হোসে মার্তি অশানত্ম কাগজের সমুদ্র by মামুন রশীদ

ইউরোপ থেকে সমুদ্রপথে ক্রমাগত দৰিণে না গিয়ে যদি উত্তরে যাওয়া যায়, তাহলেও কি ভারতবর্ষে পেঁৗছানো সম্ভব? এ প্রশ্নের উত্তর জানা যতটা না জরম্নরী, তারচেয়ে সাম্রাজ্যবাদের থাবা বাড়ানো আরও বেশি জরম্নরী ছিল। আফ্রিকা, আফ্রিকা ছাড়িয়ে আরও নতুন, পৃথিবীর আরও নতুন নতুন প্রানত্মে শাসন এবং শোষণের ছড়ি ঘোরানোর প্রয়োজন ছিল আরও বেশি।
ইউরোপে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ, প্রভুত্বের দাম্ভিকতা, নতুন ভূমি, সোনা, হীরা, মুক্তা, নতুন সম্পদ আহরণের প্রশ্ন ছিল অনেক বেশি জরম্নরী। তাই নতুন দেশ আবিষ্কার নয়, বরং সহজে দ্রম্নত ভারতবর্ষে পেঁৗছানোর পথ খুঁজতে বেরিয়েছিলেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস। স্পেনের রানী ইসাবেলার সহযোগিতায় ১৪৯২ সালে তিনটি জাহাজ আটলান্টিকের বুকে ভাসে। উত্তাল আটলান্টিকের ঝড়, ঝঞ্ঝা, ঢেউ পার হয়ে প্রশানত্ম মহাসাগর পেরিয়ে দুই মাসেরও বেশি সময় পর জাহাজ স্থলভূমির দেখা পায়। কলম্বাস ভুল বুঝেছিলেন, ভেবেছিলেন তিনি ভারতবর্ষের কোন অনাবিষ্কৃত অংশে এসেছেন। ষোলো শ'র বেশি দ্বীপের সমষ্টি এই দ্বীপদেশটি আবিষ্কৃত হলো ১৪৯২ সালের ৩ আগস্ট, যা আজকের কিউবা। নৃশংস সাম্রাজ্যবাদ স্পেন নতুন ভূখ-ে নিজেদের পূর্ণ মনোযোগ দিল। সেই পূর্ণতা এলো ১৫১০ সালে। নিরীহ কিউবানদের কান্না, নির্যাতন, রক্ত, দুঃখ, হতাশা, নিপীড়ন আর অত্যাচারের মাধ্যমে শেষ হলো স্পেনের কিউবা বিজয় অভিযান। স্পেনীশদের নির্মম অত্যাচারে হারিয়ে যেতে থাকল ক্রিস্টোফার কলম্বাস কথিত রেড ইন্ডিয়ানরা। শুধু জমি নয়, জমির প্রয়োজনে স্থানীয় অধিবাসীরা বন্দুকের মুখে, নির্যাতনে, অত্যাচারে দাস হিসেবেও ব্যবহৃত হতে থাকল। তাদের অত্যাচার ছিল নির্মম। কলম্বাস যখন এই ভূখ-ে আসেন তখন জনসংখ্যা ছিল প্রায় দু'লাখ। সময়টা ১৪৯২। মাত্র পঁয়তালিস্নশ বছর পর দ্বীপদেশটির জনসংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচ হাজারে।
সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরম্নদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে উঠতে অনেক সময় পেরিয়ে যায়। প্রায় তিন শ' বছর। ১৮২০ থেকে ১৮৯৮ পর্যনত্ম পুরো সময়টাতেই কিউবার স্বাধীনতা সংগ্রাম কখনও ধীর গতিতে আবার কখনও খুব তীব্রভাবে সংঘটিত হয়। ইতোমধ্যে স্পেনের রাজা সপ্তম ফার্দিনান্দের মৃতু্যতে কিউবার শাসকরা আরও অত্যাচারী শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয় এই জনগোষ্ঠীর ওপর। তাদের অত্যাচারে হাজার হাজার বিপস্নবী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যেতে বাধ্য হন। সেখান থেকেই তারা গড়ে তোলেন বিপস্নবী দল।
কিউবার ইতিহাসে ১৮৬৮ বছরটি খুবই গুরম্নত্বপূর্ণ। এ বছর শুরম্ন হয় গৃহযুদ্ধ। থামে ১৮৭৮-এ। অসফল এক যুদ্ধ। তবু কিউবায় স্পেনীয় শাসনের বিরম্নদ্ধে প্রথম গৃহযুদ্ধ। এ সময় স্পেন-আফ্রিকাসহ বিভিন্ন জায়গায় তার উপনিবেশ হারাতে শুরম্ন করেছে। শেষ সম্বল এই একটি মাত্র উপনিবেশ রৰা করতে স্পেনও সর্বশক্তি নিয়োগ করে। যুদ্ধের শুরম্ন ১৮৬৮ সালের ১০ অক্টোবর। কিউবার দাস মালিক লা দেমাজাগুয়াতে কারলোস ম্যানুয়েল ডি সিসিপেডেসের ঐতিহাসিক 'গ্রিডো ডি ইয়ারা' ঘোষণার মাধ্যমে এ যুদ্ধের শুরম্ন।
দশ বছরের যুদ্ধ শেষে স্পেন তার নীতিতে কিছু পরিবর্তন আনে। দাসপ্রথা বদল করে। এ সময় কিউবার অর্থনীতিও দুর্বল হয়ে পড়ে। রাজনীতির মঞ্চে দেখা দেন কার্লোস মানুয়েল দে সেসপেদেস ও আগিলেরার মতো জাতীয়তাবাদী নেতা। তাঁরা কিউবার স্বাধীনতার জন্য গেরিলাযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন, যা স্পেনের ঔপনিবেশিকতার ভীত কাঁপিয়ে দেয়। স্বাধীনতা তখন শুধু সময়েরব্যাপার। এর মাঝে কিউবার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্বাধীনতা সংগ্রামী, কবি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও চিনত্মানায়ক হোসে মার্তি যুদ্ধৰেত্রে প্রাণ হারান। তাঁর মৃতু্যতে কিউবার স্বাধীনতার সংগ্রাম শেষ হয়ে যায়নি, বরং এই কিংবদনত্মি বীরের মৃতু্যতে পুরো কিউবায় বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। জেগে ওঠে কিউবার মানুষ। পুরো কিউবা।

