কাকীর পাঠাগার by অননত্ম সুমন

একবিংশ শতাব্দীর কম্পিউটারের যুগেও বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত। এ অবস্থার পরিবর্তন যতদিন সম্ভবপর হবে না ততদিন সামগ্রিকভাবে জাতীয় জীবনের উন্নয়ন হবে না।
বেশি বেশি বই পড়লে মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ জেগে ওঠে। মন উদার হয়। এ জন্য শিার হার যেমন বাড়ানো দরকার আর সঙ্গে দেশের প্রত্যনত্ম অঞ্চলে পাঠাগারের সংখ্যা অনেক গুণ বাড়াতে হবে। গ্রামের বেকার যুবক বা অর্ধশিতি মানুষগুলোর যখন কাজ থাকে না তখন বাজে আড্ডাতে যোগ দেয়, নেশা করে, উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করে। বিশাল পরিসরের এই সব শিতি অর্ধশিতি মানুষের যদি সময় কাটানোর মাধ্যম হিসেবে বইপড়ার সুযোগ পেত, তবে জাতি আরও উন্নত হতো। আর এমনি এক প্রত্যয় নিয়ে বগুড়ার আদমদিঘী উপজেলার নশরৎপুরে গড়ে উঠেছে এক গণকেন্দ্র পাঠাগার। যেখানে প্রতিদিন তরম্নণ-তরম্নণী, যুবা, বৃদ্ধের বই পড়ার ধুম পড়ে যায়।
এ পাঠাগার নিয়ে আলাপ হলো স্থানীয়ভাবে জীবনানন্দ গবেষক বলে পরিচিত মাসুদ রানা বাদশা ও কবি রবিউল ইসলামের সঙ্গে। তারা বলেন, 'একটা ভাল বই পড়ে বোঝার পর যে একটা আনন্দ বা তৃপ্ততা মনে আসে তা থেকে দেশের অনেক মানুষ বঞ্চিত আছেন। ঐ তৃপ্ততা যদি সকল মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া যায় তবে হানাহানি, যুুদ্ধ এমনিতেই থেমে যাবে। হিংসার শিকল ছিঁড়ে যাবে। প্রতিটা মানুষ প্রকৃত মানুষে রূপানত্মরিত হবে। আমাদের এলাকাতে এই পাঠাগার স্থাপনের পর থেকে দেখবেন তরম্নণ-যুবকদের অনেক বাজে আড্ডা থেমে এখন সাহিত্য নিয়ে তর্ক হয়, গবেষণা হয়, এই পলস্নী গ্রামেও। এখন গ্রামের স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা টাকা বাঁচিয়ে ভাল ভাল বই কেনার প্রতিযোগিতা করছে। নতুন নতুন ভাল বই পড়ার প্রতিযোগিতা করে। এমনটা কিন্তু হয়েছে ঐ পাঠাগারটার কারণে।'
ব্র্যাকের সহায়তায় এ পাঠাগারে অর্চনা সরকার আছেন লাইব্রেরিয়ান হিসেবে। সকাল বিকেল তিনি কাজ করে যাচ্ছেন শিা বিসত্মারের প্রত্যয় নিয়ে। আশপাশের দশ-বিশ মাইলের মধ্যে এমন পাঠাগার নেই যেখানে মানুষ গল্প উপন্যাস বা পত্রিকা পড়ার জন্য সহজেই বসতে পারে। আর এখানে একজন অর্ধশিতি কৃষক মাঠে কাজ করে যেটুকু সময় পায়, সে সময়টুকুর ফাঁকে হাত-পা ধুয়ে লুঙ্গিটাকে ঝেড়ে কাঁধে গামছা ফেলে ছুটে আসে এ পাঠাগারে। যেখানে সে দৈনিক পত্রিকা পড়ে জানতে পারছে দেশ-বিদেশের টাটকা খবর। আবার লাইব্রেরীতে যে কার্ড করা আছে সে কার্ড দিয়ে তিনি বাড়িতে বই নিয়ে যেতে পারছেন স্ত্রী, সনত্মান বা নাতনির জন্য।
অন্যদিকে এখানে আসছে স্কুল-কলেজের শত শত ছেলেমেয়ে। আর এখানকার লাইব্রেরিয়ান একজন মহিলা, তাই স্কুল-কলেজের মেয়ে এবং এলাকার শিতি অর্ধশিতি নববধূরাও এখান থেকে বই উঠাতে পারছে সহজেই। আর গৃহবধূরা নির্বিঘ্নে এ পাঠাগারে আসছে, বই পড়ছে, সদস্য হয়ে বই বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। অবসরে বই পড়ছে পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে।
