কাস্টমারদের রেটিং ব্যাংক মালিকদেরও রেটিং হোক by ড. আর এম. দেবনাথ

ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের আগামী দিনে ঋণ গ্রহণের পূর্বে একটি 'টেস্ট' দিতে হবে। সব ঋণগ্রহীতাকে নয়, 'টেস্ট' দিতে হবে 'কর্পোরেট' গ্রাহকদের অর্থাৎ বড় বড় ঋণগ্রহীতাকে। তাদের 'রেটিং' হবে। 'রেটিং' হবে সৰমতার।
অর্থাৎ কোন গ্রাহক ঋণ পরিশোধে কতটুকু সৰম হবেন তার 'রেটিং'। বলা যায় শ্রেণী বিন্যাস। যার ঋণ পরিশোধের ৰমতা বেশি হবে তার 'রেটিং' উঁচুমানের হবে। যার ঋণ পরিশোধের ৰমতা একটু কম হবে তার 'রেটিং' হবে অপেৰাকৃত নিম্নমানের। প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ব্যাংকিং খাতে কর্পোরেট কায়েন্টের সংখ্যা হবে কমপৰে কুড়ি হাজার। এদের প্রত্যেককে অল্পকালের মধ্যে 'রেটিং'-এর কাজ সম্পন্ন করতে হবে। এটি না হলে তাদের কপালে ব্যাংকঋণ জুটবে না। অবশ্য সাদামাটা চোখে মনে হয় নজিরবিহীনভাবে শুধু বড় গ্রাহকদেরই 'রেটিং' হবে। না, দৃশ্যত এমন মনে হলেও প্রকৃত পৰে এ ধরনের 'রেটিং' ব্যাংকগুলোর ৰেত্রে আগে থেকেই হচ্ছে। অর্থাৎ আগে হতো ব্যাংকগুলোর রেটিং, এখন হবে ব্যাংক এবং কাস্টমার উভয়েরই।
এমন এক সময় ছিল যখন ব্যাংক নিয়ে মানুষের মাথাব্যথা ছিল না। কোন রকম চিনত্মাভাবনা না করেই ব্যাংকে টাকা রাখা যেত। এর কারণ? কারণ ১৯৮২ সাল পর্যনত্ম স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সকল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর এসব প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয়। জাতীয়করণকৃত ব্যাংক মানেই হচ্ছে এগুলোর মালিক সরকার। সরকার যে প্রতিষ্ঠানের মালিক তার নিরাপত্তা নিয়ে ভাববার কিছু নেই। এ কারণেই মানুষ তার কষ্টের ধন/সঞ্চয়ের টাকা চোখ বুজে সরকারী ব্যাংকে রাখত। কিন্তু ১৯৮৩ সাল থেকে সরকার বেসরকারী খাতে ব্যাংক করার অনুমতি দেয়। আজ ২০১০ সাল। বেসরকারী খাতে ব্যাংকিং-এর বয়স এখন প্রায় ২৭ বছর। ইতোমধ্যে দেশে ৩০টি বাণিজ্যিক ব্যাংক বেসরকারী খাতে কাজ করছে। সর্বমোট ৪৮টি তফসিলী ব্যাংক। বস্তুত ব্যাংকিং খাতের অর্ধেকের বেশি ব্যবসা এখন হয় বেসরকারী খাতের ব্যাংকে, যদিও শাখার হিসাবে সরকারী খাতই সবচেয়ে বড়। কিন্তু আমানত ও ঋণের ৰেত্রে বেসরকারী খাত এখন সবচেয়ে বড়। এ খাত ব্যবসার প্রায় ৬০-৬৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। বেসরকারী খাতের ব্যাংকিং ব্যবসা যত প্রসারিত হচ্ছে সরকারী খাতের ব্যাংকের ব্যবসা তত সঙ্কুচিত হচ্ছে। পাশাপাশি যেটি বাড়ছে তা হচ্ছে গ্রাহকদের ঝুঁকি। গ্রাহকরা আগে চোখ বুজে যেকোন সরকারী ব্যাংকে তাদের আমানতের টাকা রাখতে পারতেন। কারণ সরকারী সকল ব্যাংকের শক্তি ও সামর্থ্য ছিল সমান। কোন ঝুঁকি তাতে ছিল না। বেসরকারী ব্যাংকের ৰেত্রে এ কথা সত্য নয়। মালিকানা, ব্যবসা, ব্যবসার ধরন, সম্পদের গুণগত মান ইত্যাদির নিরিখে একেকটি বেসরকারী ব্যাংকের শক্তি ও সামর্থ্য ভিন্ন ভিন্ন। এখানেই ঝুঁকির প্রশ্ন এসে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই আমাদের দেশে কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। সে ঘটনাগুলো কী?