জন্ম, শৈশব এবং প্রথম যৌবন
হোসে মার্তি_ মুক্তিযোদ্ধা এবং কবি। মুক্ত কিউবায় তিনি কখনই ছিলেন না। তবুও তিনি কিউবানদের জাতীয় বীর। জন্ম ১৮৫৩ সালের ২৮ জানুয়ারি, কিউবায়। শরীরে খাঁটি স্পেনীশ রক্ত। বাবা মারিয়ানো মার্তি নাভারো। স্পেনীশ সেনাবাহিনীর কর্নেল। মা, লিওনার পেরেজ ক্যাবরেরা। মারিয়োনো মার্তি এবং লিওনার পেরেজ দম্পত্তি পরিবারে ছেলে হোসে মার্তি ছাড়াও ছিল সাত মেয়ে। হোসে মার্তি যখন খুবই ছোট সে সময় তার বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই তাদের পুরো পরিবার কিউবা থেকে ফিরে যায় স্পেনে। সে যাওয়া বেশি দিনের জন্য ছিল না। দু'বছরের মাথাতেই তারা কিউবায় ফিরে আসেন। মেধাবী হোসে মার্তি ছেলেবেলাতেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। শিল্পকর্মের মাধ্যমে টিনএজেই সবার মনোযোগ নিজের দিকে টেনে নেবার ৰমতা দেখান। সহপাঠী এবং পরিচিত মহলে তার নাম ছড়িয়ে পড়তে শুরম্ন করে। তবে তিনি সহসাই লৰ্য করেন, এভাবে নয়, আরও একটু ভিন্নভাবে নিজেকে মেলে ধরা যায়। নিজের কথা বলা যায়। শিল্পের আরও একটি মাধ্যম আছে, যা তিনি এ সময়েই লৰ্য করেন। সে মাধ্যমে লেখালেখি। মাত্র ষোলো বছর বয়সেই তিনি সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় লিখতে শুরম্ন করেন। তার কবিতাও প্রকাশিত হতে থাকে।

