বেগম জিয়া কি নিজে নিজের পায়ে গুলি করলেন? by আবদুল মান্নান

সাধারণত আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা তেমন লেখালেখি করেন না বলে একটা বদনাম আছে। শেখ হাসিনার লেখার অভ্যাস ছিল, তবে বহুদিন তার লেখা চোখে পড়ে না।
ব্যস্ততার কারণে হয়তো লেখা হয়ে ওঠে না। রাজনীতিবিদরা পড়েন আরও কম। ভারতের প-িত নেহ্রু সত্যিকার অর্থেই প-িত ছিলেন। তার লেখা ‘এষরসঢ়ংবং ড়ভ ডড়ৎষফ ঐরংঃড়ৎু’ আর ‘উরংপড়াবৎু ড়ভ ওহফরধ’ আর মওলানা আবুল কালাম আজাদ লিখেছিলেন তার অসাধারণ গ্রন্থ ‘ওহফরধ ডরহং ঋৎববফড়স.’ বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ একটি অসামান্য কীর্তি। ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের পিতা আবুল মনসুর আহমদ একজন সফল রাজনীতিবিদ তো ছিলেনই একজন লেখক হিসেবেও তার সুনাম ছিল। পাকিস্তানের কোন রাজনীতিবিদের লেখার সঙ্গে তেমন একটা পরিচিত নই। সীমান্ত গান্ধী গাফ্ফার খানের ছেলে ন্যাপ প্রধান খান আবদুল ওয়ালী খান ‘ঋধপঃং ধৎব ঋধপঃং’ লিখে বেশ খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন। অক্সফোর্ডে পড়ালেখা করা বেনজিরের বেশ কয়েকটি বই পাঠকপ্রিয় হয়েছিল। ইদানীং বাংলাদেশে একজনকে সফল লেখক ও গবেষক হিসেবে আমি শ্রদ্ধা করি, তিনি বর্তমানে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তার সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন হচ্ছে তিনি একজন ভাল গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক হতে পারতেন। তা না হয়ে একজন বহুরূপী ডিগবাজি বিশারদ ফ্লপ রাজনীতিবিদ হয়েছেন। তার নিজ আইন পেশায়ও খ্যাতি আছে। তার মেধা আর তার শ্বশুর পল্লী কবি জসীমউদদীনের নাম ও খ্যাতির বদৌলতে হতে পারতেন একজন সম্মানিত প-িত। তা না হয়ে বেছে নিলেন রাজনীতিবিদ হওয়ার পেশাটা। যৌবনে তিনি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে এসেছিলেন। হতে পারে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সম্মোহনী শক্তি তাকে আকর্ষণ করেছিল। এসব আমার আজকের লেখার পূর্ব লেখন বা ব্যাকগ্রাউন্ড। আসল বিষয় গত ৩০ জানুয়ারি সুদূর ওয়াশিংটন ডিসির ওয়াশিংটন পোস্টে জিয়ার নামে প্রকাশিত একটি লেখার (তরধ : ঞযব ঃযধহশষবংং ৎড়ষব রহ ংধারহম ফবসড়পৎধপু রহ ইধহমধফবংয) বিশ্লেষণ। আমার জানা মতে, এটি বেগম জিয়ার নামে প্রকাশিত দ্বিতীয় লেখা। প্রথমটি প্রকাশিত হয়েছিল কয়েক মাস আগে তার দিল্লী সফরের প্রাক্কালে দিল্লী হতে প্রকাশিত একটি প্রতিরক্ষা বিষয়ক ম্যাগাজিনে। ওটি ছিল দিল্লীর কেন্দ্রীয় নেতাদের বোঝানো যে, বেগম জিয়া তাদের আমন্ত্রণে দিল্লী আসছেন, তিনি তাদের পূর্ব পরিচিত ভারত বিদ্বেষী, জঙ্গিবাদ লালনকারী বেগম জিয়া নন। তিনি একজন সম্পূর্ণ পরিবর্তিত বেগম জিয়া, যিনি হাতে জলপাইয়ের ডাল আর মুখে ‘ওম শান্তি ওম শান্তি’ বলে দিল্লী জয় করতে আসছেন। দিল্লীওয়ালারাও তাকে তথাস্তু বলে স্বাগতম জানালেন। দেশে বিএনপি শিবিরে বেশ হইচই পড়ে গেল। কেমন করে তাদের ধারণা হলো দিল্লী জয় আর ঢাকার ক্ষমতার মসনদের দূরত্ব তেমন বেশি নয়। তবে যে বিএনপির রাজনীতির মূল দর্শনই হচ্ছে ভারতবিরোধিতা আর জঙ্গিবাদ তোষণ তাদের পক্ষে তো রাতারাতি তা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব নয়। ফিরে এসে আবার সব কিছু ফিরে গেল পূর্বের অবস্থায়।
