওঠেনি। এবার আমি শিম ও টমেটোর চাষ করেছি। তিন বিঘায় আবাদ করতে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ৭০ হাজার টাকার শিম ও টমেটো বিক্রি করেছি। এখনো বিক্রি করার মতো ২০ হাজার টাকার সবজি জমিতে আছে।'
বরিশালে জমি পতিত থাকার শঙ্কা
বরিশালের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বিভাগের ১১ জেলায় এবার তিন লাখ ৪৭ হাজার ৫০৩ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এ পর্যন্ত আবাদ হয়েছে এক লাখ ২০ হাজার ৩১৩ হেক্টরে। গত বছর এ সময় পর্যন্ত দুই লাখ ৪৮ হাজার ৫১৬ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিল। কৃষক ও ধান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে সবচেয়ে ভালো মানের প্রতি মণ ধানের দাম ৬০০ টাকা। প্রতি বিঘায় বোরো আবাদ করতে এখন ছয় হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতি বিঘায় ধান হয় ১৮ মণ। জমির মালিককে তিন ভাগের এক ভাগ দেওয়ার পর ধান থাকে ১২ মণ। সেই ধান বিক্রি করে সাত হাজার ২০০ টাকা পাওয়া যায়। তবে মজুরি খরচ হিসাব করলেও কৃষকের তেমন লাভ থাকে না।
বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার গাগুরিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম গাগুরিয়া গ্রামের সেচ ব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম জানান, বছর দুয়েক আগে একরপ্রতি পানি সেচের খরচ সর্বোচ্চ দুই হাজার ৫৫৮ টাকা ছিল। তিন দফা তেলের দাম বাড়ায় গত বছর একরপ্রতি খরচ পড়েছে প্রায় চার হাজার টাকা। ওই বছর দুটি ব্লকে ৫০ একর জমিতে অর্ধশতাধিক চাষি ছিলেন। এবার চাষির অভাবে ২৫ একরের একটি ব্লক বন্ধই রয়েছে। অন্যটিতে মাত্র ১৫ জন চাষি রয়েছেন।
কৃষি বিভাগ বলছে, শীতের কারণে আবাদে দেরি হচ্ছে। দুই সপ্তাহের মধ্যে কৃষকরা পুরোদমে আবাদে নেমে পড়বেন।
টাঙ্গাইলে জমি ফেরত দিচ্ছেন বর্গাচাষিরা
যেসব মালিক জমি বর্গা দিতেন তাঁরা পড়েছেন বেকায়দায়। কৃষক জমি ফেরত দিয়ে দিচ্ছেন। আবার নিজেরাও আবাদ করতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে অনেকে সার কিনে দিচ্ছেন, কেউ চারার দাম দিচ্ছেন, আবার কেউ হালের দাম দিচ্ছেন। জমির মালিক ও কৃষক উভয়কে বাড়তি খরচের ভাগ নিতে হচ্ছে।
ভূঞাপুর উপজেলার নিকলা গ্রামের বর্গাচাষি আয়নাল হক বলেন, 'প্রতি বিঘায় না হলেও চার-পাঁচ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হবে।'
জমির মালিক সুবীর কৃষ্ণ তালুকদার বলেন, 'সাত-আটজন বর্গাচাষি আমার প্রায় ১৫ বিঘা জমি ফেরত দিয়েছেন। চারার খরচ দিতে চাইলেও তাঁরা জমি চাষ করতে রাজি হচ্ছেন না। এ অবস্থায় জমি ফেলে রাখা ছাড়া তো আর কোনো উপায় দেখছি না।'

প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কালের কণ্ঠের বরিশালের ব্যুরো প্রধান রফিকুল ইসলাম, বগুড়ার নিজস্ব প্রতিবেদক লিমন বাসার, ঝিনাইদহ প্রতিনিধি এম. সাইফুল মাবুদ ও টাঙ্গাইল প্রতিনিধি অরণ্য ইমতিয়াজ।
চাষ কম, সারের চাহিদাও কম

No comments

Powered by Blogger.