জেল এবং মুক্তি
১৮৬৯ সালে প্রথম স্পেন সরকারের তোপের মুখে পড়েন। এ সময় নিজের লেখার জন্য ভয়াবহ সমস্যায় পড়েন হোসে। দশ বছরের যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত এ সময়ে কিউবা থেকে স্পেনিশদের তাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। স্পেনিশ সাম্রাজ্যের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য এ যুদ্ধে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়ে কিউবা। কিউবার স্বাধীনতাপাগল মানুষের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়ে স্পেনিশ শাসকগোষ্ঠী। এ সময় স্পেনীশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্তি, স্থানীয় ভূমি মালিকদের সঙ্গে বিরোধ এবং কিউবান দাসদের মুক্তি আন্দোলন একসঙ্গে পরিচালিত হতে থাকে। তরম্নণ হোসে মার্তি বিপস্নবীদের সমর্থন যোগান। হোসে সচেতনভাবেই বিপস্নবীদের পৰে কলম ধরেন। স্পেনীয় ঔপনিবেশিক শাসনে পুুরো কিউবা তখন অন্যায় ও অবিচারে ভরা। প্রতিদিন অত্যাচারের মাত্রা বাড়ছে। সেই অত্যাচারের প্রতিবাদ করেন হোসে মার্তি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শাসকের রক্তচৰু বিরূপ হয়ে ওঠে তাঁর প্রতি। রাজনৈতিক প্রতারণার দায়ে বন্দী হন হোসে। মাত্র ষোলো বছর বয়স তখন হোসের। কিন্তু তাতে কি, তিনি যে স্পেনীশ শাসকের জন্য ভবিষ্যতে হুমকি হয়ে উঠবেন না, তা কে বলতে পারে? তাই ভাবনাচিনত্মা করেই শাসকদল হোসে মার্তিকে ছয় বছরের সশ্রম কারাদ- প্রদান করে। জেলখানায় হোসের জন্য অপেৰা করছিল কঠিন সময়। তাকে পাথড় ভাঙ্গার কাজ দেয়া হয়। সেই সঙ্গে আরও বিভিন্ন রকম কষ্টকর, যন্ত্রণাদায়ক কাজ। আর পায়ে ও কোমরে বেঁড়ি তো ছিলই। পরিশ্রম এবং নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়েন হোসে মার্তি। তিনি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন যে, কারাকতর্ৃপৰ তাকে মাত্র এক বছরের মাথায় মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তবে সে মুক্তি তাকে কিউবায় থাকা নিশ্চিত করেনি। কিউবায় তাকে রাখা নিরাপদ মনে করেনি স্পেন কতর্ৃপৰ। তাই হোসে মার্তিকে স্পেনে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
স্পেনে মার্তি আইন বিষয়ে পড়ালেখা করেন। এ সময়ে তিনি আইনশাস্ত্রে ডিগ্রী আর্জনের পাশাপাশি মানুষের অধিকার আদায়ের বিষয়ে গুরম্নত্ব দেন। সঙ্গে কিউবার বিভিন্ন বিষয়ে নিজের লেখালেখি অব্যাহত রাখেন। এ সময়ে তার পায়েও দু'বার অস্ত্রোপচার করার প্রয়োজন হয়। কিউবার জেলে থাকার সময় তার শরীরের ওপর যে অত্যাচার হয়েছিল তার প্রভাবেই এ অস্ত্রোপচার। তিনি অবাল্যের বন্ধু ফারমিন ভারলেজ ডোমিনিগুয়েজের সঙ্গে ফ্রান্স ভ্রমণ করেন। ডোমিনিগুয়েজ কিউবার স্বাধীনতা আন্দোলনে অন্যতম ভূমিকা পালন করেন। এর পর ১৮৭৫-এ হোসে মার্তি মেক্সিকো পেঁৗছেন।

