আইলা দুর্গতদের পাশে দাঁড়াব ॥ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক- সাতৰীরার দুর্গতদের আশ্বাস ॥ চৌগাছায় সরকারের কর্মকাণ্ড দেখে খুশির কথা শোনালেন চ্যান

১১ মাসেও ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে বিধ্বস্ত সাতৰীরার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। বিশাল এলাকাজুড়ে আইলার ধ্বংসযজ্ঞের ৰত এখনও বইয়ে বেড়াচ্ছেন এ এলাকার লাখো মানুষ।
বিধ্বস্ত জনপদে এখনও ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ে আছে ভাঙ্গা ঘর, গাছ-পালা, ধানের গোলা, নৌকা ও লাঙ্গল। বিস্তীর্ণ জলরাশির মাঝখানে কঙ্কালসারে পরিণত হওয়া এ জনপদের কোথাও আংশিক, কোথাও পরিপূর্ণ বিধ্বস্ত। ঘর-বাড়িসহ সবকিছু হারিয়ে বেড়িবাঁধের ওপর ঠাঁই নেয়া লাখো মানুষ লোনা পানির সঙ্গে লড়াই করছে প্রতিনিয়ত। এক বছর হতে চলল, এখনও আইলাবিধ্বসত্ম অধিকাংষ মানুষ ঘরে ফিরতে পারেনি। আইলার ছোবলে বিরাণভূমিতে পরিণত হওয়া বিস্তীর্ণ জনপদ ও দুর্গত মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ সোমবার নিজচৰে অবলোকন করে আবেগাপস্নুত হয়ে পড়েন বাংলাদেশ সফররত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক ড. মার্গারেট চ্যান।
খুব নিচ থেকে হেলিকপ্টারযোগে প্রায় ৩০ মিনিট সাতৰীরার আইলাবিধ্বসত্ম এলাকা পরিদর্শন শেষে আশাশুনি প্রতাপনগর হাইস্কুল মাঠে নেমেই দুর্গত এই এলাকার হাজার হাজার মানুষকে আশ্বসত্ম করে হু'র মহাপরিচালক ঘোষণা দেন- "আইলাদুর্গত এলাকা পুনর্গঠনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পাশে দাঁড়াবে। শুধু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাই নয়; কথা দিচ্ছি- বিশ্বের উন্নয়ন সহযোগী ও দাতাদেশগুলোও যাতে এগিয়ে আসে সে চেষ্টা চালিয়ে যাব।" এর পর স্পীডবোটে দুর্গত এলাকা ঘুরে দেখেন তিনি। গত ১৭ বছরে এটাই ছিল প্রথম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোন মহাপরিচালকের আনুষ্ঠানিক বাংলাদেশ সফর। আইলাবিধ্বসত্ম জনপদের করম্নণ চিত্র দেখে আবেগে জড়িয়ে পড়লেও যশোরের চৌগাছার প্রত্যনত্ম অঞ্চলে কমিউনিটি কিনিক ও উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে জনগণের দোরগড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে সরকারের আনত্মরিক প্রচেষ্টার কর্মতৎপরতা প্রত্যৰ করে অভিভূত হয়ে পড়েন মার্গারেট চ্যান। এৰেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আনত্মরিকতার ভূঁয়সী প্রশংসা করে তিনি বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বর্তমান সরকার স্বাস্থ্য সেবাসহ বিভিন্ন ৰেত্রে যে দৃঢ় অঙ্গীকার রয়েছে, বাসত্মবে যা দেখলাম তাতে আমি দৃঢ় আশাবাদী, বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে যাবে। এ রকম একটি নেতৃত্ব পেয়ে বাংলাদেশের জনগণ অত্যনত্ম ভাগ্যবান।
কমিউনিটি কিনিকের মাধ্যমে মানুষের ঘরে ঘরে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ যেভাবে এগুচ্ছে তাতে অন্য কোন দেশের মডেল ধার করতে হবে না, একদিন বিশ্বের অনেক দেশই বাংলাদেশের এই মডেল গ্রহণ করবে। জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকারের কর্মসূচী সফল করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উপযুক্ত প্রশিৰণের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকমর্ী তৈরি এবং স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় সকল কারিগরি সহযোগিতা দেয়ার কথাও ঘোষণা করেন ড. চ্যান।
