ইতিবাচক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হোক কালের কণ্ঠ by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

২০১০ সালের জানুয়ারি মাস। আমি তখন বাংলাদেশে। বগুড়া ও রংপুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। রংপুরে নবপ্রতিষ্ঠিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে যোগ দেব এবং পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়ার গ্রামের বাড়ির ভগ্নাবশেষ দেখব- এটাই ছিল আমার মূল উদ্দেশ্য। রংপুরের সার্কিট হাউসে উঠলাম।
জেলার তখনকার ডিসি অত্যন্ত অমায়িক ভদ্রলোক। তাঁর স্ত্রী কবিতা লেখেন। তাঁর বাড়িতে নৈশভোজের সঙ্গে লালনগীতির একটা আসর বসবে- এমন ইঙ্গিত পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম।
রংপুরের সার্কিট হাউসে উঠেছি ৯ জানুয়ারি রাতে। মনে পড়ল, পর দিন, ১০ জানুয়ারি 'কালের কণ্ঠ' নামে একটি নতুন বাংলা দৈনিক ঢাকা থেকে আত্মপ্রকাশ করবে। প্রথম প্রকাশের প্রথম সংখ্যাতেই দেশের নামিদামি লেখকদের সঙ্গে আমার লেখাও থাকবে। সংখ্যাটি ভোরে উঠেই দেখার প্রচণ্ড আগ্রহ হলো। কিন্তু একটি নতুন পত্রিকা। ঢাকার এত দূরে- উত্তরবঙ্গের এক শহরে বসে ওই দিনই হাতে পাব কি?
সার্কিট হাউসের কেয়ারটেকারের সঙ্গে আলাপ করলাম। তিনি আমাকে শোনালেন বিস্ময়কর কথা। বললেন, তিনি শুনেছেন, ১০ জানুয়ারির প্রথম প্রহরেই রংপুরে 'কালের কণ্ঠ' পাওয়া যাবে। পত্রিকাটির নামটি সবার কাছেই পরিচিত এবং চাহিদা এত বেশি যে হকারকে এখনই অগ্রিম টাকাসহ অর্ডার দিয়ে না রাখলে কাগজটি পাওয়া যাবে না। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাছে অগ্রিম টাকা দিলাম। বললাম, ভোরে ঘুম থেকে উঠেই যেন কাগজটি হাতে পাই।
পর দিন, ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই প্রথম সংখ্যা 'কালের কণ্ঠ' হাতে পেলাম। প্রথমেই চোখ পড়ল বাজারের অন্য সব পত্রিকার চেয়ে উৎকৃষ্ট নিউজপ্রিন্টে কাগজটি ছাপা। মাস্তুলে 'কালের কণ্ঠ' নামটি লেখা হয়েছে চমৎকার আধুনিক স্টাইলে। অন্যান্য কাগজের চেয়ে এই কাগজের অঙ্গসজ্জা অধিক আকর্ষণীয়। প্রতিটি বিভাগের লেখায় বিষয়-বৈচিত্র্য রয়েছে এবং সংবাদ পরিবেশনে পক্ষপাতিত্বহীনতা দৃশ্যমান।
বলতে দ্বিধা নেই, জীবনের পরিণত বয়সে এসে 'কালের কণ্ঠ' দেখে অপরিণত বয়সের আবেগতাড়িত আনন্দ ও উত্তেজনা লাভ করেছিলাম। মনে হলো, পত্রিকাটি বাংলাদেশে সংবাদপত্র প্রকাশনার ক্ষেত্রে এক নতুন দিকনির্দেশনা দেবে। হয়তো বা পত্রিকাটি তার সমকালের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সাহসী ও নিরপেক্ষ একটি কণ্ঠ হয়ে উঠবে এবং দেশের বাংলা সাংবাদিকতায় একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে।
'কালের কণ্ঠ' নামে একটি দৈনিকের আত্মপ্রকাশের কথা যখন আমার কাছে প্রথম বিজ্ঞাপিত হয়, তখন ভেবেছি, এই পত্রিকা-কণ্টকিত দেশে আরেকটি নতুন পত্রিকার দরকারটা কী? যে দেশে প্রত্যহ চলছে সংবাদ পরিবেশনের নামে সংবাদ-বিকৃতি, প্রচারের নামে অপপ্রচার ও সাংবাদিকতার নামে অপসাংবাদিকতা, সে দেশে কালের কণ্ঠ কী নতুন বাণী ধারণ করবে তার কণ্ঠে? সব বিষ নিজ কণ্ঠে ধারণ করে যে দেবতা নীলকণ্ঠ হয়ে বিশ্ববাসীকে অমৃত বিলিয়েছিলেন, কালের কণ্ঠ কি পারবে এই অপসাংবাদিকতার যুগে নিজ কণ্ঠে গরল ধারণ করে তার পাঠকদের সত্যম-শুভম ও সঠিক সমাচার পৌঁছে দিতে?