মেক্সিকো এবং গুয়াতেমালা
মেক্সিকোতে এসে তিনি বাবা-মায়ের দেখা পান। মাঝে পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর। এখানে তিনি প্রচুর লিখতে শুরম্ন করেন। লিখে নিজেকে প্রকাশ করা এবং নিজের দায়িত্ব নেবার মতো ৰমতা অর্জন করেন। কবিতা, অনুবাদ এবং পত্রিকায় কলাম লেখায় নিজেকে ব্যসত্ম রাখেন হোসে মার্তি। তিনি একটি নাটকও রচনা করেন। ুঢ়ধু ষড়াব নধপশ রিঃয ষড়াব.চ্ ভালবাসার মূল্য ভালবাসাতেই নামের নাটকটি মেক্সিকোর প্রধান থিয়েটারে অভিনীত হয়। ১৮৭৭ সালে ছদ্মনাম নিয়ে মার্তি আবার কিউবায় ফিরে আসেন। কারণ স্বনামে দেশে ফেরা তার জন্য সম্ভব ছিল না। অনুমতি ছিল না। কিন্তু তিনি কিউবায় ফিরে স্বসত্মি পাননি। শানত্মিতে কাজ করতে পারছিলেন না। বিরক্ত হোসে মার্তি তাই গুয়াতেমালায় যাবার সিদ্ধানত্ম নেন। এখানে তিনি শিৰকতা পেশায় যুক্ত হন। বছরের শেষদিকে হোসে মার্তি আবার মেক্সিকো ফিরে আসেন। মেক্সিকো এসে কারমেন জায়াস বাজানের সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। দিনটি ছিল ২০ ডিসেম্বর।

আবার নির্বাসন
কিউবার ইতিহাসে ১৮৭৮ সাল খুবই গুরম্নত্বপূর্ণ সময়। এ বছর রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দেশানত্মরীরা দেশে ফেরার অনুমতি পান। হোসে মার্তিও এ সুযোগ নেন। তিনি স্ত্রীকে নিয়ে দেশে ফেরেন। আইন পেশা চর্চার অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু তাকে সুযোগ দেয়া হয়নি। কিউবার 'দশ বছরের যুদ্ধ' শেষ হয়। অসফল এ যুদ্ধের তাৎপর্য, পরিণাম, পদ্ধতিগত বিভিন্ন দিক বিবেচনা করেন মার্তি। তিনি মনে করেন, কিউবার স্বাধীনতার জন্য দুই ধরনের কর্মপন্থা নিতে হবে। প্রথমত স্পেনিশদের সঙ্গে মৌখিক লড়াই চালু রাখতে হবে। সেইসঙ্গে মানুষের কাছে পেঁৗছাতে হবে স্বাধীনতার বার্তা। তাই বৈপস্নবিক ষড়যন্ত্র নেবার কথাও ভাবেন হোসে মার্তি।
১৮৭৯-এর মার্চে হাভানায় ঔপনিবেশিক শাসনের বিরম্নদ্ধে আক্রমণের কৌশল ঠিক করতে তখনকার কয়েক বিপস্নবীর একটি দল মিলিত হয়। হোসে মার্তিও ছিলেন দলটিতে। এ সময় তিনি নিজের চিনত্মাভাবনার কথা একটি নোটবুকে লিখে রাখতেন। এমনি এক লেখায় তিনি বলেন, 'স্বাধীনতার মূল্য অসীম। হয় কাউকে স্বাধীনতা ছাড়াই বেঁচে থাকার কথা ভাবতে হবে, অথবা তাকে নায্যমূল্য দিয়েই তা অর্জন করতে হবে।' ১৮৭৯-এর ২৭ এপ্রিল স্প্যানিশ গবর্নর জেনারেল র্যামন বস্ন্যাঙ্কোর উপস্থিতিতে তিনি সরাসরি কিউবার স্বাধীনতার স্বপৰে তাঁর মত প্রকাশ করেন। এ বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর বন্ধু গোমেজ ও তাঁকে স্প্যানিশ শাসনের বিরম্নদ্ধে চক্রানত্মের আভিযোগে আটক করা হয়। আটক হবার আটদিন পর তাঁকে আবার নির্বাসনে পাঠানো হয়। স্পেনে নির্বাসনে কয়েক মাস থাকার পর তিনি ফ্রান্সে চলে যান। ফ্রান্স থেকে ১৮৮০-এর ৩ জানুয়ারি চলে আসেন নিউইর্য়কে।