পাঠাগারে ১২ টাকাতে ভর্তি আর বছরে দিতে হবে মাত্র ১০ টাকা। লাইব্রেরিয়ান অর্চনা সরকার সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৫ পর্যনত্ম লাইব্রেরী পরিচালনা করছেন বিরামহীনভাবে। ফাঁকা সময় এ বাড়ি ও বাড়িতে গিয়ে মেয়েদের বই পড়ার জন্য উৎসাহিত করছেন। মাত্র ৮শ' টাকা মাসে পেয়ে এমন কষ্টের কাজ করতে তার কেমন লাগে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি তো টাকার জন্য চাকরি করছি না। এই বিশাল পলস্নী এলাকাতে শিার হার কম, আবার অনেক গৃহবধূ বা বাড়ির বড় মেয়েরা বাড়িতে বসে থাকে, অলস সময় কাটায়। সে সময়টাতে যেন তারা বই পড়তে পারে, জ্ঞান অর্জন করতে পারে সে জন্যই আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। আবার অতিদরিদ্র ছেলেমেয়েদের এখানে কম্পিউটার প্রশিণ দিচ্ছি বিনামূল্যে। আমার এ কম্পিউটার থেকে অনেক ছেলেমেয়ে বিনামূল্যে কম্পিউটার শিখে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। আবার মেয়েরা বাজারে গিয়ে কম্পিউটার শিখুক এটা অনেক বাবা-মা চান না, তারাও আমার কাছে কম্পিউটার শিখতে আসে, তাদের শিা দিতে পারছি_ এটাইবা কম কি। এ সমাজে বাস করতে গেলে তো একটা দায়িত্ব থাকে, সে দায়িত্ববোধ থেকে এ কাজ করা।'
অর্চনা সরকার আরও জানালেন, লাইব্রেরীর প্রতি তার এমন টান যে, অন্য কিছুতে তার অতটা খেয়াল থাকে না। সবসময় মন পড়ে থাকে এ পাঠাগারে। বাইরে গেলেই মনে হয় আহা, ঐ জ্ঞানের দুয়ারের চাবি তো আমার হাতে। আমি যতণ বাইরে থাকব ততণ তো মানুষ ঐ জ্ঞানের ঘর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই বেশি সময়টা এই বিশাল জ্ঞানের ভা-ারের দরজা খুলে বসে থাকার চেষ্টা করি। এ কথার রেশ ধরেই নশরৎপুর ডিগ্রী কলেজের ছাত্র রায়হানুল ইসলাম জানাল, এ লাইব্রেরীতে সময় দিতে গিয়ে তার (লাইব্রেরিয়ান) গহনাসহ কয়েক লাখ টাকার জিনিস চুরি হয়ে গেছে।
জানা গেল তাদের সারাজীবনের কষ্টার্জিত টাকা এবং ৫ ভরির মতো সোনার গহনা সমপ্রতি দিনে-দুপুরে চুরি হয়ে গেছে। তিনি পাঠাগারে এসেছেন সকালে। দুপুরের মধ্যে বাড়িতে চোর ঢুকে তার কয়েক লাখ টাকার জিনিস চুরি করে নিয়ে যায়।
অর্চনা সরকারের স্বামী গোবিন্দ চন্দ্র সরকার স্থানীয় নশরৎপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের জনপ্রিয় অংকের শিক এবং সাহিত্যিক। তার সহোযোগিতা কেমন জানতে চাইলে অর্চনা সরকার বলেন, তাঁর উৎসাহ ও সহযোগিতার কারণেই এতদূর আসা। আমি যদি কখনও কানত্ম হয়ে যাই বুঝতে পেরে তিনি আমাকে আরও বেশি উৎসাহ দেন। এই যে এত টাকার জিনিস হারিয়ে গেল পাঠাগারে এসে আমার অবহেলায়, তিনি কিন্তু কখনও আমাকে এ নিয়ে কিছু বলেননি। তিনি আরও আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন, সাহস দিয়েছেন। বলেছেন 'এসব অলঙ্কার তো ণিকের, হারিয়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায়, এই যেমন মিলিয়ে গেল, কিন্তু তুমি যে বিদ্যা-শিা অন্যকে দিচ্ছ এ্ততো হারাবার নয়, মিলিয়ে যাবার নয়, হারিয়ে যাবে না কখনও। এগুলো আরও বেশি চকচকে। বেশি খাঁটি, অনেক অনেক মূল্যবান।' চোখে পানি এলেও এসব কথা শুনে উৎসাহ উদ্দীপনা পাই। কষ্টটাও ভুলে যাই। অর্চনা সরকারের নামটি কিন্তু অনেকেই জানেন না। এই পুরো এলাকার মানুষ তাকে 'কাকী' বলেই জানে। 'কাকী' নামেই তিনি পরিচিত। তিনি এ ব্যাপারে বলেন, কীভাবে যে এমন কাকী হয়ে গেলাম তা জানি না। আজ যে প্রাইমারীর ছোট মেয়েটি পাঠাগারে নতুন ভর্তি হতে এসে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলবে আপা আপা ভাল একটা ছবিঅলা বই দেবেন? ওমা সেই মেয়েটিই আবার এক সপ্তাহ পর বই ফেরত দিতে এসে বলবে কাকী কাকী আরেকটা বই দেন। ক'দিনেই কিভাবে যে ওরা বুঝতে পারে আমাকে আপা নয় কাকী ডাকতে হয়! এমন মজা আর আনন্দ কী-আর টাকা দিয়ে কিনতে পাওয়া যায় বলুন!

No comments

Powered by Blogger.