একুশের স্মৃতি by মো. ফখরুদ দওলা

এক মায়ের পেটে জন্ম না নিলেও সেদিন বুঝেছিলাম ভাই হারানোর বেদনা_ কত যন্ত্রণাময় হতে পারে। সিলেটে আন্দোলনরত সবাই কেঁদেছি। আজকের মতো প্রযুক্তির যোগাযোগ না থাকায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের কথা জানি ২২ ফেব্রুয়ারি ভোরে।
ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে ঢাকার রাজপথ_ এ খবর পেয়ে দ্রুত সংঘবদ্ধ হই। সে ঘটনার প্রতিবাদে সিলেটে আন্দোলন করি, মিছিল-সমাবেশ করি।
সিলেট সরকারি পাইলট স্কুলের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে আন্দোলনে যোগ দেয়। সেদিন আমার সঙ্গে আলমপুরের মোহাম্মদ বখ্তসহ অনেকেই ছিল। সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা হাজেরা মাহমুদ আন্দোলন সফল করার জন্য সহযোগিতা করেন। তিনি মেডিকেল কলেজের মহিলা হোস্টেলে গিয়ে মেয়েদের ক্লাস বর্জন এবং রাজপথে নেমে ছেলেদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য উৎসাহ জোগান। তার উৎসাহ পেয়ে রক্ষণশীলতার দেয়াল ভেঙে মেয়েরাও সিলেটের রাজপথে নামে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি নিয়ে।
১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সিলেটে আমরা হরতাল পালন করেছি। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আমাদের মিছিল জনসমুদ্রে রূপ নেয়। মিছিল শেষে সভা করি। আন্দোলনের জোয়ার দেখে পুলিশ বাধা দেবে কি! আমাদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেকেছে। কোনো হামলা না হলেও পরিস্থিতি ছিল উত্তপ্ত।
ভাষা আন্দোলনে ২২ ফেব্রুয়ারি আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দেন ছাত্রলীগের তারা মিয়া, তার বাড়ি বিয়ানীবাজার উপজেলার কাঁকরদিয়া গ্রামে। এ ছাড়া দেওয়ান ফরিজ গাজী, পীর হাবিবুর রহমানসহ অনেক তরুণ ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আমাদের এ আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করে মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশে উপস্থিত থেকে সাহস জুগিয়েছেন। তাদের সরব উপস্থিতি আমাদের আন্দোলনকে গতিশীল করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মোয়াজ্জেম হোসেন ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে আমাদের মিছিল-পরবর্তী সভায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও রক্তাক্ত রাজপথের বর্ণনা দেন। শহরের গোবিন্দচরণ পার্কে (বর্তমান হাছান মার্কেট) রাষ্ট্রভাষার দাবি নিয়ে অনুষ্ঠিত সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন দেওয়ান আজরফ, দেওয়ান অলিউর রহমান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক ছাত্র যার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় বাড়ি (নাম মনে নেই)।
সভা শেষ হলে আমরা আবার মিছিল বের করি। বিশাল মিছিল নিয়ে আমরা আম্বরখানার দিকে অগ্রসর হই। মিছিলে 'নূরুল আমীন (পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী) গদি ছাড়ো..., রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই... রফিক-শফিকের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না'_ আমাদের এ রকম অসংখ্য স্লোগানে রাজপথ কেঁপে ওঠে।
আমরা যারা ভাষা আন্দোলনে ছিলাম, সেদিন কোনো কমিটি করিনি। ভাষা আন্দোলনের পর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অনেক রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন পর এখন অনেকেই নিজেকে ভাষাসংগ্রামী বলে দাবি করেন। ভাষা আন্দোলনে সিলেটের প্রেক্ষাপট নিয়ে আজকাল বিভিন্ন সাক্ষাৎকার এবং বইয়ে অনেক কমিটির কথা উল্লেখ দেখি_ এসব ভুয়া। নিজেকে জাহির করার জন্য এ রকম হীন, মিথ্যা ইতিহাস তৈরি করে কতিপয় ব্যক্তি সমাজে নিজেদের অবস্থান পাকা করতে সচেষ্ট রয়েছে।

মো. ফখরুদ দওলা :মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষাসৈনিক, বিয়ানীবাজার, সিলেট

No comments

Powered by Blogger.