প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে দু'দিনের সফরে রবিবার বাংলাদেশে আসেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই মহাপরিচালক। সফরে এসেই সোমবার ব্যসত্ম দিন অতিবাহিত করেন তিনি।
চৌগাছা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স ও কমিউনিটি কিনিক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালককে সকাল সাড়ে ৯টায় ঢাকার পুরনো বিমানবন্দর থেকে হেলিকপ্টারযোগে যশোরের চৌগাছায় নেয়া হয়। এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আফম রম্নহুল হক, প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব) মজিবুর রহমান ফকির, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক শাহ মনির হোসেন, কমিউনিটি কিনিক প্রকল্পের পরিচালক ডা. মাগদুমা নার্গিস, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব সৈয়দ ওমর খৈয়াম, জাতিসংঘের জেনেভা অফিসে নিয়োজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি মোঃ আবদুল হান্নান, হু'র মহাপরিচালকের সঙ্গে আসা ড. ডেইজী মাফুবেলু, ড. ইয়ান স্মিথ, ড. সুভাস সালুস্কি, বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি ড. দুয়াংভেদী সাংকোবল এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক ডা. বায়েজিদ খুরশিদ রিয়াজ সঙ্গে ছিলেন।
সাড়ে ১০টায় চৌগাছা শহীদ মশিউর রহমান একাডেমিক ভবনে হেলিকপ্টার নামলে হু'র মহাপরিচালককে সেখানে বরণ করে নেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মোসত্মফা ফারম্নক মোহাম্মদ। সেখান থেকে মোটরবহর করে নেয়া হয় চৌগাছা ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা মডেল হাসপাতালে। নেমেই ড. চ্যান হাসপাতাল চত্বরে একটি গাছের চারা রোপণ করেন। এরপর পুরো হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ড ঘুরে দেখেন। বিশেষ প্রসূতি বিভাগে যেয়ে সনত্মানসম্ভবা মায়েদের সঙ্গে বেশ কিছু কথা বলেন তিনি। হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে সেখানে স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রমের ওপর আয়োজিত উপস্থাপনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা বড় পর্দার স্ক্রিনে সস্নাইডের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্য সেবায় গৃহীত ভিশন-২০২১ কর্মসূচী এবং প্রত্যনত্ম অঞ্চল থেকে হাসপাতালে এসে রোগীরা কী ধরনের চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন, তা দেখানো হয়। ড. মার্গারেট চ্যান মাতৃমৃতু্য ও শিশু মৃতু্যর হার হ্রাস এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিয়ে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোন অর্থ সহায়তাকারী সংস্থা না হলেও স্বাস্থ্য সেবা খাতে বিভিন্ন দাতা সংস্থার অর্থ প্রদানে এ সংস্থা উৎসাহিত করতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের জন্য এ কাজটি করবে। কারণ বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সেবা খাতে ভাল কাজ করছে।
তাঁকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানোয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, জেনেভায় অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য সেবার মান বৃদ্ধি এবং মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে গৃহীত পরিকল্পনা ও দৃঢ় কমিটমেন্টে আমি মুগ্ধ ও অভিভূত হয়েছি। তিনি বলেন, দাতা সংস্থার অর্থপ্রাপ্তির অন্যতম শর্ত হচ্ছে একটি ভাল ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি উপহার