পাঠ্যপুস্তক বিতরণ উৎসব

১ জানুয়ারি ছিল 'পাঠ্যপুস্তক উৎসব'। নববর্ষের সব উৎসবকে যেন ম্লান করে দিয়েছিল শিশু-কিশোরদের আনন্দধ্বনি। বছরের প্রথম দিনে নতুন বই হাতে পাওয়ার আনন্দ। তারা রীতিমতো উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছিল। তাদের সেই উচ্ছ্বাস বিদ্যালয়ের আঙিনা ছাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছিল বাড়ি পর্যন্ত।
অতীতে যেখানে নতুন ক্লাসের বই পেতে মার্চ-এপ্রিল হয়ে যেত, এবার সেখানে বছরের প্রথম দিনেই নতুন বই_এটি যেন ছিল এক অভাবনীয় ঘটনা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সত্যিই এবার একটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। সদিচ্ছা থাকলে যে অনেক কিছুই করা সম্ভব, সেই চরম সত্যটিকেই তারা প্রমাণ করে দিয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রীকে ধন্যবাদ। অতীতে নতুন ক্লাসের বই পেতে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের যে কতটা ভোগান্তি পোহাতে হতো, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিদ্যালয়ে অধিকাংশ বই-ই পাওয়া যেত না। পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ও অসৎ ব্যবসায়ীদের একটি চক্রের মাধ্যমে বই চোরাকারবারি হয়ে চলে যেত কিছু কিছু বইয়ের দোকানে। তখন অভিভাবকদের বাধ্য হয়ে দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়াতে হতো। সব দোকানে চোরাই বই বিক্রি হতো না। যেসব দোকানে পাঠ্য বই পাওয়া যেত, সেসব দোকান থেকে দিনের পর দিন ঘুরে কয়েক গুণ বেশি দাম দিয়ে বই কিনতে হতো। এভাবেও সব বই হাতে পেতে মার্চ-এপ্রিল পেরিয়ে যেত। অর্থাৎ শিক্ষাবর্ষের অর্ধেকটা সময়ই চলে যেত বই হাতে পেতে।
আমরা মুখে বলি, 'শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড'। অথচ বিগত সময়ে শিক্ষা খাত ছিল চরম দুর্নীতিগ্রস্ত একটি খাত। স্বাভাবিক কারণেই শিক্ষার মানের অবনতি হতে থাকে। এ বছর টিআইবির রিপোর্ট দেখেও আমরা কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছি। টিআইবি বলেছে, শিক্ষা খাতে দুর্নীতি অনেকটাই কমেছে। বই বিতরণ উৎসবে শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষকসমাজের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, 'দয়া করে আপনারাই আপনাদের সম্মান পুনরুদ্ধার করুন।' তিনি বলেছেন, 'পর্যায়ক্রমে আপনাদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হবে। কিন্তু কেউ যেন বলতে না পারে, অমুক শিক্ষক যখন স্কুলে পড়ান, তখন শিক্ষার্থীরা কিছুই বুঝতে পারে না। আর তিনিই যখন টিউশনি করেন, তখন শিক্ষার্থীরা ঠিকই বুঝতে পারে। এটা করবেন না। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতি আরো মনোযোগ, আরো আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করবেন এবং সম্পূর্ণ সিলেবাস নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করবেন।' শিক্ষামন্ত্রীর কথাগুলো প্রত্যেক অভিভাবকের মনের কথা। আমরাও চাই, শিক্ষকসমাজ তাদের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে সম্মিলিতভাবে কাজ করবে। অতীতে আমরা দেখেছি, শিক্ষকদের সমাজে বিশেষভাবে সমীহ করা হতো, বিশেষভাবে তাঁদের সম্মান দেখানো হতো। বর্তমানে শিক্ষকদের সেই মর্যাদার অনেক ঘাটতি লক্ষ করা যায়। আমরা বিশ্বাস করি, শিক্ষকসমাজই তাদের দায়িত্ব, কর্তব্যনিষ্ঠা ও শিক্ষা বিস্তারে আন্তরিকতার মাধ্যমে সেই মর্যাদার আসনটি আবার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন।
জাতির মেরুদণ্ড দুর্বল হলে সে জাতি এগিয়ে যাওয়া তো দূরে থাক, সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারে না। কাজেই দেশের উন্নয়ন, সমাজ-সংস্কৃতির উন্নয়ন, আধ্যাত্মিক-মানসিক উন্নয়ন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ-সবকিছুই নির্ভর করে একটি দেশের শিক্ষার মানের ওপর। বর্তমান সরকার সঠিক জায়গায় গুরুত্বারোপ করায় আমরা স্বাভাবিকভাবেই অনেকটা আশাবাদী হয়েছি। তবে এখনো আমাদের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এমনকি আশপাশের দেশগুলোর তুলনায়ও তা অনেক কম। সরকারকে কম প্রয়োজনীয় খাতে বরাদ্দ কমিয়ে জাতির মেরুদণ্ডকে সুস্থ ও সবল করার জন্য অবশ্যই শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আরো বাড়াতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.