নিউইয়র্কে
হোসে মার্তির শরীরে ছিল স্প্যানিশ রক্ত। কিন্তু কিউবার স্বাধীনতা, নির্যাতিত মানুষের মুক্তির জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত। ফ্রান্স থেকে নিউইয়র্ক পেঁৗছেই তিনি এখানে নির্বাসিত কিউবানদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেন। এখানে সংবাদপত্রের সঙ্গেও নিজেকে পুরোপুরি জড়িয়ে ফেলেন; যা তাকে পরিচিতি করে তোলে সমসত্ম লাতিন আমেরিকায়। সাংবাদিকতার সূত্রে আর্জেন্টিনা, উরম্নগুয়ে, ভেনিজুয়েলা, মেক্সিকো, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, কোস্টারিকায় হোসে মার্তির কাজের পরিধি ছড়িয়ে পড়ে। বিপস্নবকে ছড়িয়ে দেবার জন্য প্রয়োজন লেখালেখি। এটা ভালভাবেই অনুভব করেছিলেন মার্তি। তাই নিজের চিনত্মা, বিপস্নবের ধারণা, স্বাধীনতা অর্জনের অধিকারের কথা ছড়িয়ে দিতে থাকেন লেখায়। এ সময় দশ বছরের যুদ্ধের অভিজ্ঞ সৈনিক জেনারেল কালিকসটো গার্সিয়ার নেতৃত্বে গঠিত হয় কিউবান রেভু্যলুশনারি কমিটি অব নিউইয়র্ক। এই কমিটির সঙ্গেও নিজের যোগাযোগ বাড়াতে থাকেন হোসে মার্তি। যোগ দেন কমিটিতে। ১৮৮০ সালের ২৪ জানুয়ারি নিউইয়র্কে কমিটি সভায় হোসে মার্তি যে ভাষণ দেন তাতে উদ্বুদ্ধ হয় শ্রোতারা। কিউবার স্বাধীনতার জন্য নতুন প্রেরণা জেগে ওঠে সবার মাঝে। তারা নতুন করে লড়াইয়ের জন্য উজ্জীবিত হয়। স্বাধীনতার জন্য হোসে মার্তির দৃঢ়চেতা মনোভাব তাকে এই কমিটির অনত্মর্বর্তী প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয়। এ সময় হোসে মার্তির পরিচিতি আরও বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন, শত্রম্নকে পরাজিত করে ছিন্নভিন্ন করবার বদলে অসফলভাবে হেরে যাওয়ার চেয়ে যুদ্ধ বন্ধ করে দেয়া উচিত। জনসমর্থন থাকলে অল্পসংখ্যক মানুষ নিয়েও যুদ্ধে সফল হওয়া সম্ভব। কারণ, জনসমর্থন ছাড়া বিপস্নবীদের এক সময় দসু্যদল বলে মনে হতে পারে। এ বিশ্বাস থেকেই তিনি ১৮৮০ সালে কিউবায় বিপস্নবের নেতৃত্বে থাকা জেনারেল এমিলো নুনেজকে যুদ্ধ বন্ধ করা জন্য চিঠি লেখেন।
হোসে মার্তি নিজেকে কিউবান বিপস্নবের জন্য পুরোপুরি উৎসর্গ করেছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে তাঁর বাবা ও স্ত্রীর সমর্থন ছিল না। তাদের সমর্থন ছিল স্পেনীশদের প্রতি। অন্যদিকে হোসে মার্তির মা সনত্মানকে সমর্থন করেছেন পুরোটাই। এমনকি হোসে মার্তির একমাত্র ছেলেও বাবাকে সমর্থন করেনি। মায়ের কাছে থাকার কারণে সে মায়ের আদর্শই অনুসরণ করেছে।
কিউবার স্বাধীনতার জন্য মার্তির আকুতি ছিল অনেক গভীর। দশ বছরের যুদ্ধের প্রথম সারির নেতা ডোমিনিকান রিপাবলিকের অধিবাসী জেনারেল ম্যাক্সিমো গোমেজকে লেখা এক চিঠিতে হোসে মার্তি নিজেকে কিউবার বিপস্নবের জন্য উৎসাহী নবীন বিপস্নবী হিসেবে অভিহিত করে বলেন, 'জেনারেল, সমসত্ম দেশ ঘুরে ঘুরে তুমি হয়ত জানো যে, আমাদের দেশটা আয়তনে যত ছোটই হোক না কেন আমাদের কাজের পরিমাণ অনেক বেশি। আর যে তাঁর ভালবাসা, চিনত্মা ও ধৈর্যের মধ্যদিয়ে এই বিশালতা অনুভব করতে পারবে না তাঁর পৰে এই দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত হবে না।'
১৮৮৪ সালে কিউবার ভেতরে-বাইরে আন্দোলন ছড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা করেন মার্তি। এ জন্য তিনি জেনারেল গোমেজ ও জেনারেল অ্যান্টেনিও ম্যাসিওর সঙ্গে আলোচনায় বসেন। কিন্তু আন্দোলনের পদ্ধতি, নেতৃত্বের বণ্টন এবং স্বাধীন কিউবার সরকার গঠন বিষয়ে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। ফলে সে বৈঠক সফল হয়নি। পরিষ্কার ধারণা ছাড়া কোন আলোচনা এগিয়ে নিতে রাজি ছিলেন না মার্তি।