কয়েক দিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মজেনা সাহেব গেলেন ম্যাডাম খালেদা জিয়ার বাসভবনে। দু’জনের মধ্যে বদ্ধদুয়ার সলাপারামর্শ হলো। মজেনা সাহেব আসার সময় ম্যাডামকে তার দেশ সফরে আমন্ত্রণ জানালেন। এ সময় শেখ হাসিনা রাশিয়া সফর করছিলেন। কোন কোন প-িত বিশ্লেষক মন্তব্য করলেন মজেনা সাহেব শেখ হাসিনাকে একটি সবক দিতে চেষ্টা করেছেন। রাশিয়ার সঙ্গে বেশি মাখামাখি করলে কপালে দুঃখ আছে। আবার অন্যদের মন্তব্যÑযেখানে খোদ যুক্তরাষ্ট্রই এখন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বেশ মনোযোগী সেখানে শেখ হাসিনা রাশিয়ায় গেল না এল তাতে যুক্তরাষ্ট্রের কোন মাথাব্যথা নেই। ঘটনা যাই হোক, বেগম জিয়া এখন যুক্তরাষ্ট্র সফরের জন্য প্রস্তুত। আর এটা মাথায় রেখে হয়ত তার চার পাশে থাকা কিছু আমলা পরামর্শদাতা ঠিক করলেন ম্যাডামের নামে যুক্তরাষ্ট্রের কোন একটি দৈনিক পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে মন্দ কি ? লেখাটি যে আমলাদের পরামর্শেই প্রস্তুত তা এ কারণেই পরিষ্কার যে, কোন রাজনীতিবিদ এই লেখাটির সঙ্গে জড়িত থাকলে বেগম জিয়ার নামে এমন একটি পায়ে কুড়াল মারা লেখা সম্ভবত প্রকাশিত হতো না। ইংরেজীতে বলে ঝযড়ড়ঃরহম ধঃ ড়হব’ং ড়হি ভড়ড়ঃ. (নিজের পায়ে নিজে গুলি করা)।
বেগম জিয়া শুধু যে নিজের পায়ে নিজে গুলি করেছেন তাই নয়, তিনি একই সঙ্গে জাতির পিঠেও গুলি করার চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশের একচল্লিশ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা দ্বিতীয় কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ঘটিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। বেগম জিয়ার নামে লেখাটি যে পত্রিকায় ছাপা হয়েছে সেই পত্রিকা সম্পর্কে দু’কথা লেখা হয়েছে ১ ফেব্রুয়ারির দৈনিক সমকালে। ওয়াশিংটন টাইমস য্ক্তুরাষ্ট্রের একশত দৈনিকের মধ্যেও নেই। ৩০ জানুয়ারি যেদিন ওই পত্রিকার মতামতের পৃষ্ঠায় বেগম জিয়ার নামে লেখাটি ছাপা হলো সেদিন আরও দশটি মতামত ছাপা হয়েছিল এবং বেগম জিয়ারটি ছিল দশ নম্বরে। পত্রিকাটি সাংঘাতিক রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত। এটি প্রকাশিত হয় ইউনিফিকেশন চার্চ নামের একটি খ্রিস্টান ধর্মীয় আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতাায়। ১৯৯৮ সালে মিসরীয় বিখ্যাত দৈনিক আল-আহরাম পত্রিকাটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিল এটি অন্ধভাবে আরব ও মুসলমান বিদ্বেষী আর ইহুদী স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কাজ করে। বেগম জিয়ার পরামর্শদাতারা বেছে নিলেন এমন একটি পত্রিকাকে তাদের নেত্রীর লেখা প্রকাশের জন্য। বেশ কিছু দিন ধরে এমনিতেই বাংলাদেশ নানাভাবে ইহুদী লবির গুতোগুতিতে অতিষ্ঠ। প্রথমে জামায়াত তাদের যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য যে আন্তর্জাতিক লবিস্ট নিয়োগ করেছে তার প্রধান একজন শীর্ষ ইহুদী আইনজীবী, টোভি ক্যাডমেন। গত দুই বছর বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি এ্যালেন গোল্ডস্টেইন নামে আরেক ইহুদী কর্মকর্তা পদ্মা সেতুর অর্থায়নের নামে সরকারকে কি নাচন না নাচিয়ে গেলেন। এখন আবার দেশের প্রধান বিরোধী দল শরণাপন্ন হয়েছেন একটি ইহুদী লবির পত্রিকার।
বেগম জিয়ার নামে প্রকাশিত লেখাটিতে যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থান পেয়েছে তার মধ্যে আছে (১) আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারকে বিশ্বের যে ক’টি দেশ প্রথমদিকে স্বীকৃতি দেয়, তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম। (২) গত বছরগুলোতে দু’দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে, যার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নির্লিপ্ততাকে দায়ী করা যায়। কারণ বাংলাদেশের গণতন্ত্র যখন দুর্বল হচ্ছে এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক যখন