মাদ্রিকে তিন বাঙাল by মুনতাসীর মামুন

এখন আর প্রথাগত জলরংয়ের কাজ করেন না। জলরংয়ের কথা উঠতেই এলো জয়নুল আবেদিন প্রসঙ্গ। দু'জনেই তাঁর ছাত্র। দু'জনই তাঁর বেজায় ভক্ত। দু'জনই স্মৃতিচারণ করলেন কীভাবে জয়নুল তাদের শিখিয়েছেন।
হাশেম ভাই তো শিল্পাচার্যের খুবই প্রিয় ছিলেন। চারম্নকলায় তিনিই নিয়ে এসেছিলেন হাশেম ভাইকে। দু'জনই বললেন আমরা যে শিল্পাচার্যকে চিনি তিনি ফর্মাল এক শিল্পাচার্য। তাঁরা চেনেন জানেন আসল শিল্পাচার্যকে যিনি শুধু মানবিক গুণসম্পন্নই নন, রসিক এক পুরম্নষ ও বটে।
এরই ফাঁকে মনির ভাই একবার উঠে, সু্যপটা নেড়ে দিলেন, চামচে করে একবার চাখলেন, আবার কি যেন মেশালেন। অন্যান্য খাবার তৈরি আছে। গরম করে নিলেই চলবে। চেয়ারে বসে এক ঢোক বিয়ার গিলে বললেন মনির ভাই, 'আমি যখন স্পেনে আসি তখন স্যার [জয়নুল] দুটি উপদেশ দিয়েছিলেন।
এক. খোঁড়ার পিছে ঘুরবানা, দুই.ঝর্ণাতে অবগাহন করো। দু'টিই প্রতীক।'
বাংলাদেশের শিল্পীদের মধ্যে জয়নুল আবেদিন প্রথম আসেন স্পেনে। টলেডোতেও ছিলেন। সে সময় বেশ কিছু ছবি এঁকেছিলেন। খোঁড়ার পিছে মনির ভাইকে ঘুরতে না বলার কথার অর্থ যিনি শিল্পের কিছু দিতে পারবেন না তার পিছে ঘোরাঘুরি করে কোন লাভ নেই। শিল্পী যদি কোন নারীকে পছন্দ করে তাহলে যেন প্রাণবনত্ম কোন নারীকে বেছে নেয়। আর নারী তো ঝর্ণারই প্রতীক।'
'আমাকে একবার বলেছিলেন, 'যোগ করলেন হাশেম ভাই, 'দেখো, শিল্পীর সঙ্গে সুন্দরী নারীর সম্পর্ক থাকতে পারে, নানা ধরনের সম্পর্ক। শিল্পীর কাছে সে সনত্মানও চাইতে পারে। যদি চায় তবে তাকে নিরাশ করো না।
'শোনেন', বলি আমি, 'শিল্পীরা এসব সানি্নধ্যে এলে তাকে বলা হয় প্রেম, আর আমাদের সানি্নধ্যে এলে বলা হয় ব্যভিচার'।
দু'জনই হো হো করে হেসে উঠলেন। আমি বললাম, 'এগুলি শুনলে আপনাদের সবাই গুজব রটনাকারী বলে আখ্যা দেবে। আমরা একেকজনকে নিজেদের তৈরি মোড়কে ঢেকে দিই। তার বাইরে কিছু শুনলেই অাঁতকে উঠি।'
'আরে মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখতে না চাইলে কেমনে হইব?' বললেন মনির ভাই, 'শিল্পাচার্য এগুলির অনেক উপরে। কে কি কইল তাতে তার কিছু আসে যায় না। শিল্পাচার্য তো শিল্পাচার্যই থাকবেন।'
'শোন মনির। স্যারের একটা গল্প শোন।' বলেন হাশেম ভাই। আজ তাদের শিল্পাচার্যের গল্পে পেয়েছে। মনির ভাই বললেন, 'দাঁড়ান সু্যপটা নামাই। এখন খাইবেন?' আমরা 'না না' করে উঠি।
'থাক, তাইলে, একবারই ডিনার সারমু, এখন গল্পগাছা হোক। কিছু একটা খান মুনতাসীর।' বললেন মনির ভাই। উত্তরের অপেৰা না করে তাকের ওপর থেকে একটা ঠোঙা নামালেন। 'ভ্যালেনসিয়ার কমলা, ফার্স্টকাস, আমার এক বান্ধবী দিছে।' বলে বেশ কিছু কমলা বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন।