১৮৮৭ থেকে ১৮৯৪ পর্যনত্ম সময়ে মার্তি ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন স্থানে কিউবার স্বাধীনতার জন্য বক্তৃতা করেন। এসব বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি জনগণের অনুভূতি আর স্বাধীনতার জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। ১৮৮৭ সালের শেষে কিউবান বিপস্নব এগিয়ে নিতে একটি অস্থায়ী কার্যনির্বাহী সমিতি করা হয়। সমিতি প্রধানের দায়িত্ব পান হোসে মার্তি। কিউবান বিপস্নব সফল করতে স্বদেশপ্রেমিক সবাইকে একত্রে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়। স্বাধীনতার সপৰের শক্তিগুলোকে একজোট করার জন্য উপযুক্ত সময় মনে করে এ সময় একুশ কিউবান স্বদেশপ্রেমিকের স্বাৰর করা একটি চিঠি পাঠানো হয় জেনারেল গোমেজকে। কারণ, হোসে মার্তি মনেপ্রাণে বিপস্নবের সাফল্যের জন্য দিন গুনতেন। তাই নিজেদের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচিয়ে আনার গুরম্নত্ব অনুভব করতেন। ফোরিডার টাম্পা শহরে কিউবান সাহিত্য সমিতিতে 'সকলের ভালর জন্য সকলে একসঙ্গে' শিরোনামে ১৮৯১ সালে ২৫ নবেম্বরে বক্তৃতা করেন হোসে মার্তি। এ বক্তৃতায় কিউবার স্বাধীনতার গুরম্নত্ব উলেস্নখ করে তিনি বলেন, কিউবাবাসীর স্বপ্নে এখন কিউবার স্বাধীনতার আগ্রহ আর অপেৰা। এই স্বপ্ন পূরণের জন্য সকলকে একসঙ্গে আন্দোলন করতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে প্রতিটি কিউবানকে।' ১৮৭১ সালে স্পেনীশরা হাভানায় আট চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করে। এ নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনা হোসে মার্তিকে আড়োলিত করে তোলে। তিনি এর পরে প্রতিটি বক্তৃতায় এই হত্যাকা-ের প্রতিবাদ করেন এবং এ ধরনের মৃতু্যর উচ্চ প্রশংসা করে বলেন, 'এ ধরনের মৃতু্যতে যেমন কষ্ট আছে তেমনি আছে আনন্দ। তাই আমাদের মাঝে কে হবে এই ত্যাগের পদযাত্রায় প্রথম?'
১৮৯২ সালের ১০ এপ্রিল কিউবান রেভুলু্যশনারি পার্টি প্রকাশ্যে ঘোষিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত থাকা কিউবান বিভিন্ন দল আনুষ্ঠানিকভাবে এই পার্টির কথা ঘোষণা করে। হোসে মার্তি পার্টির প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। আর এর মাধ্যমে তিনি সরকারীভাবে কিউবার মুক্তি সংগ্রামের প্রধান নেতৃত্বে পরিণত হন। বছরের শেষদিকে হোসে মার্তি কিউবা আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে শুরম্ন করেন। কিভাবে যুদ্ধ শুরম্ন হবে? কিভাবে নেতৃত্ব দেবেন? এ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ছুটে বেড়ান মার্তি। রেভু্যলুশনারি পার্টির সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরম্ন করেন। এগিয়ে চলে পরিকল্পনা। জেনারেল গোমেজ এ সময় মার্তির সঙ্গে আলোচনার জন্য নিউইয়র্ক আসেন। যুদ্ধের জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থের। হোসে মার্তি ছুটে চলেন বিভিন্ন দেশে।
অস্ত্র কেনার প্রয়োজনেই অর্থ সংগ্রহ। জাহাজ সংগ্রহ। এবার শত্রম্নপৰের ওপর সরাসরি আক্রমণ। তিনটি জাহাজে বিপস্নবীরা বিভিন্ন দিক থেকে কিউবা আক্রমণের পরিকল্পনা করে। অস্ত্রেসজ্জিত প্রতিটি জাহাজ। একটিতে নেতৃত্ব দেবেন জেনারেল অ্যান্টোনিও ম্যাসিও ও জেনারেল ফোর। অপর একটিতে মার্তি স্বয়ং। প্রস্তুতি সম্পন্ন। ঠিক সেই মুহূর্তে কারো বিশ্বাসঘাতকতায় প্রকাশ হয়ে যায় পুরো পরিকল্পনা। ১৮৯৫ সালের ১২ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার জাহাজসহ অস্ত্রশস্ত্র বাজেয়াপ্ত করে। এ ঘটনায় হোসে মার্তির প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস আরও বাড়ে।