দেয়া। এ উদ্দেশ্যে পূরণে বাংলাদেশকে অন্যের উদাহরণ অনুসরণের প্রয়োজন নেই। চৌগাছা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সই তাদের জন্য উত্তম উদাহরণ। তিনি স্বাস্থ্য সেবা প্রদান ও ব্যবস্থাপনার মান বৃদ্ধির জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পৰ থেকে বাংলাদেশে কারিগরি সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য খাতের জনবলের প্রশিৰণ প্রদানের ৰেত্রে সুযোগ বৃদ্ধির ঘোষণা দেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী রম্নহুল হক বলেন, বর্তমান সরকার স্বাস্থ্য সেবাকে আরও সহজলভ্য, মানসম্মত ও সময় উপযোগী করতে কাজ করে যাচ্ছে। প্রত্যনত্ম অঞ্চলে গরিব-দুঃখী ও অসহায় মানুষের ঘরে ঘরে আমরা স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে চাই। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত স্বাস্থ্য খাতে ভিশন-২০২১ বাসত্মবায়নে আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের কর্মকান্ড দেখে মুগ্ধ হয়েছেন হু'র মহাপরিচালক। আমরা মাত্র ১৪ মাসেই প্রমাণ করেছি বাংলাদেশের মানুষ পারে। তবে আমরা দেশের মানুষের পাশাপাশি সবার সহযোগিতা চাই। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণসহ মাতৃমৃতু্য ও শিশু মৃতু্যহার আমাদের আরও কমিয়ে আনতে হবে।
মাটিতে বসেই শিৰকের ভূমিকায় ড. চ্যান কমিউনিটি কিনিক পরিদর্শনের পর হু'র মহাপরিচালককে নিয়ে যাওয়া হয় উপজেলার পেটভরা গ্রামের ব্র্যাক্রে ৰুদ্রঋণ কার্যক্রমের সাংগঠনিক কাজ দেখাতে। আগে থেকেই ব্র্যাক থেকে ঋণ নিয়ে সমিতি করে স্বাবলম্বী হওয়া নারীরা মাটিতে পস্নাস্টিকের কাগজ বিছিয়ে গোল করে বসে ছিলেন। সামনে হু'র মহাপরিচালক ও মন্ত্রীদের বসার জন্য রাখা হয়েছিল চেয়ার। কিন্তু মার্গারেট চ্যান চেয়ারে না বসে সোজা মহিলাদের সঙ্গে মাটিতেই বসে পড়ে রীতিমতো কাস নেয়া শুরম্ন করেন।
আকাশ থেকেই ধ্বংসযজ্ঞ দেখলেন ড. চ্যান মধ্যাহ্নভোজের পর যশোরের চৌগাছা থেকে সাতৰীরা আশাশুনির উদ্দেশ্যে রওনা হয় হেলিকপ্টার। প্রায় ত্রিশ মিনিট হেলিকপ্টারটি একদম নিচ দিয়ে উড়িয়ে ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়া সাতৰীরার তিনটি উপজেলার বিসত্মীর্ণ জনপদ দেখানো হয় হু'র মহাপরিচালককে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আফম রম্নহুল হক ১১ মাস আগে ঘূণর্ীঝড়ের তান্ডবে এখনও মাইলের পর মাইল এলাকার ৰতচিহ্নগুলো সম্পর্কে অবহিত করেন ড. চ্যানকে। হেলিকপ্টারের দরজার সামনে বসেই দীর্ঘ সময় নিষ্পলক আইলার তা-ব এবং লাখো মানুষের চরম ভোগানত্মির দৃশ্য দেখে অনেকটাই আবেগে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বিকেল ৩টায় আশাশুনি প্রতাপনগর হাইস্কুল মাঠে হেলিকপ্টার থেকে নামা মাত্রই পূর্বে থেকেই উপস্থিত হাজার হাজার নারী-পুরম্নষ নির্বিশেষে দুর্গত মানুষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই প্রধানকে উঞ্চ অভ্যর্থনা জানান। সেখানে মঞ্চ বানিয়ে রীতিমতো রাজনৈতিক বক্তব্য দেন ড. চ্যান। এ আসনটি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নিজের। তাই নিজেও ছিলেন উৎফুলস্ন। মানুষের ভিড়ে রীতিমতো জনসভায় রূপ নেয় সেখানে। এরপর ড. চ্যান স্প্রীডবোর্ড চড়ে আইলা বিধ্বসত্ম সাতৰীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের বিধ্বসত্ম জনপদ পরিদর্শন করেন। আশাশুনির কড়িকাউনিয়া, রম্নইয়ারবিল, চাকলা, সুভদ্রাকাটি ও দিঘলাআইট এলাকা পরিদর্শন শেষে সন্ধ্যা ৬ টায় ঢাকায় ফিরে আসেন।

No comments

Powered by Blogger.