যাঁরা ব্যাংকিং খাতকে নিবিড়ভাবে পর্যবেৰণ করেন তাঁরা জানেন আজ থেকে বেশ কিছুদিন আগে 'বিসিসিআই' (ব্যাংক অব ক্রেডিট এ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল) নামীয় পাকিসত্মানী নিয়ন্ত্রিত একটি বিদেশী ব্যাংক ছিল। জালিয়াতি, ব্যাপক অনিয়ম এবং বিধি লঙ্ঘনের ফলে ব্যাংকটি বন্ধ হয়ে যায়। পরবতর্ীকালে সরকার একে উদ্ধার করে। এর নাম হয় ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড। 'বিসিআই' (বাংলাদেশ কমার্স এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট) নামীয় একটি বিনিয়োগ কোম্পানি ব্যাপক অনিয়মের ফলে বন্ধ হয়ে যায়। সরকার এর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে 'বিসিআইকে' পরবতর্ীকালে বিসিআই ব্যাংকে রূপানত্মরিত করে। 'ওরিয়েন্টাল ব্যাংক লিমিটেড' নামীয় আরেকটি ব্যাংক ব্যাপক জালিয়াতি করে বন্ধ হয়। সরকার এবারও হসত্মৰেপ করে। এ ব্যাংকের বর্তমান নাম 'আইসিবি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড'। যে তিনটি উদাহরণ দিলাম এসবই এ দেশে ঘটেছে। লাখ লাখ আমানতকারী এর ফলে ৰতিগ্রসত্ম হয়েছে যদিও সরকারী হসত্মৰেপে শেষ পর্যনত্ম তারা ৰতি কিছুটা পুষিয়ে নিয়েছে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, আমরা ইদানীং দেখলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ঘটনা। সসত্মায় ও সুলভে (সাব-প্রাইম ফোন) গৃহঋণ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলো বিশ্বব্যাপী কী 'হ্যাভক' তৈরি করেছে তার উদাহরণ এখনও জ্বলজ্বল করছে। এসবের প্রেৰাপটে আমানতকারীদের রৰার ব্যবস্থা কী? আমানতকারীরা আগে টাকা রাখতেন সরকারের ব্যাংকে যেখানে সরকার হচ্ছে গ্যারান্টার। এখন আমানতকারীরা বেসরকারী ব্যাংকেও যাচ্ছেন। সেখানে তাঁদের টাকার নিরাপত্তা কী? সেবার মান ভাল। দেখতে তাদের চেহারা আলোয় ঝলমল। কমর্ীরা ভীষণ স্মার্ট। তারা মুনাফাও করে অনেক বেশি। কিন্তু আমানতকারীদের টাকার নিরাপত্তা কী? এদের কেউ 'বিসিসিআই' হবে না তো, এদের কেউ 'বিসিআই' হবে না তো, এদের কেউ ওরিয়েন্টাল ব্যাংক হবে না তো? এসব প্রশ্ন মানুষের মনে কাজ করে। মানুষ নিরাপদ জায়গায় টাকা রাখতে চায়। সারা জীবনের সম্পদ খোয়া যাক এটা যে কোন আমানতকারীর জন্য একটা দুঃস্বপ্ন। আবার মানুষ সুদ হিসাবে দুটো পয়সা বেশিও চায়। দেশে ৩০টি বেসরকারী ব্যাংক, ১০টি সরকারী ব্যাংক এবং ৮টি বিদেশী ব্যাংক। কার শক্তি কতটুকু, কোথায় আমানতকারীর টাকা বেশি নিরাপদ? এ প্রশ্নের কোন উত্তর ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংক এ প্রশ্নের একটি উত্তর দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে একটি 'আমানত বীমা' আছে। এর অধীনে বর্তমানে দুই লাখ টাকা পর্যনত্ম আমানত বীমাকৃত। কোন ব্যাংক যদি দেউলিয়া হয় তাহলে এর গ্রাহকরা দুই লাখ টাকা পর্যনত্ম বীমাকৃত অর্থাৎ দুই লাখ টাকা যাদের আমানত তারা সেই টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পেয়ে যাবে। অধিকন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ম করেছে প্রত্যেকটি 'ব্যাংককে' নিজেদের 