আবার নতুন পরিকল্পনা সাজান মার্তি। তিনি অপেৰা করতে থাকেন কিউবা থেকে বিদ্রোহ শুরম্নর। ১৮৯৫ সালের ২৬ ফেব্রম্নয়ারি জানা যায়, কিউবায় যুদ্ধ শুরম্ন হয়েছে। এ বছরের ১ এপ্রিল মার্তি তার সমসত্ম লেখা এবং পা-ুলিপির লিটারেরি উইল সম্পন্ন করে যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি নেন। ১১ এপ্রিল তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে কিউবার দৰিণ উপকূলের মাইসি অনত্মরীপে পেঁৗছেন। ১৫ এপ্রিল হোসে মার্তিকে মেজর জেনারেলের সম্মানিত পদ দেয়া হয়। নতুন দায়িত্বে মার্তি বিস্মিত হলেও নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে ছিলেন সচেতন। ২৬ এপ্রিল মার্তি ও গোমেজ এক ঘোষণা করেন, কিউবার স্বাধীনতা সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হওয়া পর্যনত্ম আত্মসমর্পণ নয়। লড়াই চলবে।
১৭ মে খবর আসে একটি স্প্যানিশ সৈন্যদল তাদের বিপস্নবীদের ক্যাম্পের আশপাশেই কোথাও পাহারায় রয়েছে। তাই জেনারেল গোমেজ শিবিরে হোসে মার্তিকে রেখে একটি ছোট দলের সঙ্গে স্প্যানিশদের আক্রমণের জন্য বেরিয়ে পড়েন। স্পেনিশ সেনাদের দেখা না পেয়ে ১৯ তারিখ গোমেজ দল নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসেন। এর মাঝে দলে আরও কিছু যোদ্ধা যোগ দেয়। স্প্যানিশদের আক্রমণ করতে গোমেজ আবার বেরিয়ে পড়েন নতুন দল নিয়ে। যাবার আগে তিনি হোসে মার্তিকে শিবিরে অবস্থান করার কথা বলেন। কিন্তু খুব দ্রম্নত জেনারেল গোমেজের দলটি বিপদের মুখে পড়ে। হোসে মার্তি দলটিকে সাহায্য করার জন্য একাই ঘোড়ায় চেপে বেরিয়ে পড়েন। উপস্থিত হন যুদ্ধের ময়দানে। সে সময় এক স্প্যানিশ সৈন্য তাঁকে চিনে সরাসরি গুলি করে। মুহূর্তেই যুদ্ধৰেত্রে চিরনিদ্রায় ঢলে পড়েন হোসে মার্তি। তাঁর প্রাণহীন দেহটি ১৮৯৫-এর ২৭ মে সান্টিয়াগো দে কিউবায় সমাহিত করা হয়।
হোসে মার্তি মার্কসবাদী ছিলেন না। কিন্তু তার চিনত্মা, তার লড়াই ছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরম্নদ্ধে। তৃতীয় বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ে তিনি ছিলেন অগ্রপথিক। বিপস্নবী আন্দোলনে সাধারণ মানুষের উলেস্নখযোগ্য ভূমিকার গুরম্নত্ব উপলব্ধি করে লাতিন আমেরিকা তথা সমগ্র বিশ্বকে তিনি নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। কিউবা আর সমগ্র লাতিন আমেরিকায় স্পেনীয় উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন আগ্রাসন যে ভবিষ্যতে বিরাট বিপদ ডেকে আনবে এ ব্যাপারে হোসে মার্তি বিভিন্ন লেখায়, বক্তৃতায় ও চিঠিপত্রে বার বার উলেস্নখ করেছেন।
লাতিন আমেরিকা বলতেই চোখের সামনে নির্যাতিত মানুষের মুক্তি, স্বাধীনতা, ঔপনিবেশিকতার বিরম্নদ্ধে, অন্যায়ের বিরম্নদ্ধে প্রতিবাদে ভেসে ওঠে মহান সংগ্রামী নেতাদের মুখচ্ছবি। স্বাধীনতা, অন্যায় এবং মানুষের মুক্তি সংগ্রামের যে লড়াই পরবর্তীতে সূচিত হয়েছে তার মশাল জ্বালিয়েছিলেন হোসে মার্তি। তিনি বিপস্নব দেখে যেতে পারেননি। স্বাধীন কিউবাতে থাকতে পারেননি। কিন্তু স্বাধীনতার প্রেরণা জ্বালিয়েছিলেন, অন্যতম প্রেরণার উৎস হয়ে ছিলেন, থাকবেন। সাম্রাজ্যবাদী চেতনার শেষ প্রদীপ নিভিয়ে দিতে হোসে মার্তি আজও পুরো বিশ্বে যেখানেই মুক্তি সংগ্রাম, যেখানেই বৈপস্নবিক রূপানত্মর সেখানেই অনুপ্রেরণার উৎস।
সধসঁহথৎধংযরফ৩০০০@ুধযড়ড়.পড়স



