হত্যার জন্য আত্মহত্যা by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

আত্মঘাতী সন্ত্রাসীকর্ম একটি অস্বাভাবিক ব্যাপার। রোগে-শোকে-দুঃখে আত্মসম্মান বাঁচাতে বা মর্যাদাহানিতে মর্মবেদনায় মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে। সম্রাটের মর্যাদা রক্ষায় জাপানি কামিকাজে পাইলটরা নিজের জীবন উৎসর্গ করে টার্গেটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন।
সাহসী সামুরাইরা আত্মসম্মানের জন্য হারাকিরি করতেন। দক্ষিণ এশিয়ায় সম্ভ্রান্ত মহিলারা আত্মসম্মানহানির ভয়ে জওহরব্রত করতেন। বাংলাদেশে হিন্দু বিধবা রমণীরা এক সময় সতীদাহে নিজেকে উৎসর্গ করতেন।
আত্মঘাতী সন্ত্রাসে দুটি বিষয় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ- পূর্বনির্ধারিত ফলাফল অর্জনের জন্য হত্যা, আঘাত, ক্ষতিসাধন বা ভয় প্রদর্শনের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করার ব্যাপারটা মূলত একজনের ব্যক্তিগত ব্যাপার। সম্প্রতি আত্মঘাতী সন্ত্রাস আর কোনো ব্যক্তিগত সাহসিকতার ব্যাপার নয়। এই ব্যক্তিগত প্রয়াসের সঙ্গে সাংগঠনিক তৎপরতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাণোৎসর্গ যেন সাফল্যের সঙ্গে লক্ষ্য অর্জন করতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এর জন্য প্রতিপক্ষকে সৃষ্টিকর্তার শত্রু ও হননযোগ্য হিসেবে গণ্য করতে হবে। অন্যদিকে প্রাণদানকারী যেন ইহজগতে বড় সুনাম ও প্রশংসা অর্জন করতে পারে, তার জন্য প্রয়োজনে ফিল্ম তৈরি করতে হবে এবং প্রচারণা করতে হবে ও পরকালে জান্নাত লাভের ব্যাপারটা প্রায় নিশ্চিত বলে উপস্থিত করা হবে।
বয়ঃসন্ধিকালে যুবকদের বিভাময় নেতা-কর্মীরা দীক্ষা দিয়ে থাকে। বয়ঃসন্ধিকাল থেকে সাবালকত্বে পৌঁছতে স্বাধীনতাবিলাসী মানুষ বিদ্রোহীও বটে। যৌবনে টেস্টোস্টেরন হরমোনের প্রভাবে প্রাধান্য বিস্তারে ইচ্ছা ও আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ডের প্রতি একটা নেশা জন্মায়। রাজনৈতিক নিপীড়ন বা জাতীয় অসম্ভ্রমের ঘটনায় সংবেদনশীল উত্তেজিত ব্যক্তি দুঃসাহসিক কর্মের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে।
আত্মঘাতী হত্যাকাণ্ড একটা বেপরোয়া ব্যাপার। এর দ্বারা যারা আত্মহত্যা করে, তারা এক প্রতিবাদের বাণী লোকের কাছে পৌঁছাতে চায়। এর মধ্যে প্রতিহিংসারও একটা ব্যাপার থাকে। ৫০ বছরের অধিককাল ধরে ইসরায়েল প্রতিটি ইহুদি নাগরিকের প্রাণনাশের বদলার জন্য ১০ জন আরবকে হত্যা করার দর্শন অনুসরণ করার চেষ্টা করে আসছে।