অন্যান্য উদীয়মান বিশ্বশক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ছে (পড়–ন ভারত আর রাশিয়া), তখন যুক্তরাষ্ট্র এটা চেয়ে চেয়ে দেখছে। (৩) পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বিশ্বব্যাংক বন্ধ করে দিয়েছে কারণ এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ অর্থ মন্ত্রণালয় (যোগাযোগ) লোপাট করে দিয়েছে। অবশ্য এই অর্থায়ন বন্ধ করার পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ও সরকারের একটি ভূমিকা ছিল। (৪) র‌্যাবের হাতে ২০০৯ সাল হতে এ পর্যন্ত তিনশ’ মানুষ নিখোঁজ হয়েছে । (৫) শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকা- ও শ্রমিকদের অধিকার রক্ষাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও তার শ্রমিক সংগঠনগুলো বাংলাদেশকে দেয়া বাণিজ্যিক সুবিধা বাতিলের চেষ্টা করছে। (৬) বাংলাদেশে বর্তমানে যে যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে তা শুধু বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে হচ্ছে এবং এই ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক দূত হাসিনা সরকারের নিন্দা করেছেন। (৭) বাংলাদেশ এশিয়ার অন্যতম উজ্জ্বল গণতান্ত্রিক দেশের অবস্থান থেকে সরে এসে দ্রুত একটি পরিবারকেন্দ্রিক ক্ষমতা কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। (৮) নির্বাচনের আগে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অপরিহার্যতাকে তুলে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। (৯) মিয়ানমারের নতুন একটি গণতান্ত্রিক যুগ শুরু হয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের বিকাশ অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ যদি একটি পরিবারের শাসনে আটকে পড়ে, তাহলে তা হবে গোটা অঞ্চলের জন্যই পশ্চাৎপদতার দিকে যাত্রা। আর সর্বশেষ ও সর্বনাশা মন্তব্যÑ(১০) শেখ হাসিনার ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রদত্ত সুবিধা (জিএসপি) তুলে নেয়া দরকার এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বের পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই সময়। বেগম জিয়ার শেষের দাবিটি নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল।
বেগম জিয়ার নামে প্রকাশিত লেখাটি নিয়ে জাতীয় সংসদ এবং সংসদের বাইরে গত কয়েক দিন ধরে বেশ সমালোচনা হচ্ছে। ব্যারিস্টার মওদুদ তার নেত্রীর অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেছেন বেগম জিয়া এই লেখাটির মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সমস্যাকে বিশ্ব দরবারে নিয়ে গিয়েছেন এবং সেজন্য আওয়ামী লীগের আঁতে গা লেগেছে। তার লেখার সমালোচনা হীনম্মন্যতার শামিল। বেগম জিয়ার সব বক্তব্যের জবাব দিতে গেলে লেখার কলেবর বৃদ্ধি পাবে। শুধু গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় আলোচনা করতে চাই। বেগম জিয়া তার মিত্র বিশেষ করে জামায়াতকে নিয়ে গত আড়াই বছর ধরে নানা ইস্যুতে আন্দোলন আন্দোলন খেলছেন। শুরুটা হয়েছিল সেনানিবাসের বাড়িকে রক্ষা করার দাবিতে। তারপর নিজের ছেলেদের দুর্নীতির দায় হতে মুক্তি দেয়ার দাবি সামনে এল। তার ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর দুর্নীতি যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে স্বীকৃত। সরকার এর মধ্যে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান হতে উচ্চ আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল আওয়ামী লীগের দাবির প্রেক্ষিত। বিএনপি এই ব্যবস্থাকে নানাভাবে কলুষিত করেছে। এখন সংবিধানে আর এই