হোসে মার্তির কবিতা
১০ই অক্টোবর

স্বপ্ন নয়, এ সত্যি;
এই যে রণহুঙ্কার_ এই ক্রোধোন্মত্ততা
এও তো জনতার এক ধারালো হাতিয়ার,
তিনটি শতাব্দী ধরে
যে জনগণ সহ্য করেছে মানবাত্মার বহু অপমান।

অত্যাচারের শৃঙ্খলে
শৃঙ্খলিত শত শত কালোমানুষের দল,
উন্মুক্ত প্রানত্মর থেকে
বিসত্মীর্ণ পাহাড়ের সারি
গর্জে উঠেছে কামান,
মানুষকে পিষে
চলে গেছে কত যুদ্ধ_
বর্বর সেই আগ্রাসককে
কাঁপিয়ে দেওয়া হয়েছে বারবার,
চাপা কান্নার দমকে
ৰীণ হয়েছে অত্যাচারের স্মৃতি।

তোমার শক্তি আর সাহসের নির্ভীক প্রকাশে
গ্রামে গ্রামে আজ স্মৃতিসৌধ,
তোমার সংগ্রামের ব্যাপ্তি
মুছে দিয়েছে কাপুরম্নষত্বের কলঙ্কজনক দাগ।

মৃতু্য ও আমি
ছেড়ে যাব যেদিন এ পৃথিবীর মাটি
যাব আমি প্রকৃতির দুয়ার পেরিয়ে,
সবুজ পাতায় ঢাকা ছোট্ট শকট
চলে যাবে আমার এ মৃতদেহ নিয়ে।

চাই না মৃতু্য হোক তমসায় ঢাকা
সে মরণ হয় যেন দেশদ্রোহীর,
আমি বীর_ মৃতু্যরআগে অবিচল
সূর্যের পানে যেন চেয়ে থাকি স্থির।

অনুবাদ: মৃত্যঞ্জয় মিত্র ও
শুভেন্দু সরকার

No comments

Powered by Blogger.