১৯৬৩ সালের ১১ জুন ভিক্ষু কোয়াং দুক (১৮৯৭-১৯৬৩) ক্যাথলিক এনগো দিনহ্ দিয়েমের যখন দক্ষিণ ভিয়েতনাম সরকারের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে আত্মদহনে আত্মহত্যা করেন, তখন সেই ঘটনা সাংবাদিকের ফটোয় ধৃত হলে ব্যাপারটি সারা বিশ্বের নজরে পড়ে। ফটোগ্রাফার ম্যালকম ব্রাউন সেই ফটোর জন্য পুলিৎজার পুরস্কার পান। ভিক্ষুদের ধর্মীয় নেতা থিচ থিয়েন মিন্হ এই আত্মহননের পথ বেছে না নেওয়ার জন্য সবাইকে অনুরোধ করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বৌদ্ধদের আত্মহননকে 'বেপরোয়া কাণ্ড' বলে অভিহিত করেন। তবে বৌদ্ধদের কাছে ওই আত্মহত্যা করুণার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয় এবং আত্মদহনে আত্মহত্যাকারী বোধিস্বত্বের মর্যাদা লাভ করে। একাধিক বৌদ্ধ ভিক্ষু থিচ কোয়াং দুকের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আত্মদহনে প্রাণ উৎসর্গ করেন। দক্ষিণ ভিয়েতনাম সরকারপ্রধানের ভ্রাতৃবধূ মাদাম এনহু ব্যাপারটাকে উপহাস করে 'বারবেক্যু' বলেন এবং পরবর্তী ঘটনায় তিনি নিজেই আগুন দিতে রাজি হবেন বলে আদিখ্যেতা করেন। পরে সরকারপ্রধান দিয়েম ও তাঁর ভাই গোয়েন্দাপ্রধান এনহু আততায়ীর হাতে মারা যান।
ভিয়েতনামে আত্মহননকারীদের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করতে গিয়ে ১৯৬৫ সালের ৩ নভেম্বর কোয়েকার নরম্যান আর মরিসন (১৯৩৩-১৯৬৫) পেন্টাগনের সামনে আত্মদহনে প্রাণ উৎসর্গ করেন। উভয় মৃত্যুই ভিয়েতনামের রাজনৈতিক সংকটে কোনো সমাধান দেয়নি।
সন্ত্রাসী আত্মহত্যায় অন্য পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণনাশ ও ধ্বংস সাধনের লক্ষ্য থাকে। সন্ত্রাসী আত্মহত্যা সাধারণত পুরুষ মানুষ করে থাকে; তবে মহিলা আত্মঘাতীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঊনবিংশ শতাব্দীতেও দেখা গেছে। ১৯৮৫ সালে লেবাননে আত্মঘাতী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সানা মেখাইদালির আবির্ভাবের পর নারী আত্মঘাতী সন্ত্রাসীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে রাশিয়ায় চেচেন বিচ্ছিন্নতাবাদী, উজবেকিস্তানের ইসলামী আন্দোলন, ফিলিস্তিনের হামাস ও ফাতাহ, লেবাননের সিরীয় সমাজতন্ত্রী জাতীয়তাবাদী দল, কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি এবং শ্রীলঙ্কার তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের ২০০৮ সালের রিপোর্টে দেখা গেছে, বিশ্বে ৯ শতাংশ আত্মঘাতী হামলাকারী হলো নারী এবং ইরাকে যাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ১৫ শতাংশ মহিলা। সন্ত্রাসকর্মে মহিলাদের কিছু সুবিধা আছে। তাঁদের দেহ তল্লাশি পুঙ্খানুপুঙ্খ নাও হতে পারে। গর্ভবতী সেজে বিস্ফোরক দ্রব্য সহজে লুকাতে পারেন। মহিলা আত্মঘাতীদের কর্মকাণ্ড তুলনামূলকভাবে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের ওপর প্রচারের একটা দাম রয়েছে।
