রুশ রস- সংকলন ও অনুবাদ: মাসুদ মাহমুদ

masud328@gmail.com  ভদ্রলোকের একটি দিন নিকোলাই তমচোভস্কি ভদ্র ও সংস্কৃতিমান হওয়ার মজাই আলাদা। দুপুরের খাবার সেরে ডিভানে আয়েশ করে শুয়ে আছি। হাতে—বুঝতেই পারছেন—পত্রিকা। স্ত্রী বাসনকোসন ধুচ্ছে রান্নাঘরে। ট্যাপ থেকে পানি পড়ছে ঝিরঝির শব্দে।
মন উষ্ণতায় ভরা, প্রফুল্ল। আমি শুয়ে শুয়ে ভাবছি আর ভাবছি। ভাবছি উপগ্রহ নিয়ে, বেতন নিয়ে, পলিমার নিয়ে, সাইবারনেটিকস নিয়ে...
সবে ভাসতে শুরু করেছি কল্পনার জগতে, অমনি স্ত্রী নাক গলাল তার রান্নাঘরের কাজের কথা টেনে। বলল, ‘ভাসিলি, তুমি তো অন্তত একটু সাহায্য করতে পারতে আমার কাজে। আমি গেনাকে নিয়ে আসতে যাচ্ছি কিন্ডারগার্টেন থেকে, এদিকে চুলোয় দুধ বসানো রইল, তুমি নজর রেখো যাতে উপচে না পড়ে।’
দুধের দিকে নজর রাখতে হবে কেন! দুধ উপচে পড়ে যাবেই বা কোথায়! চুলো পর্যন্তই তো তার দৌড়।
আরও আরাম করে শুলাম। চোখ বন্ধ করলাম পরিপূর্ণ বিশ্রামের আশায়। মনের গহিনে ভেসে উঠতে লাগল বার্দো, মনরো, এমনকি আমাদের মরদ্যুকোভাও।
হঠাৎ দড়াম শব্দে দরজা খুলে গেল। শুরু হলো শব্দ, হইচই। গেনা ফিরেছে কিন্ডারগার্টেন থেকে। তার পেছন পেছন ঢুকল স্ত্রী। দুই হাত ভর্তি তার প্যাকেট, ব্যাগ, বোতল। রান্নাঘর থেকে দুধের গন্ধ পৌঁছাল তার নাকে। ধোঁয়া, পোড়া গন্ধ। রোমান্টিকতা উবে গেল নিমেষেই।
অথচ পাস্তেরনাক লিখেছিলেন:
অগণ্য তোমার ভক্ত, হে প্রিয়া
ধবল এই রজনীতে আমরা দুজনে
তোমার জানালার চৌকাঠে নিতাম খুঁজে নির্জনতা...
আবার দুমদাম শব্দ, চিৎকার। নির্ঘাত কোনো অঘটন ঘটিয়েছে গেনা। কেন যে স্ত্রী ওর পেছনে সময় দেয় না! কাপড় কাচা, মেঝে মোছা আর কাটলেট বানাতেই সে ব্যস্ত সব সময়। কিন্তু ছেলেকে আদব-কায়দা শেখানোও তো দরকার।
বাগরিৎস্কির কথাও মনে পড়ছে:
বিক্রেতাদের বচসা বাজারে
মাছের আঁশ ছাড়াতে ছাড়াতে...
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। আমি শুয়ে আছি ডিভানেই। দেখি, স্ত্রী ঘুম পাড়াচ্ছে গেনাকে। আর আমি ভাবছি, পৃথিবী নামের আমাদের এই গ্রহটি দাঁড়িয়ে আছে কিসের ওপর? একদল বলে, তিমি মাছের ওপরে। অন্যেরা নিউটনের কথা মনে করিয়ে দেয়। মহা সমস্যা! এটা নিয়ে বরং কাল ভাবব। ক্লান্ত আমি এখন। ঘুম পাচ্ছে বড়।
‘ওগো শুনছো, আমার স্যান্ডেল জোড়া কোথায়?’