ব্যবস্থা নেই। ২০১০ সালেই তা রদ হয়ে গেছে। বেগম জিয়ার বক্তব্য নির্বাচনকে সামনে রেখে শেখ হাসিনা তা বাতিল করেছেন তা ঠিক নয়। এই বাতিল প্রথমে উচ্চ আদালত ও পরে সংসদ করেছে এবং কিছু সংশোধনীসহ বাংলাদেশ ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে গেছে । এই ইস্যু নিয়ে বিএনপি ও তার মিত্ররা গত এক বছর নানাভাবে মাঠ গরম করতে চেয়েছে। প্রথমে গাড়ি মার্চ, জনসংযোগ, জনসভা, নিয়মিত প্রেসক্লাব সমাবেশ, তারপর নয়া পল্টন সমাবেশ, মাঝেমধ্যে গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ আর হরতাল। এর মধ্যে আবার দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব গ্রেফতার। রিজভী আহমেদ স্বেচ্ছায় অফিস বন্দী। তারপর হয়ত দলের নেতাকর্মীদের কিছুটা অবসাদে পেয়ে বসেছে। সুতরাং এই লেখা। মনে হচ্ছে এটি এক ধরনের অক্ষমের আর্তনাদ।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন দুটি পরাশক্তি শেষ পর্যন্ত এই মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। এগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ সবসময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল। ডিসেম্বর মাসে চূড়ান্ত লড়াই শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে এই যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য তিনবার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর কারণে তা ভেস্তে যায়। শেষ মুহূর্তে এসে যুক্তরাষ্ট্র তার সপ্তম নৌবহরের পারমাণবিক জাহাজ ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ বঙ্গোপসাগরে পাঠিয়েছিল। কাজ হয়নি কিছুই। এসব তো ইতিহাস। বেগম জিয়ার লেখার রচনাকারীরা কি করে এসব ভুলে গেলেন? যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় চার মাস পর ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল বাংলাাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে অনেক নাটক হলো। কোন অর্থছাড় না করেও বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করল। তারপর একটির পর একটি নাটক চলল। আজ এটা চাই তো কাল ওটা চাই। তারপর বলে তাদের চাহিদা মতো দু’জন সাবেক মন্ত্রীকে গ্রেফতার করতে হবে। এই দু’জনকে গ্রফতার করলেও যে অর্থ মিলবে তার নিশ্চয়তা কি? গ্রেফতার যদি কাউকে করতেই হয় তা হলে তা হবে বাংলাদেশের আইনে, বিশ্বব্যাংকের নির্দেশে নয়। বেগম জিয়া আবার এই অর্থায়ন বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস এবং সে দেশের সরকারের ভূমিকা আবিষ্কার করলেন। যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি কিভাবে নেবে তা সে দেশে বিবেচনা করবে। তবে কিছুটা হলেও স্বস্তির বিষয় বাংলাদেশ আর এই প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংকের দ্বারস্থ হবে না বলে তাদের জানিয়ে দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তটা আরও আগে নিলে তেমন কোন ক্ষতি বৃদ্ধি হতো না। বিএনপির আমলে একাধিক প্রকল্প বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অজুহাতে বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন এসব নিয়ে তমন একটা হইচই হয়নি। এ রকম কাজ বিশ্বব্যাংক অনেক দেশেই করেছে। র‌্যাব বিএনপির সৃষ্টি। র‌্যাবের বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- সব মহলে সমালোচিত এবং নিন্দিত। র‌্যাব সৃষ্টি করা হয়েছিল বেগম জিয়ার শাসনামলে। তারা বর্তমানে কিছুটা সংযত আচরণ করছে। বেগম জিয়ার শাসনামলে অপারেশন ক্লিনহার্টে অর্ধশত মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। এই হত্যাকা-ের যাতে কোন বিচার হতে না পারে তার জন্য