১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে মিসরের মুফতিরা মিসরের প্রেসিডেন্ট আনওয়ার সাদাত ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনের মধ্যকার ক্যাম্পডেভিড মতৈক্যকে জায়েজ বলে বিবেচনা করার চেষ্টা করেন। সেই সময় একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আবদাল-সালাম ফারাজ চতুর্দশ শতাব্দীর ইবনে তাইমিয়ার ওপর ভিত্তি করে তাঁর 'অবহেলিত কর্তব্য' গ্রন্থে জিহাদের নতুন ব্যাখ্যা দেন। মঙ্গোল আক্রমণের পর মুসলমানদের মধ্যে প্রশ্ন ওঠে, যেখানে একজন মুসলমান শাসক মঙ্গোল শাসককে কর দান করে, তাঁর অধীনে বাস করা যায় কি না। এমন প্রশ্নে ইবনে তাইমিয়া উত্তর দেন যে ওই বাসস্থান বায়তুল আমান নয়, বায়তুল হারবও নয়; বরং এক মুরাক্কাব বা মিশ্রণ এবং যিনি ধর্ম পালন করতে পারছেন না, তিনি হিজরত করতে পারেন। ইঞ্জিনিয়ার ফারাজের মতে, মিসরের অবস্থা ছিল অনুরূপ। তবে তিনি জামায়াত আল জিহাদের সদস্য হিসেবে হিজরতের পরিবর্তে এমন বে-শরা শাসককে খতম করা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত কতর্ব্য বলে মনে করেন।
১৯৮১ সালের ৩ অক্টোবর এক সেনা কুচকাওয়াজের সময় ফারাজের চার অনুসারী মঞ্চের দিকে গ্রেনেড ছোড়ে। ২৬ বছরের তরুণ খালিজ ইসলামধর্মী প্রেসিডেন্ট সাদাতকে লক্ষ্য করে কালাশনিকভ থেকে গুলি ছোড়ে চিৎকার করে বলে, 'আমি ফেরাউনকে খতম করেছি, আমি মৃত্যুকে ভয় করি না।' কয়েক মাসের মধ্যে ফারাজ ও তার অনুসারীদের ফাঁসি হয়। ১৯৮২ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডের ২০০ জনের বিচারের সময় সবচেয়ে বাগ্মী আসামি ছিলেন আয়মান আল-জাওয়াহিরি।
ইসলাম ধর্মে জিহাদিরা বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ দেবেন এমন আদর্শ ইসলামে নতুন বা একক নয়। আত্মহত্যার বিরুদ্ধে কোরআনের আদেশকে শিয়া পণ্ডিতরা আত্মঘাতী হামলা বলে আত্মহত্যা হিসেবে গণ্য করলেন না।
ফিলিস্তিনি আবদুল্লাহ আযম তাঁর 'মুসলিম ভূমির প্রতিরক্ষায়' গ্রন্থে ইবনে তাইমিয়ার মন্তব্যের ওপর ভিত্তি করে সব মুসলমানকে ডাক দিলেন জিহাদের জন্য। ক্রুসেডের সময় থেকে মুসলমানজগতে ফতোয়া দেওয়া হয়, একজন মুসলমানের প্রতিরক্ষায় আরেকজন মুসলমান সাহায্য করবে। কিন্তু সেই সাহায্য করতে হবে আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, মিসর, সুদান, উত্তর আফ্রিকা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার পর্যন্ত- বিশ্বজুড়ে সর্বত্র! সে তো এক অভিনব ব্যাপার বটে।
মুসলমানদের জন্য আত্মহত্যা যে নিন্দনীয় কোরআন শরিফের তিনটি সুরায় সে কথা বলা হয়েছে। সুরা বাকারার ১৯৫ আয়াতে বলা হয়েছে, 'তোমরা নিজেরা নিজেদের সর্বনাশ করো না।' সুরা নিসার ২৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, 'আর তোমরা নিজেদের হত্যা করো না, আল্লাহ তো তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু।' সুরা নাহলের ৬১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, 'আল্লাহ যদি মানুষকে তাদের সীমা লঙ্ঘনের জন্য শাস্তি দিতেন, তবে পৃথিবীতে কোনো জীবজন্তুকে রেহাই দিতেন না; কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত তাদের অবকাশ দিয়ে থাকেন। তারপর যখন তাদের সময় আসে তখন তারা মুহূর্তকাল দেরি বা তাড়াহুড়ো করতে পারে না।'