'ভ্যালেনসিয়ার কমলার নাম শুনেছি,' বলি আমি।
মনির ভাই এরপর জুত করে বসেন চেয়ারে। 'না কি ভিনু খাইবেন?' বলে আবার উঠে ফ্রিজ খুলে এক বোতল ভিনু বের করেন।
'ভিনুই চলুক, কি কন? শরীর স্বাস্থ্যের জন্য ভাল।'
'মন্দ না।' বলেন হাশেম ভাই।
যত্ন করে কর্ক খোলেন বোতলের। কর্ক থাকলে কি গুণ হয়, না থাকলে কী হয় সেগুলির বিশদ ব্যাখ্যার পর তিনটি গস্নাসে ভিনু ঢালেন। সিগারেটের প্যাকেটটা খোঁজেন। আমি ডিউটি ফ্রি বেনসনের প্যাকেট এগিয়ে দিই। আমার হাতটা জড়িয়ে ধরে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলেন, 'এই না হলে ফ্রেন্ড।' একটা সিগারেট ধরিয়ে, গেলাসে চুমুক দিয়ে চেয়ারে এলিয়ে বসে বলেন, 'কন হাশেম ভাই কন।'
'স্বাধীনতার পর', শুরম্ন করলেন হাশেম ভাই, 'ভারতে একটি প্রদর্শনী পাঠান হলো। বলা যেতে পারে বাংলাদেশের শিল্পীদের প্রথম চিত্রকলা প্রদর্শনী। শিল্পাচার্য, আমিনুল ইসলাম স্যার আর আমি নির্বাচিত হলাম প্রদর্শনীর সঙ্গে যাওয়ার জন্য। সেটি একটি অভিজ্ঞতাও বটে। ঢাকা থেকে ট্রাকে করে ছবি নিয়ে কলকাতা, তারপর হিলিস্নদিলিস্ন। আমি জুনিয়র বলে দেখভালের দায়িত্ব আমার। আমিনুল স্যারও ভাল সংগঠক, মাই ডিয়ার। এ প্রসঙ্গে স্যারেরও একটা গল্প সেরে নিই। বোম্বেতে [মুম্বাই] আমাদের দু'জনকে রাখা হয়েছে এক্সকুসিভ এক বাংলোয়। কয়েকদিন থাকব। কিছু করার নেই। চিনি না কাউকে, বোরিং ব্যাপার। স্যার দেখি বের হন আবার নির্লিপ্তভাবে ফিরে আসেন। আমাকে একদিন বললেন, যাও মিয়া ঘোরাফেরা করো। তা আমি বললাম, তা আপনি কি করেন স্যার। বললেন, এই একটু ঘোরাফেরা করে সিনেমা হলে যাই। ববির দুটি করে শো দেখে ফিরে আসি। ঋষিকাপুর আর ডিম্পল কাপাডিয়ার ববি তখন সুপার হিট। ঐ যে গানটা...।'
'হামতুম এক কামরেমে বন্ধ হো আর চাবি খো যায়ে...' বলি আমি।
'হ্যা, তাই। ... তিনদিনে ছয়টা শো দেখে ফেলেছেন। যাক, আমরা দিলিস্ন পেঁৗছলাম। ভারতের এক বিখ্যাত শিল্পী তখন শিল্পকলার একটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে। তিনি শিল্পাচার্যকে চেনেন। তাঁর বাসায় নেমনত্মন্ন করলেন।
শিল্পাচার্য যখন তরম্নণ তখন এক ভিন্নধমর্ী নারীর প্রেমে পড়েছিলেন। যে কোন কারণেই হোক সেটি আর বিয়ে পর্যনত্ম এগোয়নি। সেই মহিলা তখন আমাদের আমন্ত্রণকর্তার স্ত্রী।
