ভিন্নমত-শেয়ারবাজারকে উঠাতে হবে কেন? by আবু আহমেদ

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ার মূল্যের নতুন সূচক তৈরি করেছে। নাম দিয়েছে DSE-30। এই ৩০ কম্পানিকে নাকি বাছাই করা হয়েছে এগুলোর ইক্যুইটি তথা ক্যাপিটাল ভিত্তি আর গত কয়েক মাসের লেনদেনের পরিমাণ বিবেচনা করে।
অর্থাৎ মূল সূচকে এসেছে মূলধনের আকারে বড় কম্পানিগুলো এবং লেনদেনের ক্ষেত্রেও যারা প্রথমে আছে। হতে পারে এটাও একটা সূচক। তবে এই সূচক দ্বারা বাজারসংশ্লিষ্টদের কী সংকেত দেওয়া হলো? এই কম্পানিতে তো এমন কম্পানিও আছে, যেগুলো বছরের পর বছর কোনো মুনাফা দিতে পারেনি বলে রেগুলেটর SEC-র নির্দেশ অনুসারে খারাপ শ্রেণীর কম্পানি তথা 'Z' শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এমন কম্পানিকে কেন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ভাষ্য অনুযায়ী, এত গুরুত্বপূর্ণ সূচকে অন্তর্ভুক্ত করে নিতে হবে? আবার DSE-30-এ এমন কম্পানিও এসে গেছে, যে কম্পানির বিরুদ্ধে এই কিছুদিন আগেও স্বয়ং SEC জালিয়াতি আর ধোঁকাবাজির অভিযোগ এনেছিল। আর ক্যাপিটাল বেইজ তথা ঝুঁকির আকারের কথা বলছেন, অনেক কম্পানিই তো ব্যবসা বাদে ঝুঁকির আকার বাড়িয়েছে ফি বছর বোনাস শেয়ার ইস্যু করে। আর বোনাস শেয়ার ইস্যু করেছে কম্পানির উদ্যোক্তাদের স্বার্থে নয়, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে? আসলে ২০০৯-২০১১ পর্যন্ত, বিশেষ করে ২০১০-এ শেয়ারবাজারে যে হরিলুটের যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়েছে, ওই হরিলুট কেন হলো, কিভাবে হলো- এসবের সঠিক কারণ ও অবস্থা হৃদয়ঙ্গম না করলে বারবার শেয়ারবাজারকে ওপরে উঠিয়ে একই হরিলুটের জন্য ক্ষেত্রগুলো শুধু বারবার তৈরি করা হবে। আজকে বলা হচ্ছে, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো দেওয়া ঋণের জাল থেকে বের হতে পারছে না। কেন তারা জালে আটকা পড়ল? তারা তো নিজেরাই নিজেদের জন্য ২০১০-এ সে জাল তৈরি করেছিল। আর তারা যদি বুঝতে অক্ষম হয় যে তারা জালে আটকা পড়ছে না, তাহলে বলব, তাদের পেশাদারিতে দারুণ ঘাটতি রয়েছে। তাদের তো লাইসেন্স দেওয়াই ঠিক হয়নি। একই কথা খাটে যেসব ব্রোকার ব্যাংক থেকে ঋণ এনে উচ্চ সুদে তাদের নিজস্ব গ্রাহকদের কাছে সে ঋণকে পুনর্বিক্রয় করেছে। সেই দিন তো তারা দুই দিকেই লাভ দেখেছে। এক. ঋণ বিক্রি থেকে সুদ আর দুই. ঋণের মাধ্যমে বেশি কেনাবেচা থেকে কমিশন আয়। কে বলেছিল ২০০৯ ও ২০১০-এর সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যবসা সামনেও চলতে থাকবে? মার্চেন্ট ব্যাংক ও ঋণবিক্রেতা ব্রোকারেজ হাউস কি এক দিনে অনেক লাভ করল? কিন্তু এসব বিনিয়োগকারী কি লাভ করেছে, যাদের কাছে মার্জিন ঋণের নামে সেই ঋণগুলো বিক্রি করা হয়েছিল? ওসব ঋণক্রেতা বিনিয়োগকারীই সম্পূর্ণভাবে তাঁদের পুঁজি হারিয়েছেন। তাঁদের বাজারে আনার কোনো উপায় আছে কী? আজকে মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোও প্রায় অকেজো। IPO থেকে এত Placement শেয়ার পেয়েও তারা লাভের মুখ দেখছে না। তাদের থেকে যারা কথিত নিরাপদ ভেবে ইউনিট কিনেছে, তারাও বোধ করি বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে অন্যতম। মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোকে বাঁচানোর জন্য SEC সম্প্রতি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগকারীরাই ফান্ড ম্যানেজারদের কাছ থেকে নগদ মুনাফা না নিয়ে বোনাস ইউনিটও নিতে পারবে বলে অনুমতি দিয়েছে। এই অনুমতি হলো SEC-এর অজ্ঞতার একটি বড় উদাহরণ। যারা লাভই পাবে না, তারা বোনাস ইউনিট দিয়ে কী করবে? যা হোক, অন্য কথায় আসি। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে শেয়ারবাজারকে বর্তমানের মন্দা বা মরা ভাব থেকে ওপরে ওঠানোর জন্য। এই লক্ষ্যে জ্ঞানী ব্যক্তিদের দিয়ে মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে। কিন্তু যে কারণে ২০১১ ও ২০১২ সালে শেয়ারবাজার কথিত মন্দায় পড়েছে, সে কারণগুলো কে দূর করবে? DSE এর হাতে কি উদার মুদ্রানীতি ঘোষণার বা কার্যকর করার ক্ষমতা আছে? যেটুকু ছাড় দেওয়া হয়েছে বলে নতুন মুদ্রানীতি দাবি করেছে, তাতে তারল্য প্রবাহে তেমন কোনো হেরফের হবে না। আর শেয়ারবাজার ওপরে উঠলে কার বেশি লাভ? নিশ্চয়ই আজও যারা SEC-এর অনুমতি নিয়ে উঁচু প্রিমিয়ামে IPO বিক্রি করছে, তাদের। সত্য হলো, বাজার যত উঠবে, ততই SEC আরো বেশি মূল্যে IPO বিক্রি করতে অনুমোদন দেবে, ততই কম্পানি বা IPO বিক্রেতারা বেশি লাভবান হবে, আর ততই বেশি অতি সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ২০১০ সালে যারা IPO বিক্রি করেছে, বর্তমান বাজারে সেসব শেয়ারের ৬০-৭০ শতাংশ মূল্য নেই। কেন এটা হবে? সে জন্যই বলছিলাম আগে IPO মূল্যের উচ্চ প্রিমিয়াম থামান। তারপর কিছু করলে করবেন।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.