গত তিন বছরে কালের কণ্ঠ যদি তা পেরে থাকে তাহলে তার জন্ম সার্থক। যদি কোনো কারণে তা না পেরে থাকে বা কিছুটাও পেরে থাকে, তাহলে তাকে আত্মানুসন্ধান করতে হবে, কোথায় সেই বিচ্যুতি? এই বিচ্যুতি এড়িয়ে তাকে কণ্টকাস্তীর্ণ যাত্রাপথ আবার সুগম করতে হবে, পাঠকদের জন্য কণ্ঠের ধ্বনি সদর্থবহ করে তুলতে হবে। ২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি কালের কণ্ঠ চার বছরে পদার্পণ করল। আমার চোখে গত তিন বছরে তার বড় সাফল্য, এত স্বল্প সময়ে বাংলাদেশের পত্রিকা-অরণ্যে সে বনস্পতি হয়ে উঠতে না পারলেও পাঠক ঠকিয়ে যেসব পত্রিকা বনস্পতি হওয়ার দাবিদার হতে চাইছে, তাদের দম্ভ চূর্ণ করে তাদের পাশেই সে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে। এদিক থেকে মাত্র তিন বছরে পত্রিকাটির সাফল্য কম নয়।
বাংলাদেশের সংবাদপত্র একুশ শতকে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করেছে; সর্বাঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির ছাপও বহন করছে। ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক ও দলীয় মালিকানার বদলে ব্যবসায়ী মালিকানা স্থান দখল করেছে। তাতে সংবাদপত্রের ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক বিকাশ দ্রুততর হয়েছে। কিন্তু তার আত্মিক ও আদর্শিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। এটা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সারা বিশ্বের সংবাদপত্র শিল্পের জন্যই সত্য। পচনশীল ধনবাদী সমাজের অবক্ষয়ের চিহ্ন সমাজের অন্যান্য অংশের মতো তার সাংবাদিকতার জগৎকেও স্পর্শ করেছে। সৎ সাংবাদিকতা এই অবক্ষয় ও আদর্শ স্খলনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে এবং অসাধু সাংবাদিকতা তার ধন ও ক্ষমতার দ্বারা এই যুদ্ধকে পরাস্ত করতে চাইছে। অসৎ ও অসাধু সাংবাদিকতা এখন ধনবাদী বিশ্বের হাতে আণবিক বোমার চেয়েও বিপজ্জনক অস্ত্র।
পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার দ্বারা যেমন মানবজীবনকে সমৃদ্ধ ও মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তেমনি সৎ সাংবাদিকতাকেও সমাজ ও মানবকল্যাণে নিরপেক্ষভাবে ব্যবহার করে জগৎকে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধিময় করে তোলা যায়। কিন্তু ধনবাদী বিশ্ব পরমাণু অস্ত্রের মতো সংবাদপত্রসহ মিডিয়াশক্তিকে তাদের আধিপত্য বিস্তার ও প্রচারযুদ্ধের কাজে অনবরত ব্যবহার করার ফলে উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে সব দেশে সাংবাদিকতা এখন জনগণকে সঠিক তথ্য সরবরাহ ও সঠিক দিকনির্দেশনার কাজে ব্যবহৃত হওয়ার বদলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের এই অবাধ প্রভাব বিস্তারের যুগে বাংলাদেশের সাংবাদিকতাও এই নতুন দানবের কবল থেকে মুক্ত থাকতে পারছে না।
এই পরিস্থিতি যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য যে সাংবাদিকতা পেশার মধ্যে কোথাও যেন সততা ও আদর্শের একটি ক্ষীণাঙ্গী ভোমরা লুকিয়ে থাকে, যাকে শত চেষ্টাতেও হত্যা করা যায় না। বাংলাদেশেও আমরা এই সত্যের প্রতিফলন দেখছি সংখ্যালঘু হলেও কিছু সাংবাদিক ও সংবাদপত্র ও বৃহত্তরভাবে মিডিয়ার মধ্যে। প্রচার সংখ্যার অতিরঞ্জিত বিজ্ঞাপন দ্বারা নয়, সৎ সাংবাদিকতার এই কষ্টিপাথরে পরীক্ষিত হয়ে কালের কণ্ঠ গত তিন বছরে কতটা এগোতে পেরেছে তার একটা পরিমাপ করা যায় কি?