সন্ধের একটু আগে আমরা তিনজন পেঁৗছলাম তাঁর বাড়িতে। স্বামী-স্ত্রী দুজনে পরম খুশিতে অভ্যর্থনা জানালেন। খানিক পর, গৃহকর্তা স্ত্রীকে বললেন, 'এই শোন, পার্কটা তো নতুন হয়েছে। চমৎকার। জয়নুলকে দেখিয়ে আনো। ও তো দেখেনি। আবার কবে আসবে। আমি বরং এই তরম্নণ ও অতি তরম্নণের সঙ্গে শিল্পচর্চা করি।'
জয়নুলকে নিয়ে গৃহকত্রর্ী বেরিয়ে গেলেন। ঘণ্টা দু'য়েক পর ফিরে এলেন। কর্তা তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে জয়নুলের ব্যাপারটি জানতেন। হয়ত স্ত্রীই বলেছিলেন। পুরো বিষয়টা এতো গ্রেসফুল আর নস্টালজিক লাগলো যে বলার নয়।'
ফোন বেজে ওঠে। মনির ভাই বলেন, 'বসেন'। উঠে পাশের রম্নম বা স্টুডিয়োতে যান ফোন ধরতে। এসে বলেন, 'মুনতাসীর আপনার ফোন'। আমাকে আবার মাদ্রিদে কে ফোন করবে! অবাক হই। ফোন ধরতেই তরম্নণ নিজের পরিচয় দেয় ম্যাকডোনাল্ডসের মাসুম বলে। আমি হেসে বলি, 'পরিচয়ের দরকার নেই, বলো'। সে জানায়, আগামীকাল সন্ধ্যা পর্যনত্ম তার কাজ নেই। সুতরাং, আমরা রাজি থাকলে সে আমাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াবে। সোৎসাহে রাজি হই। মাসুম জানায়, আগামীকাল সকাল ৯টার দিকে আসবে। ঠিকানাটা জানতে চায়। মনির ভাইকে ডেকে ঠিকানাটা বুঝিয়ে দিতে বলি।
কিচেনে ফিরে হাশেম ভাইকে জানাই, আগামীকালের হিলেস্ন হয়ে গেল। মনির ভাই বললেন, 'এবার ডিনারটা সারা যাক।' ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁই ছুঁই করছে। মনির ভাই স্পেশাল গার্লিক সু্যপের পর আবার মাছ মাংসের কোর্স। খেতে খেতে আবার নানা বিষয়ে টুকটাক আলাপ চলে। কখনও আর্ট কলেজ, কখনও চাঁদপুরের গনি স্কুল, কখনও ছবির রং বা ফর্ম নিয়ে।
১০
খাবার পর্ব শেষ হওয়ার পর ফের কিচেন টেবিলে বসি ভিনুর গস্নাস নিয়ে। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে মাদ্রিদের প্রতি আমার আগ্রহ অন্য কারণে বা স্পেন নিয়ে। সেটি স্পেনের পুরনো ইতিহাস বা হর্ম্যরাজি নয়। গত শতকের ত্রিশ থেকে আশির দশক পর্যনত্ম স্পেনের ইতিহাস। সেটি হচ্ছে ফ্যাসিজম প্রতিরোধের প্রচেষ্টা। সেটি হচ্ছে লোরকা, আলবের্তির কবিতা, পিকাসোর গুয়ের্নিকা।
একদিকে হিটলার, অন্যদিকে মুসোলিনী। স্পেনে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক সমাজের জন্য সবাই উন্মুখ। ১৯৩৬ সালের ১৮ জুলাই জেনারেল ফ্রাংকোর উত্থান। ফ্যাসিস্ট মুসোলিনী ও হিটলারের সহায়তায় তিনি প্রজাতন্ত্রকে দমন করতে বদ্ধপরিকর। সারা পৃথিবী থেকে তখন অসংখ্য মানুষ, বুদ্ধিজীবী এসে যোগ দেন স্পেনের প্রজাতন্ত্র রৰায়। পৃথিবীর প্রগতিমনা এমন কোন লেখক ছিলেন না যিনি এগিয়ে আসেননি। রমঁ্যা রলাঁ থেকে পাবলো নেরম্নদা। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে লিখেছিলেন সেই কালজয়ী উপন্যাস 'ফর হুম দ্য বেল টোলস'। অমন সময় আর আসেনি পৃথিবীতে।