'রেটিং' ঘোষণা করতে হবে। এর জন্য 'রেটিং'-এর কাজ করছে এবং এরা কোন ব্যাংকের মান কী রকম তা পরীৰা-নিরীৰা করে বলে দিচ্ছে। এখানে নিয়ম হচ্ছে এ 'রেটিং' খবরের কাগজে প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দুটো। প্রথমত, কোন্ ব্যাংক 'এ' গ্রেডের, কোন্ ব্যাংক 'বি' গ্রেডের তা কোন খবরের কাগজে চাপা হয় তা কেউ জানে না। প্রতিটি শাখায় তা নোটিস বোর্ডে টানিয়ে রাখার বাধ্যবাধকতা থাকা দরকার যাতে যেকোন সম্ভাব্য আমানতকারী বুঝতে পারে ঐ ব্যাংকের শক্তি-সামর্থ্য কতটুকু। এ কাজটি হচ্ছে না। 'রেটিং' যে ভাষায় দেয়া হয় এবং ইংরেজিতে যে ভাষায় শর্তাবলী উলেস্নখ থাকে তা কোন আমানতকারীর পৰেই বোঝা সম্ভব নয়। অধিকন্তু 'রেটিং'-এর গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। তবু মন্দের ভাল, একজন আমানতকারী অনত্মত জানতে চাইলে জানতে পারবেন যে ব্যাংকে তিনি টাকা রাখছেন সেই ব্যাংকের টাকা ফেরত দেয়ার শক্তি সামর্থ্য কতটুকু। এখানে উলেস্নখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেরা প্রতিটি ব্যাংকের 'ক্যামেলস' রেটিং করে। 'ক্যাপিটেল', 'এ্যাসেট', ম্যানেজমেন্ট, আর্নিং, লিকু্যইডিটি এবং সেনসিটিভিটি ইত্যাদির ভিত্তিতে যে রেটিং তারা করে তা তারা গোপন রাখে। এ গোপনীয়তার অর্থ কী তা আমি বুঝতে পারি না। আমানতকারীদের স্বার্থে তা প্রকাশ করতে আপত্তি কোথায়? রেটিং এজেন্সির 'রেটিং' যদি প্রকাশ করা যায় তাহলে 'ক্যামেলস' রেটিং-এর ফলাফল জানাতে আপত্তি কোথায়? আপত্তির কথাটা জানালে এর ওপর মতামত দেয়া সম্ভব হবে।
ব্যাংকের যে 'রেটিং'-এর কথা ওপরে উলেস্নখ করলাম সেই 'রেটিং' বহুলাংশে নির্ভর করে ব্যাংকের সম্পদের গুণগত মানের ওপর। ব্যাংকের সম্পদের সিংহভাগই হচ্ছে প্রকৃত ঋণ। এর পরিমাণ ৮০-৮৫ শতাংশ। যে ব্যাংক যত ভাল গ্রাহককে ঋণ দিতে পারে সেই ব্যাংক রেটিং-এ তত ওপরে। পুঁজির পর্যাপ্ততা, শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের বিপরীতে রৰিত প্রভিশনের পরিমাণ ইত্যাদি ব্যাংকের শক্তির দিক। বর্তমানে একটি ব্যাংককে তার ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের (রিস্ক ওয়েটেড এ্যাসেট) ১০ শতাংশ পরিমাণ টাকা রাখতে হয় পুঁজি হিসাবে। বোঝাই যাচ্ছে 'রিস্ক ওয়েটেড এ্যাসেটস' যদি বেশি হয় তাহলে পুঁজি রাখতে হবে বেশি। পুঁজির এই হিসাবকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাষায় পুঁজির পর্যাপ্ততা অথবা 'ক্যাপিটেল এডিউকেসি' বলা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক এই পর্যাপ্ততা রৰা করানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। ব্যবসা করলে পর্যাপ্ত পুঁজি রাখতে হবে। ব্যাংকের ব্যবসায় ঝুঁকি আছে। লোকসান হলে এর বাড়ি কোথায়? এ লোকসান কী আমানতকারীরা বহন করবে? নিশ্চয়ই নয়। ব্যবসায়িক ঝুঁকির কারণে লোকসান হলে সেই লোকসান বহন করতে হবে ব্যাংকের মালিকদের। আর সেটা তারা তখনই করতে পারবে যখন তারা পর্যাপ্ত মূলধন বা পুঁজি রাখতে সৰম হবে। ব্যাংকের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি ঋণে। প্রদত্ত ঋণের টাকা ফেরত না আসলেই ব্যাংক বিপদে পড়ে। এ জন্য ঋণের ৰেত্রে ব্যাংককে যারপর নাই সতর্ক হতে হয়। বর্তমানে ঋণের টাকা আদায় না হলে তার বিপরীতে 'প্রভিশন' রাখার কড়াকড়ি নিয়ম আছে। 