আমি শুধু কালের কণ্ঠের একজন লেখক নই, শুরু থেকে পত্রিকাটির একজন পাঠকও। গত তিন বছরে পত্রিকাটির কোনো পদস্খলন ঘটেনি, এমন কথা বলব না। কিন্তু সেই পতন ও পদস্খলন থেকে উঠে এসে অসৎ সাংবাদিকতার বনস্পতিগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানাতে এবং তাদের দৌরাত্ম্য অনেকটা প্রতিরোধে সে একেবারে ব্যর্থ হয়নি। বয়সের হিসাবে তিন বছর বেশি নয়। বাংলাদেশে সংবাদপত্র জগতে শিশুমৃত্যুর হার যেখানে বেশি, সেখানে নানা বাধাবিঘ্নের মুখে কালের কণ্ঠের কৈশোরে পা দেওয়া কম সাফল্যের কথা নয়।
সব নতুন সংবাদপত্রই সাংবাদিকতায় নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে না। কালের কণ্ঠের সৌভাগ্য সে সেটা পেরেছে। একটি সংবাদপত্রের সাফল্যের মাপকাঠি শুধু পুরনো পাঠক গোষ্ঠীর মধ্যে বিচরণ নয়, নতুন পাঠক সৃষ্টি করা। কালের কণ্ঠ সেটি পেরেছে। তার আরেকটি সাফল্য, সে পুরনো প্রজন্মের সঙ্গে নতুন প্রজন্মেরও কণ্ঠধ্বনি। অধুনা সাহিত্য ও সাংবাদিকতার মধ্যে যে সহদোরা সম্পর্ক, কালের কণ্ঠে তার যথাযথ প্রতিফলন ঘটেছে। এখানে কেবল একটি প্রশ্ন, নির্ভয় ও পক্ষপাতহীন সংবাদ প্রচারে ও মন্তব্য প্রকাশে সে কি বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় একটি উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছে? যদি কোনো কারণে না পেরে থাকে, তাহলে আমার মতে, চার বছরে পা দিয়ে কালের কণ্ঠের কাজ হবে সেই উদাহরণ সৃষ্টির জন্য সাহসের সঙ্গে সক্রিয় হওয়া।
কালের কণ্ঠের কাছে আমার অনুরোধ, বাংলাদেশের মিডিয়া এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেতিবাচক সাংবাদিকতায় পূর্ণ। জনগণের মনোবল ও নৈতিক শক্তি তা ভেঙে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক সাংবাদিকতার সাহসী আত্মপ্রকাশ প্রয়োজন এবং কালের কণ্ঠের উচিত এই ইতিবাচক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হওয়া। বাংলাদেশ সব সমস্যা ও সংকটের মধ্য দিয়েও সামনের দিকে এগোচ্ছে। দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের প্রাবল্যের মধ্যে তার বিরুদ্ধে সংগ্রামটাও কি দৃশ্যমান নয়? জাতীয় জীবনে অনৈক্যের কথা আমরা বলি। কিন্তু ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জাতি কি ইস্পাত-কঠিন ঐক্যের পরিচয় দেখাচ্ছে না? আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে এত সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশের অগ্রগতি আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থার দ্বারা প্রশংসিত। বাংলাদেশের মানুষ দেশে গুড গভর্ন্যান্সের অভাব ও নানা অরাজকতার মধ্য দিয়ে নানা সমস্যা ও সংকটের অকূল সমুদ্র পাড়ি দিয়েও কূলের দিকে এগোচ্ছে, তার গতি স্লো বাট স্টেডি; এই সত্য তরুণ ও নতুন প্রজন্মের মনে গেঁথে দেওয়া দরকার।
জাতির মননে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের হতাশ মানসে এই সত্যটি একবার গেঁথে দেওয়া গেলে এ জাতি আবার দাঁড়াবে। এককালের আফিমখোর ও হতদরিদ্র চীনা জাতি যদি আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে এবং মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে বিশ্বের সেরা সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি কেন পারবে না, 'ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত, আমরা আনিব রাঙা প্রভাত' এই প্রত্যাশা সার্থক করতে? দরকার, জাতির মনে বলিষ্ঠ আশাবাদ। সব রাজনৈতিক ভ্রষ্টতার মধ্যে সৎ ও ভয়হীন সাংবাদিকতাই পারে জাতির মনে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সেই আশাবাদ জাগিয়ে তুলতে।
অনেক পতন-স্খলন, ত্রুটি-বিচ্যুতির মধ্যেও 'কালের কণ্ঠ' যদি পারে এই আশাবাদের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হতে, বর্তমানের নেতিবাচক সাংবাদিকতার যুগে ইতিবাচক সাংবাদিকতার অগ্রদূত হতে, তাহলে কালের কণ্ঠের মাথায় আমি শিরোপা পরাব, বলব যুগ যুগ জিয়ো এবং সর্বকালের বাঙালির আশা ও ভরসার কণ্ঠস্বর হও।
লন্ডন, ৯ জানুয়ারি, বুধবার, ২০১৩

No comments

Powered by Blogger.