'আচ্ছা মনির ভাই, আপনি যখন এসেছিলেন তখন তো ফ্রাংকোর রাজত্ব। কেমন ছিল তখন মাদ্রিদ?' জিজ্ঞেস করি আমি।
সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে খানিকটা অন্যমনস্ক হলেন মনির ভাই। 'হঁ্যা, তখনও ফ্রাংকো ছিল। তা এই ধরনের রাজত্ব কী হয় তা তো জানেন।' একটু থামলেন তিনি। তখন অবশ্য ফ্রাংকোর শেষ সময়। এক ধরনের স্থিতিশীলতা এসেছে। ফ্রাংকোর রাজত্বই তখন প্রায় ৫০ বছর পেরিয়েছে। লোকে ফ্রাংকোকে মেনে নিয়েছে ভবিতব্য হিসেবে। ইউরোপ তখন প্রায় স্বৈর শাসনমুক্ত। স্পেনে এর অভিঘাত তো থাকবেই। 'বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফ্রাংকো কন্ট্রোল করতে পারেনি', বললেন মনির ভাই, "সেখানে হৈ হাঙ্গামা প্রায় লেগেই থাকত। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাসে গিয়ে গোয়েন্দা দফতরের লোকজন বসে থাকত। গ্রি জে বলা হতো তখন। ধূসর সব কিছু। ছাত্ররা ঠাট্টা করে বলত গোয়েন্দাদের, কাসই যখন করছ তখন ডিগ্রিটা নিয়ে নাও না কেন?'
মনির ভাই মূল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েননি। চিত্রকলার 'স্কুলে' এসব হাঙ্গামা খুব একটা ছিল না। আর বাংলাদেশের একমাত্র বাঙালি তিনি। এসব এড়িয়ে চলতেন নিশ্চয়। কালচারাল লাইফ খুব ডাল ছিল, 'বললেন মনির ভাই', সব কিছুই ডাল।
ভয়ও ছিল। ফ্রাংকোর মৃতু্যর পর খবরের কাগজে একটি নিউজ পড়েছিলাম। মাদ্রিদ থেকে অনেক দূরে এক শহরের মেয়র প্রজাতন্ত্রের পতনের পর নিজের ঘরের মেঝের নিচে একটি ঘর বানিয়ে নিয়েছিলেন। সেখানেই থাকতেন। ফ্রাংকোর মৃতু্যর পর সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। তখন অবশ্য তিনি অতি বৃদ্ধ।
ফ্রাংকোর কথা মনে হলেই আমাদের বিভিন্ন স্বৈর শাসকের কথা মনে হয়। আমরা বিষণ্ন বোধ করি। চুপচাপ ভিনুর গস্নাসে চুমুক দেই। জীবনের কতগুলো মূল্যবান সময় হাতছাড়া হয়ে গেল।
খানিক পর আবার চাঁদপুর প্রসঙ্গ ফিরে আসে। ঘড়ির কাঁটা বারোটা পেরম্নচ্ছে। আমি বলি, 'শুতে যাই', তারা খেয়াল করেন না। শেয়ার ঘরের জানালা নাকি দরজা খুলে ব্যালকনিতে দাঁড়াই। তাপমাত্রা কমছে। আমার ঘুরে ফিরে খালি স্পেনের সে সময়কার কথা মনে হয়।
রমঁ্যা রলাঁ ২০ নভেম্বর [১৯৩৬] সালে লিখলেন তাঁর সেই বিখ্যাত আবেদন_ "মনুষ্যত্ব! মনুষ্যত্ব! আজ তোমার দ্বারে আমি ভিখিরি। এসো, স্পেনকে সাহায্য করো! আমাদের সাহায্য করো। তোমাদের সাহায্য করি। কেননা তুমি আমি সকলেই আজ বিপন্ন। ..."