জীবনযাপন
গেনরিয়েতা নিকোলায়েভা
একেবারে ঘোর শৈশব থেকে আমাকে সবকিছু করতেই বাধা দেওয়া হয়েছে সব সময়। চারপাশ থেকে একটি কথাই শুনতাম শুধু:
‘এখনো ছোট। বড় হয়ে নাও আগে।’
‘হাঁটতে শিখেই নিজেকে বড় ভাবতে শুরু করা শিখেছ?’
‘বাবার আগেই নরকে যাবার তাড়া তোমার!’
ক্রমশ নিজের ওপরে আস্থা ফিরে এল আমার, যখন উপলব্ধি হলো, আমার জীবনের অধিকাংশ সময় এখনো পড়ে আছে সামনে। সে কারণেই আত্মীয়-পরিজন ও পরিচিতরা আশ্বাস দিত নিরন্তর:
‘এত তাড়ার কী আছে! পরে সময় পাবে তো।’
‘বড় হলেই বুঝবে।’
‘অকালপক্ব হতে চাও কেন!’
‘জীবনযাপনে এত তাড়া কেন?’
‘তোমার জন্য সবকিছু অপেক্ষা করছে ভবিষ্যতে।’
প্রতিশ্রুত সময়ের জন্য সহিষ্ণু প্রতীক্ষার প্রহর পার করতে করতে একটা সময়ে হঠাৎ করেই লক্ষ করলাম, আমার আগে শোনা বাক্যগুলোর অর্থ কিছুটা পাল্টে গেছে। এখন আত্মীয়-পরিজন ও পরিচিতরা বলে:
‘এই বয়সে এই কাজ করা তোমার মানায় না।’
‘তোমার বয়সে ওখানে ফিরে যাবার অর্থ আর হয় না।’
‘এই কাজ করবার বয়স তোমার আর নেই।’
‘অতীতকে ফিরে পাবার উপায় আর নেই।’
‘এসব কিছুই তুমি পেছনে ফেলে এসেছ।’
মেজাজ বিগড়ে গেল আমার। সব আত্মীয় আর পরিচিতজনকে একত্র করে সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে বললাম: ‘আমার জীবনটা আসলে কোথায়, পেছনে নাকি সামনে পড়ে আছে?
নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে তারা জানাল: জীবন তোমাকে পাশ কাটিয়ে গেছে।

সামাজিক বিধি
ই. মারতিয়ানভ
অফিস থেকে ফিরে ওভারকোটটা খুললেন ভ্লাদিমির পেত্রোভিচ। তারপর চুলোর পাশে রান্নায় ব্যস্ত স্ত্রীর কাছে গিয়ে বললেন, ‘মাশা, আমি আগামীকাল গালিকোভস্কি পরিবারকে আমাদের বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়েছি। নিজেই তো জানো, গত রোববারে আমরা তাদের বাসায় গিয়েছিলাম। ফিরতি দাওয়াত দেওয়াটা কর্তব্য।’
‘ভালো করেছ দাওয়াত দিয়ে।’
‘কোনো কিছু রান্না করতে হবে এ উপলক্ষে। আর সবচেয়ে বড় কথা, ওই বাজে জিনিসটা কিনতে হবে।’
‘কিসের কথা বলছ তুমি,’ আমার কথা না বুঝে প্রশ্ন করল স্ত্রী।
‘কিসের কথা আবার! ভোদকার কথা অবশ্যই। তারা আমাদের আপ্যায়ন করেছিল ভোদকা দিয়ে, আমাদেরও সেটা করা উচিত। বিশ্বাস করো, জীবনে কখনো এই জিনিসটা মুখে নিতাম না। কিন্তু বাধ্য হয়ে খেতে হয়। সামাজিক বিধি।’
পরদিন গালিকোভস্কি দম্পতি বাসা থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
‘সবই ঠিক আছে। কিন্তু জানো, যখনই ভাবি, ভ্লাদিমির পেত্রোভিচ ৪০ ডিগ্রি কড়া ওই পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করবে, আমার বমি চলে আসে,’ বলল স্বামী।
‘একটু না-হয় সহ্যই করলে,’ স্ত্রী বলল সান্ত্বনা দিয়ে। ‘কী আর করবে, বলো! সামাজিক বিধি।’

No comments

Powered by Blogger.