চিম্বুক পাহাড়ের ১৩ শিশু রক্ষা পেল নিজেদের বুদ্ধিতে-ছয় শিশুর পাচার রুখল ঢাবি ছাত্ররা by বিপ্লব রহমান

বান্দরবানের দুর্গম চিম্বুক পাহাড় থেকে ১৯ ত্রিপুরাভাষী শিশুকে পিরোজপুরের একটি মাদ্রাসায় পাঠানোর উদ্দেশ্যে গতকাল রবিবার ঢাকায় নিয়ে আসা হচ্ছিল। মিশনারি স্কুলে ভর্তির কথা বলে পাহাড়ি যে ব্যক্তিটি তাদের নিয়ে আসছিল, তার কথাবার্তায় ও আচরণে সন্দেহ হওয়ায় ১৩ শিশু রাতে চট্টগ্রামে বাস থামার সুযোগে পালিয়ে যায়।
খবর পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পাহাড়ি ছাত্ররা ঢাকার একটি বাস কাউন্টারে বসে থেকে বাকি ছয় শিশুকে উদ্ধার করেছেন। সন্দেহভাজন পাচারকারীকেও তাঁরা আটক করেছেন। শিশুদের বয়স পাঁচ থেকে ১২ বছর এবং সবাই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, উদ্ধার করা পাহাড়ি শিশুদের সবারই বাড়ি বান্দরবান জেলার চিম্বুক পাহাড়ের দুর্গম টংকাবতীর ইম্মানুয়েল ত্রিপুরাপাড়ায়। তারা হলো নতেরাং (৫), আমিগতি (৫), খনথাইমা (১২), হামথৈ (৮), পিতর (১২), সিমন (৮) ও কনথাইমা (১২)। প্রথম তিনটি শিশু মেয়ে। উদ্ধার পাওয়া শিশুরা কালের কণ্ঠকে জানিয়েছে, মিশনারি স্কুলে দেওয়ার কথা বলে মা-বাবার কাছ থেকে তাদের ঢাকায় নিয়ে আসা হচ্ছিল। কিন্তু তাদের নিয়ে আসা ব্যক্তি বিনয় ত্রিপুরার (৩৫) আচরণে সন্দেহ হওয়ায় সঙ্গে থাকা বাকিরা বাস থামলে পালিয়ে যায়।
এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক শক্তিপদ ত্রিপুরা কালের কণ্ঠকে বলেন, একটি সংঘবদ্ধ চক্র ওই ১৯ শিশুকে তাদের হতদরিদ্র জুমচাষি (পাহাড়ের ঢালে বিশেষ ধরনের চাষাবাদ) মা-বাবাকে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন মাদ্রাসায় ভর্তির জন্য ঢাকায় নিয়ে আসছিল। তাদের মধ্যে ১৩ শিশু গত রাতে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে থেকে পালাতে সক্ষম হয়। পরে খবর পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড়ি ছাত্ররা বাকি ছয় শিশুকে উদ্ধার এবং অভিযুক্ত একজন পাচারকারীকে আটক করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, শিশুদের বিভিন্ন মাদ্রাসায় পাঠিয়ে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করা হচ্ছিল।
প্রসঙ্গত, গত ২ জানুয়ারি পুলিশ ও র‌্যাব ২১ আদিবাসী শিশুকে ঢাকার পাঁচটি মাদ্রাসা ও ইসলামী সংস্থা থেকে উদ্ধার করে। সেখানে তাদের ধর্মান্তরিত করে নতুন নাম দেওয়া হয়েছিল। পরে তাদের অভিভাবকের কাছে ফেরত পাঠানো হয়। ওই ২১ শিশুও ত্রিপুরাভাষী। তাদের রাঙামাটির বিলাইছড়ির দুর্গম ফারুয়া থেকে ঢাকায় আনা হয়েছিল। পরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং আদিবাসী ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের সহায়তায় তাদের গ্রামের বাড়িতে নিজ নিজ পরিবারের কাছে ফেরত পাঠানো হয়।
গতকাল ছয় শিশুকে উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রিপুরা স্টুডেন্ট ফোরাম ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কর্মীরা। তাঁরা কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, পাচারকারী সন্দেহে আটক বিনয় ত্রিপুরা গত রাতে শ্যামলী পরিবহনের বাসে ১৯ শিশুকে ঢাকায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছিল। পথিমধ্যে হাটহাজারীতে যাত্রাবিরতি হলে বিনয় তাদের একটি খাবারের হোটেলে বসিয়ে প্রাতঃকৃত্য সারতে যায়। তার আচরণে সন্দিহান ১৩ শিশু সেখান থেকে পালিয়ে একটি দোকানের মোবাইল ফোনে তাদের অভিভাবকদের কাছে খবর পাঠায়। অভিভাবকরা বাকি ছয় শিশুকে উদ্ধার করার জন্য খবর পাঠান পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কর্মীদের কাছে। গতকাল ভোর থেকেই তাঁরা ফকিরাপুল বাসস্ট্যান্ডের শ্যামলী পরিবহনের বাস কাউন্টারে অপেক্ষায় থাকেন। বাস সেখানে পৌঁছামাত্র তাঁরা উদ্ধার করেন ছয় শিশুকে এবং আটক করেন বিনয়কে।
মনোবিজ্ঞান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র এবং উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া নিপন ত্রিপুরা কালের কণ্ঠকে জানান, উদ্ধার করা শিশুরা কেউই বাংলা ভাষা বোঝে না। তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, বিনয় তাদের মিশনারি স্কুলে ভর্তি করার কথা বলে ঢাকায় নিয়ে এসেছে। সেখানে তাদের ছাত্রাবাসে থেকে লেখাপড়া করার কথা ছিল। নিপন বলেন, 'অভিযুক্ত বিনয় ত্রিপুরার ব্যাগ তল্লাশি করে তার কাছ থেকে পিরোজপুরের এফ করিম আমিন মাদ্রাসার কিছু কাগজপত্র পাওয়া গেছে।'
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কর্মীরা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে বিনয় স্বীকার করেছে, মিশনারি স্কুল বোর্ডিংয়ে ভর্তি করার মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে এসব শিশুকে সে পাহাড়ি গ্রাম থেকে এনেছিল। এ জন্য সে অভিভাবকদের কাছ থেকে প্রত্যেক শিশুর জন্য ১৫ হাজার করে টাকাও নিয়েছে। এ কাজে পিরোজপুর মাদ্রাসার জনৈক রেজোয়ান তাকে সহায়তা করছেন।
রাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত একটি মানবাধিকার সংস্থার মাধ্যমে উদ্ধার করা শিশুদের বান্দরবানে অভিভাবকদের কাছে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ চলছিল। শিশুদের অভিভাবকদের ঢাকায় আসার জন্য খবর দেওয়া হয়েছে। তারা আজ সোমবার ঢাকায় এসে পৌঁছালে আটককৃত বিনয় ত্রিপুরাকে পুলিশে সোপর্দ করা হবে। অভিভাবকরা তার বিরুদ্ধে প্রতারণা ও শিশুপাচারের চেষ্টার অভিযোগ এনে থানায় মামলা করবেন।

No comments

Powered by Blogger.