১৯৮০-এর দশকে আফগানিস্তান-সংকট সহস্র সহস্র জিহাদিকে আকর্ষণ করে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিরোধে লেবাননে বিস্তার লাভ করে, যখন ১৯৮২ সালের গ্রীষ্মে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের জব্দ করার জন্য উত্তরের দিকে আগ্রাসী হয়ে বৈরুতে বোমা বর্ষণ করে। ১৯৮৩ সালের ২৩ অক্টোবর একজন শিয়া মিলিশিয়া দুটি বিস্ফোরক-বোঝাই ট্রাক নিয়ে বৈরুত সেনানিবাসে আঘাত হানলে ৩০০ মার্কিন ও ফরাসি সেনা নিহত হয়। চমকপ্রদ এই দুই আত্মঘাতী হামলাকে আলী ও হাসানের শাহাদাতের পথানুসারী শিয়াদের শাহাদাত-প্রশংসার অংশ হিসেবে গণ্য করে। একাদশ শতাব্দীর অ্যাসাসিনরা ছাড়া শিয়াদের মধ্যে আত্মঘাতী হামলাকে ইমানের তেমন অংশ হিসেবে গণ্য করা হতো না। এই হামলার নতুনত্বে সবাই চমকে ওঠে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী আইজাক রাবিন বলেন, '২০ বছরেও কোনো পিএলও সন্ত্রাসী নিজেকে জীবন্ত বোমা হিসেবে ব্যবহার করেনি।' ১৯৮৩ সালের আগে এই মানববোমার নজির না থাকলেও এর পর থেকে লেবাননের কিছু শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষ করে হিজবুল্লাহ (আল্লাহর দল) অনুসারীদের মতে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
১৯৯১ সালে বিস্ফোরকভর্তি জামা পরে শ্রীলঙ্কার তামিল টাইগাররা ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধীকে হত্যা করে।
মানুষের মৃত্যুর সময় কেবল আল্লাহই জানেন। কোরআনের বিভিন্ন সুরা থেকে এটা পরিষ্কার যে আত্মহত্যা একটা পাপ এবং এর জন্য কঠিন শাস্তি রয়েছে। যে অস্ত্র দ্বারা লোকে আত্মহত্যা করে কিয়ামতের দিনে সেই অস্ত্র দিয়ে আত্মঘাতীকে শাস্তি দেওয়ার কথা। জাহান্নামের ভয়ের কথা বলা হলেও বিস্ফোরণকারী পাপীদের পক্ষে কিছু কিছু ধর্মীয় নেতা সমর্থন জানান। ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমেনি নাকি ১৯৮৩ সালের বিস্ফোরণকে ব্যক্তিগতভাবে অনুমোদন করেন এবং অন্য শিয়া পণ্ডিতরা পরে তাঁকে এ বিষয়ে অনুসরণ করেন। লেবাননের আয়াতুল্লাহ ফজলুল্লাহ প্রথমে আত্মঘাতী হামলার সমর্থন না করলেও পরে তিনি যুক্তি দেখান শক্তির অসমতায় দুর্বলের পক্ষে নিজের শরীরকে ব্যবহার করা যায়। হিজবুল্লাহর
দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি শেখ নাঈম কাসেম মনে করেন, আল্লাহর পূর্বনির্ধারিত মৃত্যুর দিনক্ষণে কোনো ব্যত্যয় ঘটে না আত্মঘাতী হামলায়। আত্মঘাতীর মৃত্যুর ক্ষণটিকেও আল্লাহর পূর্বনির্ধারিত বলে বিবেচনা করতে হবে।
সাম্প্রতিক জঙ্গি সন্ত্রাসবাদী তৎপরতায় আমরা কি ভুলে যাব কোরআনের ৫ সুরা মায়িদার ৩২ আয়াতে বর্ণিত সেই বাণীর কথা : "নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্য করা হেতু ব্যতীত কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষকেই হত্যা করল, আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষের জান রক্ষা করল।"
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.