'প্রভিশন' রাখতে হয় 'প্রফিট' থেকে। কুঋণ বা শ্রেণী বিন্যাসিত ঋণের পরিমাণ বেশি হলে 'প্রভিশন' বেশি রাখতে হয়। 'প্রভিশন' বেশি রাখলে ব্যাংকের লাভ কম হয় অথবা হয় ৰতি। এ কারণেই শ্রেণী বিন্যাসিত ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখার ব্যাপারে কড়াকড়ি করা হচ্ছে। এবং এর সঙ্গে জড়িত করে দেয়া হয়েছে পুঁজির পর্যাপ্ততাকে।
ঋণের গুণগত মানের সঙ্গেই জড়িত আমাদের পূর্বাহ্নে উলেস্নখিত রেটিং-এর প্রশ্নটি। ব্যাংক 'রেটিং' হচ্ছে। এটা জড়িত আমানতকারীদের স্বার্থের সঙ্গে। বস্তুত সবকিছুই শেষ পর্যনত্ম আমানতকারীর স্বার্থের সৃেঙ্গ জড়িত। উপস্থিত ৰেত্রে কর্পোরেট কায়েন্টদের যে রেটিং কথা উলেস্নখ করেছি তাও শেষ বিচারে আমানতকারীদের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে একজন গ্রাহক ব্যাংক থেকে যখন ঋণ নিতে চায় তখন তাকে ব্যবসায়িক একটা প্রসত্মাব দিতে হয়। 'গ্রাহক-ব্যাংক' সম্পর্কের ভিত্তিতে সেই প্রসত্মাব ব্যাংক বিবেচনা করে। প্রসত্মাবটির রিস্ক গ্রেডিং হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মের মধ্যে পড়লে ঋণটি অনুমোদন লাভ করে। আগামী দিনে এ বিবেচনা তো থাকবেই অধিকন্তু হবে কর্পোরেট গ্রাহকদের ক্রেডিট রেটিং। এ ধরনের কাস্টমার সমগ্র ব্যাংকিং খাতে আছে প্রায় ২০,০০০। তাদের প্রত্যেকের 'ক্রেডিট রেটিং' হবে। তাদের ঋণ দেয়া যায় কী না তার জন্য রেটিং হবে। রেটিং-এর স্কোরই বলে দেবে কোন্ কাস্টমারকে ঋণ দেয়া যায়, কোন্ কাস্টমারকে ঋণ দেয়া যায় না। দৃশ্যত এ ধরনের ব্যবস্থায় ব্যাংকগুলোর শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের (কাসিফাইড লোন) বোঝা কমার একটা সম্ভাবনা আছে। কারণ গ্রাহকের রেটিং ভাল না হলে সে ঋণ পাবে না। কিন্তু অনেক সমস্যাও আছে।
প্রথম সমস্যা হচ্ছে কুড়ি হাজারের মতো কর্পোরেট কায়েন্ট। আমার জানা মতে দেশে বর্তমানে দুটো ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি আছে। তাদের কাজের দৰতা সম্পর্কে অনেকেই এখনও নিশ্চিত নয়। এ ব্যবসাটি নতুন। এর জন্য কারিগরি জ্ঞান দরকার যা এখনও আমাদের দেশে 'ডেভেলপ' করেনি। এতদসত্ত্বেও বলা যায় দুটো প্রতিষ্ঠানের পৰে এতগুলো কায়েন্টের রেটিং কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। দ্বিতীয় প্রশ্ন, এ রেটিং কে করাবে? রেটিং-এর প্রয়োজনীয়তা ব্যাংকের। ব্যাংকই বিপদে আছে। কাকে সে ঋণ দেবে, কাকে সে ঋণ দেবে না এ প্রশ্নের উত্তর ব্যাংকেরই দরকার। কায়েন্টের উৎসাহ এৰেত্রে খুবই কম হওয়া স্বাভাবিক। ব্যাংক যদি করায় তাহলে এর খরচ দেবে কে? গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হলে গ্রাহক সেই রেটিংকে প্রভাবান্বিত করবে না কি? এ ব্যাপারগুলো বিবেচনা করার বিষয়। সর্বোপরি সমস্যা হবে উপাত্ত নিয়ে। কুড়ি হাজার কায়েন্টের মধ্যে খুব কমই হবে 'পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি'। বেশির ভাগই