হিস্পানি ভাষার অন্যতম কবি রাফায়েল আলবের্তি ছিলেন ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকার বন্ধু। লোরকা ছিলেন তখন গ্রানাডায়। ফ্যাসিস্ট সৈন্যরা তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। আলবের্তি লিখেছেন, যুদ্ধের আগে তিনি যখন ছাত্র তখন লোরকার সঙ্গে তাঁর পরিচয়। আলবের্তির ভাষায়, "সঙ্গে এনেছ তোমার প্রথম গাথা কবিতার বই:
সবুজ তোমায় সবুজ যেন পাই
সবুজ হাওয়া, সবুজ ডালপালা ...
তোমার সেই সেরা ব্যালাড। সন্দেহ নেই, আজকের হিস্পানি কাব্যে সব সেরা সেই কবিতাটি। ...
ৰমতা কেড়ে নেওয়ার জন্য যেদিন হানাদাররা আক্রমণ করল, সেই আঠারোই জুলাই আমি ছিলাম ঈবিজা দ্বীপে। সিভিল গার্ডরা এল আমার খোঁজে। আমি পালালাম। সতেরো দিন এ পাহাড় ও পর্বতে ঘুরলাম। রাইনার মারিয়া রিলকে বলেছেন, কেউ কেউ অন্য কারো মরণের সঙ্গে নিজেরও মৃতু্য ঘটায়_ যা তাদের একানত্মই নিজস্ব মৃতু্য, সে মরণ নয়। তুমি মরলে। সে মৃতু্য তো আমারই হবার কথা। তোমাকে ওরা খুন করল। আমি পালালাম। তবু তোমার রক্ত এখনো টাটকা রয়ে গেছে, চিরদিন তা তাজাই থাকবে। ...
তোমার কবিতার সেই দুঃখী আর মহিমাময় জনগণের সঙ্গে আমরা তোমার স্মৃতি পাহারা দেব। জাগিয়ে রাখব তোমার উপস্থিতি সেই ভালবাসায়, যেমনভাবে পুরনো দিনের কবিরা জাগিয়ে রেখেছিলেন সেই শিরস্ত্রাণহীন তরম্নণ কবি গারচিলাসো দেলা ভেগাকে, ঘোড়ায় চেপে যিনি শত্রম্ন সৈন্যের সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে আর ফেরেননি, যিনি তাঁর সাহস আর গানের জন্য পেয়েছেন একই চরম সম্মান।"
হেমিংওয়ে তাঁর উপন্যাস ছাড়াও 'স্পেনে মৃত আমেরিকানদের কথা মনে করে' শীর্ষক মর্মস্পর্শী এক নিবন্ধ লিখেছিলেন যার শেষ প্যারাটি ছিল এ রকম_ "যারা মৃত্তিকায় প্রবেশ করেছে এমন মহিমায়, যারা স্পেনে শহীদ হলো তাদের চেয়ে কেউ বেশি সম্মান নিয়ে মাটি নেয়নি কোনো কালে, তারা তো ইতিমধ্যেই অমরত্বে পেঁৗছে গেছে।"
ফ্যাসিবাদের বিরম্নদ্ধে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লেখকদের 'প্রগতি লেখক সংঘ' গড়ে উঠেছিল। কলকাতাতেও। মনে পড়ে সে সময় বের্টোল্ড ব্রেখটের 'উপহার' কবিতার চমৎকার অনুবাদ করেছিলেন বিষ্ণু দে। ঢাকাতে রণেশ দা, আমাদের সেই ঋষিতুল্য রণেশ দাশগুপ্ত গড়ে তুলেছিলেন 'প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ' যার দায়িত্ব বর্তেছিল সোমেন চন্দের কাঁধে। তবে, সেই সময়ের মাদ্রিদের প্রতীক হচ্ছেন ডলরেস ইবারম্নরি।
