বইমেলা ও কিছু ভাবনা by নিয়ামত হোসেন

বইয়ের গুরুত্ব কি দিন দিন কমে যাচ্ছে? কেউ কেউ বলেন, ভবিষ্যত কাগজে ছাপানো বই থাকবে না। প্রযুক্তি বিজ্ঞানের কল্যাণে কাগজে না ছাপিয়েও বই বা পত্রিকা পড়া যায়, কিন্তু যেসব দেশে প্রযুক্তি বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি এখনই এসে গেছে, বই যেসব দেশে এখনও প্রকাশিত হয়।
যেসব দেশে বই লোকে কেনে এবং পড়ে। এখনও অনেক দেশে নিয়ম করে বইমেলা হয়। শিক্ষা এবং জ্ঞানের প্রসারের জন্য এখনও বই খুব বড় একটা মাধ্যম। বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে। বইয়ের এ গুরুত্ব দীর্ঘকাল যে থাকবে তাতে সন্দেহ নাই। উন্নত দেশগুলো থেকে কাগজের বই একবারে উঠে যাবে এটাও ধারণা করা যায় না। যদি কখনও যায়ও, তাহলে তা সুদূর ভবিষ্যতে হলে হতে পারে।
আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারির দেশ। প্রতিবছর অমর একুশের বইমেলার আয়োজন করা হয় অনেকদিন থেকে। এবারও হয়েছে। শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই মেলার উদ্বোধন করেছেন। সেই থেকে মেলায় অগণিত মানুষের ভিড়। ভিড় সববয়সী মানুষের। তারা বই ভালবাসে। ভালবাসে নিজের ভাষাকে। ভালবাসে নিজের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে। এই বইমেলা আমাদের ঐতিহ্যের একটা অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একুশ উপলক্ষে বইমেলা। একুশ আমাদের গৌরব। বই আমাদের প্রিয়। যুগ যুগ ধরে বইয়ের প্রতি থাকবে আমাদের ভালবাসা।
বইমেলা শুরু হলে একটা উৎসব শুরু হয়ে যায় যেন। বই বের হয় এ সময় অনেক। বিক্রিও হয় অনেক। মেলা শেষে হিসাব-নিকাশের পর যেসব খবর বের হয় তাতে দেখা যায় কয়েক কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে মেলায়। শুনে ভাল লাগে। কারণ বিষয়টি উৎসাহব্যঞ্জক। কত লোক মেলায় যায়। তারা কেউ বই কেনে, কেউ ঘুরে ঘুরে দেখে। ছোটরা যায় বড়দের সঙ্গে। তারাও বই কেনে অনেকে। তারা দেশের একটি চমৎকার ঐতিহ্যের সঙ্গে এভাবে একাত্ম হয়ে ওঠে। এই ধারাবাহিকতা চলে আসছে অনেক দিন ধরে।
বই প্রকাশ, বই বিক্রি, মেলায় লোকসমাগম ইত্যাদি বিষয় দেখলে স্বাভাবিকভাবেই সবই উৎসাহব্যঞ্জক বলে মনে হয়। বিষয়টি তাই, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এসবের পরও কিছু কথা থেকে যায়। প্রথমত বলা যায়, বইয়ের মান এবং দাম সম্পর্কে। সব বইয়ের মান একইরূপ হবে, সেটা অবশ্য আশা করা যায় না। তবে মোটামুটি গবেষণাকর্মসহ সাহিত্যের ভাল বই কতগুলো বের হয় সেটা একটা প্রশ্ন হতে পারে। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, শিশু সাহিত্য ইত্যাদিরও প্রয়োজন অনেক বেশি। এটাও ঠিক সে ধরনের বই প্রকাশিত হয় বটে, কিন্তু মান যে খুবই উন্নত হয় তাও নয়। অবশ্য নানা ধরনের বই পাঠক দেখবেন, দেখে কিনবেন; সেটাই স্বাভাবিক। লেখকরা নিজেদের মতো করে লিখছেন। সবাই প্রত্যাশা করে, তার বইটি পাঠকের হাতে পৌঁছাক। সে জন্য লেখকরা লিখতে এবং প্রকাশ করতে আগ্রহী হন। যত বেশি বই দেশে বের হবে ততই ভাল। লেখার চর্চা বাড়বে। পাঠক বিভিন্ন লেখকের লেখাপড়ার সুযোগ পাবেন, ভাল-মন্দ বিচার তাঁরাই করবেন। বই ভাল হলে পাঠকদের আকৃষ্ট করবে। কিছুকাল আগেও বই প্রকাশ করা ছিল কষ্টকর ব্যাপার। একালে এমনসব প্রযুক্তি এসেছে যার জন্য সহজে, দ্রুত এবং অত্যন্ত শোভন ও সুন্দরভাবে বই প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে। এখন সুন্দর সুন্দর বই বের হচ্ছে। পাঠকও এতে খুশি।