হবে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি অথবা পার্টনারশিপ। এদের ক'জন ডাবল এন্ট্রি সিস্টেমে এ্যাকাউন্ট রাখে তাতে আমার সন্দেহ আছে। তাদের দৈনন্দিন হিসাব একভাবে রাখা হয়। বছর শেষে চার্টার্ড এ্যাকাউন্টেন্ট দিয়ে খুশি মতো তাকে চূড়ানত্ম হিসাব তৈরি করা হয়। যেসব উপাত্ত রেটিং-এর জন্য দরকার হবে তা পাওয়ার কাজটি হবে দুরূহ। তথ্য-উপাত্তের অভাবে রেটিং-এর কাজটি কীভাবে সম্পন্ন হবে এ চিনত্মা ব্যাংকগুলোকে আগেভাগেই করে রাখতে হবে। অথচ খবরের কাগজে পড়ে মনে হচ্ছে কর্পোরেট কায়েন্টদের রেটিং-এর কাজটি করতে হবে বিলম্ব না করেই। রেটিং এজেন্সি নেই, তথ্য-উপাত্ত অপ্রতুল, প্রস্তুতির অভাব_এতসব নেতিবাচক অবস্থার মধ্যে এ কাজটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক কীভাবে বাসত্মবায়িত করবে তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। অথচ ব্যাসেল-২ নামীয় যে এ্যাকাউন্ট আছে তা কার্যকর করতে হলে এটা করতে হবে। এই সমগ্র বিষয়টি পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে হিসাব রৰণ ৰেত্রে গুণগত মানের দরকার হবে। ব্যাংকে ব্যাংকে যে 'এ্যাকাউন্টস' বিভাগ আছে সেখানে কোয়ালিফাইড এ্যাকাউন্টেন্টস কতজন? খুব কম ব্যাংকেই গুণগত মানসম্পন্ন হিসাব রৰণ বিভাগ আছে। মজা হচ্ছে এ ৰেত্রে প্রস্তুতিও কম। অধিকন্তু যে কুড়ি হাজার বড় কায়েন্টের ক্রেডিট রেটিং করতে হবে সেখানে কোয়ালিফাইড একাউন্টেন্টের অভাব আছে। এ ব্যাপারেও সরকারের চিনত্মাভাবনা করা উচিত।
পরিশেষে একটি বিষয়ে দু'একটি মনত্মব্য করা দরকার। দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোর সুরৰার জন্য একের পর এক পদৰেপ নিচ্ছে। ব্যাংক চালাতে অনেক ঝুঁকি আছে। সেই ঝুঁকিগুলো তারা অনেক আগেই চিহ্নিত করেছে। ঋণের ঝুঁকি বহু আগেই বিবেচিত হয়েছে। বাজার ঝুঁকি এবং অপারেশনসের ঝুঁকি ইত্যাদিও বিবেচিত হওয়ার পথে। এসবই ভাল লৰণ এবং ভাল পদৰেপ। আনত্মর্জাতিক মানে ব্যাংকগুলোকে নিতে হলে ব্যাসেল-২ মোতাবেক এসব পদৰেপ নিতেই হবে। জানি এর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু প্রশ্ন আমাদের দেশের ব্যাংকিং-এ কী এগুলোই একমাত্র সমস্যা এবং ঝুঁকি? ১৯৮২-৮৩ সালে বেসরকারী খাতে ব্যাংক দেয়ার দু'বছরের মধ্যেই সকল বেসরকারী ব্যাংক জালিয়াতির কারণে ডুবতে বসেছিল। ঐ সমস্যা বাজার ঝুঁকি থেকে সৃষ্ট হয়নি। 'বিসিসিআই', 'বিসিআই' এবং 'ওরিয়েন্টাল ব্যাংক'-এর যে সমস্যার কথা উলেস্নখ করলাম তা কীসের জন্য সৃষ্ট হয়েছিল? মালিক যদি 'ডেবিট ভাউচার' সই করে শত শত কোটি টাকা নিয়ে যায় এবং এ কাজে সহায়তা করার জন্য যদি দুই-তিন-চার লাখ টাকা মাসিক বেতনধারী কর্মচারী থাকে তাহলে কাস্টমারের ক্রেডিট রেটিং দিয়ে কী হবে? অবস্থাদৃষ্টে তো মনে হয় ব্যাংকমালিকদের ক্রেডিট রেটিং দরকার। তাই নয় কী? সততা, নিষ্ঠা, দৰতা, অনিয়ম সংঘটন, সামাজিক গুড উইল এবং রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার নিরিখে মালিকদের রেটিং হলে ৰতি কী?
লেখক : অর্থনীতিক, ব্যাংকার,
ঊ-সধরষ : ৎধহধফবনহধঃয@সংহ.পড়স

No comments

Powered by Blogger.