ইবারম্নরি সম্পর্কে আমি তেমন কিছু জানতাম না। অনেক আগে, একবার শানত্মিনিকেতনে এক বইয়ের দোকানে বই দেখছি। সঙ্গে মফিদুল হক। তিনি একটি বই তুলে দিলেন আমার হাতে। বললেন, 'তুমি না নিলে আমি নেব।' তিনি জানতেন আমি আত্মজীবনী সংগ্রহ করি। বইটির নাম ঞযব-ংযধষষ হড়ঃ ঢ়ধংং। ইবারম্নরির আত্মজীবনী। ইবারম্নরি পরিচিত লা পাসিও নারিয়া নামেও।
কমিউনিস্ট আদর্শে দীৰিত ইবারম্নরি খনি শ্রমিকদের নেত্রী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রজাতন্ত্র রার যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন মাদ্রিদে। সেই সময়কার মাদ্রিদের জীবনত্ম বিবরণ তিনি রেখে গেছেন। ফ্রাংকোর ফ্যালানজিস্টরা এগিয়ে আসছে। মাদ্রিদবাসীরা আতঙ্কিত। এমন এক দিনে রাসত্মায় দেখা গেল ৫৪টি দেশের কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবীকে, যারা গড়েছেন 'আনত্মর্জাতিক ব্রিগেড।' পরে সমবেত সুরে তারা গাইছেন 'জাগো জাগো সর্বহারা।' সেই বিখ্যাত 'ইন্টারন্যাশনাল।' জনতা নেমে আসছে রাসত্মায়। সেই সময় অনেকে গাইতেন জার্মানির থেলমানের লেখা একটি গান_
"স্পেনের আকাশে তারাগুলি ঝলমল করছে;
নিচে, অনেক নিচে, পরিখায় বসে আমরা_
ভোর হয়ে আসছে,
ডাক আসছে যুদ্ধের!
বহুদূরে ফেলে এসেছি আমাদের মাতৃভূমি;
তবু এখানেই, প্রতিরোধে আমরা অটল!
তোমাদের, আমাদের সংগ্রামের একই ল্য_
স্বাধীনতা।"
মাদ্রিদ নিসত্মব্ধ হয়ে আসছে। তারাভরা আকাশের দিকে তাকাই। হিম লাগছে, জানালা বন্ধ করে শুতে শুতে ভাবি, মাদ্রিদ বেতার থেকে ইবারম্নরির ঘোষণা যা রটে গিয়েছিল সারা পৃথিবীতে_ "হাঁটু গেড়ে বেঁচে থাকার চেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে মরাও ভাল। নো পাসারন।" দে শ্যাল নট পাস।
আজ সমাজতন্ত্র, বাঁ ধারা অনেকের চোখের বিষ। কিন্তু, আমি পৃথিবীর যেখানেই গেছি সেখানে বাঁ ধারার বুদ্ধিজীবী বা সাধারণ মানুষের সঙ্গে যখনই কথা বলেছি তখনই একাত্মতা বোধ করেছি, ধর্ম, বর্ণ ভাষা কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। মাদ্রিদের প্রতিরোধের কথা ভাবতে ভাবতে চোখ বুজে আসে।
কিচেন টেবিল ঘিরে তখনও মনিরম্নল ইসলাম আর হাশেম খান চাঁদপুরের স্মৃতিচারণায় মশগুল।
(চলবে)

No comments

Powered by Blogger.