একটা বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, মেলা উপলক্ষে অনেক বই বের হচ্ছে, অনেক প্রকাশক অনেক বই প্রকাশ করছেন ঠিক, তারপরও দেখা যায় লেখকদের জন্য বিশেষ করে তরুণ লেখকদের জন্য বই বের করা একটা সমস্যা হয়ে রয়েছে। শুধু তরুণ কেন। বহু প্রবীণ লেখকও প্রকাশক পান না। ফলে তাঁদের বই প্রকাশিত হয় না। বই প্রকাশ হওয়ার আরেক অর্থ নতুন লেখায় উৎসাহ পাওয়া। বই প্রকাশ না হওয়ার কারণে অনেকে নতুন কিছু লিখতে আগ্রহই হন না। প্রকাশনা ক্ষেত্রে একটা বাস্তবতা হচ্ছে, অনেক লেখককে নিজের টাকা দিয়ে বই বের করতে হয়। তাঁরা নিজের পুরো টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করেন। নতুবা প্রকাশনার খরচের বড় একটা অংশ লেখককে দিতে হয়। এভাবে অনেকদিন ধরে অনেকে বই প্রকাশ করছেন। বই কম খরচে বের করার জন্য প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খরচ যাতে কমে যায় সেই ব্যবস্থাটি করা দরকার। বিশেষ করে কাগজের দাম যাতে না বেড়ে কমে যায় সেই ব্যবস্থাটিও খুব জরুরী। বই প্রকাশের খরচ কমে গেলে প্রকাশকরা আরও বেশি বই প্রকাশে উৎসাহী হবেন। প্রকাশিত বইয়ের দামও কম পড়বে। একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়, পছন্দ এবং প্রয়োজনীয় বই একাধিক কিনতে হলে ক্রেতার পক্ষে তা সম্ভব হয় না। কারণ এমনিতেই বইয়ের দাম পড়ে সাধারণত বেশি, তার ওপর একাধিক বই কেনা ক্রেতার পক্ষে আর্থিক কারণেই সম্ভব হয় না। তাই বইয়ের দাম কম থাকলে ক্রেতা বেশি করে বই কিনতে পারবেন।
দেশে শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় না, তা অবশ্য নয়। তবে যতখানি হওয়া প্রয়োজন ততখানি হয় কিনা সন্দেহ। মেলায় বহু লোক যায়, কিন্তু সবাই বই কেনে না।
শিশু সাহিত্যের বই শিশু একাডেমী প্রকাশ করছে। বাইরের প্রকাশকরাও করছেন। শিশুদের জন্য আরও মানসম্পন্ন, বিষয়ভিত্তিক বিশেষ করে বিজ্ঞানভিত্তিক বই প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন। বাংলা একাডেমী সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্য নিঃসন্দেহে অনেক কাজ করেছে। এখনও করে চলেছে। তারপরও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য আরও বেশি দায়িত্ব বাংলা একাডেমীর নেয়া প্রয়োজন; বিশেষ করে নবীন লেখকদের বই প্রকাশের জন্য বিশেষ উদ্যোগ আরও থাকা উচিত। বাংলা একাডেমীর অধীনে বা তার বাইরে সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য একটা সাহিত্য একাডেমী হলে এই কাজটি সুন্দরভাবে হতে পারে। এমন একাডেমীর ব্যবস্থা হলে সেখানে উপন্যাস, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ, কবিতা ইত্যাদি শাখার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের লেখা আহ্বান করে সেগুলো ভাল হলে প্রকাশের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে লেখক লেখার ব্যাপারে উৎসাহিত হবেন। বিশেষ করে উৎসাহিত হবে তরুণ লেখক-লেখিকারা। বাংলা একাডেমী বা উল্লিখিত একাডেমী গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ইত্যাদি বিষয়ে দেশব্যাপী প্রতিযোগিতার আহ্বান করতে পারে।
দেশে শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ খুব জরুরী। তবে সেটা হতে হবে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। বিশ্বের নানা দেশ ও জাতির সুস্থ সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের জনসাধারণের আরও বেশি করে পরিচয় করিয়ে দেয়া দরকার। অসুস্থ সংস্কৃতির প্রসার ঘটছে দিন দিন। বেনো জলের মতো ঢুকছে এই সংস্কৃতি। এটাকে ঠেকানোর জন্য সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা নিশ্চিত করা জরুরী।
এখন চলছে আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক উৎসব। ঢাকা এত বড় এবং এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাওয়া এমন ব্যয়বহুল ও ঝামেলাপূর্ণ, যার জন্য বইমেলার দিনগুলোয় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বাংলা একাডেমীর পর্যন্ত সহজ বাসসহ পরিবহন ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। বইমেলায় যাওয়ার জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে বাসের ব্যবস্থা থাকলে বহু লোক যেতে পারবে মেলায়। বইও বিক্রি হবে বেশি। বইমেলা সফল ও সার্থক হবে এই প্রত্যাশা।

No comments

Powered by Blogger.