ব্যারিস্টার মওদুদ সংসদে দায়মুক্তি বিল পাস করিয়েছিলেন। শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম নিহত হয়েছেন এটি একটি সত্য ঘটনা। এ রকম অনেক শ্রমিক নেতা বাংলাদেশে তো বটেই খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও নিখোঁজ বা নিহত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের জনি হোফ্ফার নিখোঁজ হওয়ার মামলা এখনও অমীমাংসিত। তবে আমিনুল ইসলাম কেন এত গুরুত্বপূর্ণ তা এক বিরাট রহস্য। যদিও সব হত্যারই তদন্ত ও বিচার হওয়া উচিত। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে অনেক দিন ধরে জামায়াত-বিএনপি অক্ষশক্তি পানি ঘোলা করার চেষ্টা করেছে। সফল হয়নি। এর মধ্যে একজনের বিচারের রায়ও ঘোষণা করা হয়েছে। তার জন্য জামায়াত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সঙ্গে নিয়েছে বিএনপিকে। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক দূত স্টিফেন র‌্যাপ ২০১১ সালে বাংলাদেশে এসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্য পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেছেন, শুধু খেয়াল রাখতে হবে এই বিচারকাজ যেন স্বচ্ছ হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে যেভাবে এই বিচারকাজ চলছে তার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন অবকাশ নেই। বাচ্চু রাজাকারের রায় ঘোষিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশ তা সমর্থন করেছে। বর্তমান সরকারে শেখ হাসিনার নিকট পরিবারের কেউ নেই। বেগম জিয়ার শাসনামলে তার বোন, ভাই, সন্তান, ভাগ্নে সকলে কোন না কোনভাবে সরকারের অংশ ছিলেন। তারেক জিয়া তো হাওয়া ভবন কেন্দ্রিক একটি সমান্তরাল সরকারই চালু করেছিলেন। মিয়ানমারে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ভারত তার গণতন্ত্র সুদৃঢ় করেছে। তবে এই দুটি দেশের কোনটিতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নেই। যে জিএসপি নিয়ে সরকার ব্যবসায়ী মহল এত চিন্তিত সেটি বাতিল করার জন্য আবেদন জানিয়ে বেগম জিয়া চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। তেমনটি হলে বাংলাদেশের শুধু চল্লিশ লাখ তৈরি পোশাক শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সঙ্গে তাদের পরিবার। বিশ্ব মন্দার মাঝে বাংলাদেশের ৬.৪% প্রবৃদ্ধিকে বিশ্বব্যাংক একটি বিস্ময়কর রহস্য বলে আখ্যায়িত করেছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এটি স্বীকার করেছে। এই শতকে বাংলাদেশ বিশ্বের একটি অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। বেগম জিয়ার ভাষায়, বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বের পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান ছিল একটি অবিশ্বাস্য বক্তব্য। যে মহিলা দু’বার এই দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি কিভাবে এমন একটি চরম রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক আহ্বান করতে পারেন? তিনি কি চান বাংলাদেশ আরেকটি ইরাক, আফগানিস্তান অথবা সিরিয়া হয়ে উঠুক। তার এসব বক্তব্য পড়লে যে কারও মনে হবে বাংলাদেশের জনগণের ওপর তার আস্থার চিড় ধরেছে এবং হয়তো তিনি এখন মনে করছেন ক্ষমতার মসনদটাও দূরে সরে যাচ্ছে।
যারা বা যিনি বেগম জিয়ার এই লেখার খসড়া করে দিয়েছেন তারা বেগম জিয়াকে রাজনৈতিক আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছেন। এতে বেগম জিয়ার রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব প্রমাণিত হয়ে পড়েছে।

ফেব্রুয়ারি ৩, ২০১৩
লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.