নিজেকে বদলে দেয়ার চেষ্টা

গৃহবধূ ফারহানা সুলতানা (২৬) উচ্চৈঃস্বরে দৈনিক জনকণ্ঠের খবর পাঠ করে শোনাচ্ছিলেন। আর সেই খবরগুলো মনযোগ সহকারে শুনছিলেন মোসাম্মদ মাহমুদা বেগম (২৬)। দুই সনত্মানের জননী এই গৃহবধূর এখন সংবাদপত্রের খবর না শুনতে পারলে ভাললাগে না।
নিজে পড়তে না পারলেও তাঁকে পড়ে শোনাতে হয় ফারহানা সুলতানাকে। রিক্সাচালক মোহাম্মদ হানিফের স্ত্রী মাহমুদা বেগম শুধুু স্বার করতে জানেন। এক সময় গৃহস্থালি কাজকর্ম ছাড়া তাঁর আর কিছুই করার ছিল না। আর এখন বিকেল হলেই ছুটে আসেন তাঁদের সমিতির ঘরটিতে। শুধু মাহমুদা বেগম নন। একই গ্রামের আরেক রিক্সাচালক আবুল কালামের স্ত্রী আফরোজা বেগমও ছুটে আসেন তাঁদের সমিতির কেন্দ্রে। এভাবে মধ্যবাদুরতলী গ্রামের মানসুরা বেগম, হালিমা বেগম, আরিফা বেগমসহ অনত্মত ৩০ মহিলা প্রতিদিন বিকেলে আসেন মধ্যবাদুরতলীর তিন নং ওয়ার্ডের সমিতির এই ঘরটিতে। তাঁদের কেন্দ্রের নাম হাসনাহেনা। বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যনত্ম এই মহিলারা এখানে পত্রিকা পড়া ছাড়াও উপআনুষ্ঠানিক শিা গ্রহণের সুযোগ পেয়ে থাকেন। রয়েছে সারতা-উত্তর শিা দতা বৃদ্ধি প্রশিণ নিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ গ্রহণের। বিনোদনের জন্য রয়েছে বিভিন্ন খেলাধুলার উপকরণ। একইভাবে রাতেরবেলা এদের স্বামীদের পত্রিকা পাঠ ছাড়াও সারজ্ঞান, বিভিন্ন সচেতনতামূলক বই পড়ার সুযোগ। বিকেলে এবং রাতে দুই শিফটের জন্য রয়েছে দুইজন কর্মী। দিনেরবেলা সহায়িকা এবং রাতেরবেলা রয়েছে সহায়ক। এই কেন্দ্রের হালিমা বেগম জানালেন, "এখন তিনি স্বার দিতে পারেন। যা আগে পারতেন না।" অতিসমপ্রতি টিয়াখালী ইউনিয়নের মধ্যবাদুরতলী গ্রামে গিয়ে দেখা যায় এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য। যেন পত্রিকার খবর জানার জন্য অধীর আগ্রহ সবার মধ্যে। একই দৃশ্য চাকামইয়া ইউনিয়নের নিশানবাড়িয়া গ্রামের হাসনাহেনা কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল। আলো রানী (৪৩) তাদের সমবয়সী এবং আরও বেশি বয়সের জনাত্রিশেক মহিলার সঙ্গে নিজেরা নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন। যার বিষয়বস্তু ছিল শিশুদের যত্ন। প্রভা রানী জানালেন, "পয়ঃপরিষ্কার থাকতে পারলে অনেক রোগ-বালাই থাইক্যা ভাল থাকা যায়।" তিনি আরও জানালেন, "এখানে এসে হাঁস-মুরগি পালনের প্রশিণ নিতে পেরেছি।" সুচিত্রা রানী জানালেন, "তিনি পত্রিকা পড়ার মধ্যদিয়ে জানতে পেরেছেন এই দ্যাশ নাহি আবার ডুইব্যা যাইতে পারে।" রীনা পারভিন জানালেন, "তিনি অসচেতন ছিলেন।" দর্জি ট্রেডের প্রশিণ নিয়ে কর্মসংস্থান খুঁজে পেয়েছেন। এই কেন্দ্রের ১৫ জনের ইতোমধ্যে প্রশিণ নেয়া হয়েছে। তাঁরা সুযোগ পেয়েছে আত্মকর্মসংস্থানের। এঁদের একজন হাওয়া বেগম জানালেন, "স্বামী তাঁকে ফেলে রেখেছে। সনত্মান নিয়ে অর্ধাহার-অনাহার নিত্যদিনের সঙ্গী। বর্তমানে দর্জি কাজের প্রশিণের সুযোগ পাওয়ায় একটা হিলেস্ন হয়েছে।" তবে তাঁর সঙ্কট রয়েছে পুঁজির। একই সুযোগ পেয়েছে শিা থেকে ঝরেপড়া প্রিয়াঙ্কা এবং বিথিকা শিকদার। এসব নারী এখন প্রতিদিন নিজেদের সচেতন হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন পত্রিকা পড়ার মধ্যদিয়ে। এছাড়া বিভিন্ন ট্রেডের প্রশিণের মাধ্যমে অভাব ঘোচানোর সুযোগও পেয়েছেন। ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের মানব উন্নয়নের জন্য সারতা-উত্তর অব্যাহত শিা প্রকল্পের মাধ্যমে কলাপাড়ায় ৩৪টি কেন্দ্রে মোট দুই হাজার ৪০ জনকে এই সুযোগের আওতায় আনা হয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যনত্ম লেখাপড়ার পরে ঝরেপড়া কর্মজীবী পুরম্নষ-মহিলাদের যাদের ১১ থেকে ৪৫ বছর বয়স। এঁদের প্রত্যেককে বছরের প্রথম তিন মাস পত্রিকা পাঠসহ চেতনা নামক তিন পার্টের বই পড়ানো হয়। পরের ছয় মাস বিভিন্ন ট্রেডের প্রশিণ দেয়া হয়। শেষের তিন মাস কর্মসংস্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়। প্রজেক্টের উপজেলা সমন্বয়কারী আজিজুর রহমান জানান, ইতোমধ্যে ৫৯৬ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে দর্জি প্রশিণের মধ্যদিয়ে ৩৯২ জন। পশুসম্পদ প্রশিণের মধ্যদিয়ে ১২২ জন এবং মাছ চাষের মধ্যদিয়ে ৮২ জনকে আত্মকর্মসংস্থানের সুয়োগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এজন্য প্রত্যেক কেন্দ্রে রয়েছে দুই শিফটে দুইজন কর্মী। একজন সহায়ক আর একজন সহায়িকা। মোট কথা গ্রামীণ জনপদের এসব নারী-পুরম্নষ এখন প্রতিদিন পত্রিকা পাঠসহ বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কর্মকা- সম্পর্কে জানতে পারে। সুযোগ পেয়েছে নিজেকে শিতি করার। যেন নিজেকে বদলে দেয়ার চেষ্টা। যেন দিন বদলের লড়াই চালাচ্ছে এসব মানুষ। কলাপাড়ার চাকামইয়া, টিয়াখালী, মিঠাগঞ্জ ও লালুয়ায় এই সুযোগ রয়েছে। তবে এলাকার মানুষের দাবি এর ব্যাপ্তি আরও হোক। এমন মতামত সবার।
_মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া

No comments

Powered by Blogger.