স্বপ্নের দিলস্নী যাত্রা by রাজু মোসত্মাফিজ

হাইওয়ে রাসত্মা দুচোখ দিয়ে যতণ দেখা যায় দেখছি। আগ্রার রাসত্মার দু'-পাশে প্রচুর কলকারখানা তৈরি হচ্ছে। ঘন বন, জঙ্গল নেই। সব কিছুতেই আমাদের দেশের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে। দুপুর বারোটায় আগ্রা সিটি শহরে ঢুকে পড়ি।
মেইন শহর থেকে বেশ দূরে আগ্রা-ফোর্ট আর সপ্ত-আশ্চর্যের অমরকীর্তি সম্রাট শাহজাহানের তৈরি তাজমহল। সাড়ে ১২টার দিকে আগ্রা-ফোর্ট পেঁৗছালাম। আগ্রা-ফোর্টের প্রায় পুরোটাই ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। শুধু একটি অংশ পর্যটকদের জন্য খুলে দিয়েছে ভারত সরকার। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক এখানে আসে। ১৬৩৯ সালে সম্রাট শাহজাহান আগ্রা-ফোর্ট নির্মাণ করেছিলেন। শাহজাহানের শাসন আমলে এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছিলেন। পরবতর্ীতে আওরঙ্গজেব এবং অন্যান্য মোগল শাসকরা বেশ কিছু অবকাঠামো তৈরি করেন। এখানে হাতী ও ঘোড়া থাকার ব্যাবস্থা ছিল। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে এই ভবনটির অবকাঠামোর গুরম্নত্বপূর্ণর্ অংশের পরিবর্তন করা হয়। আগ্রা-ফোর্টে প্রায় দেড় ঘণ্টা ঘুরে বেড়িয়ে আমরা সকলে আবার বাসে উঠলাম। গাইড আমাদের নিয়ে গেলেন আগ্রা শহরে তাজমহল দেখার উদ্দেশ্যে। পৃথিবীর সপ্ত-আশ্চর্যের নিদর্শন এই তাজমহল। ভারতের পরিবেশবাদীদের দাবি অনুযায়ী তাজমহল রার্থে গাড়ির কালো ধোঁয়া যেন তাজমহলের কাছে না যায়, এ জন্যই নির্দিষ্ট এক পার্কে আমাদের গাড়ি এসে থামল। এখান থেকে উটের গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি অথবা বিশেষভাবে নির্মিত ব্যাটারি চালিত গাড়িতে তাজমহলের গেটের কাছে যেতে হবে। বাস থেকে নেমেই ব্যাটারি চালিত গাড়িতে উঠে তাজমহলের গেটের কাছে নামলাম। স্বপ্নের তাজমহলের কাছে এসে পড়েছি। যমুনা নদীর ডান তীরে অবস্থিত আগ্রা শহর থেকে প্রায় তিন কিঃমিঃ দেিণ তাজমহল অবস্থিত। সম্রাজ্ঞী আরজুমান্দ মমতাজ বেগমের নামানুসারে ভালবাসার স্মৃতি স্বরূপ সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি এটি। শাহজাহান এবং মমতাজের ভালবাসা ছিল অবিচ্ছিন্ন। মমতাজ মৃতু্যর সময় শাহজাহানের কাছে তাঁর শেষ ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন, তিনি যেন গভীর ভালবাসার নির্দশন স্বরূপ তার কবরের উপরে সুন্দর ও অতুলনীয় একটি সৌধ নির্মাণ করেন। সম্রাট শাহজাহান প্রিয়তমা স্ত্রীর শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য তুর্কি ওসত্মাদ ইশা আকন্দির নক্সা অনুযায়ী তাজমহলের কাজ শুরম্ন করেন। রাজস্থানের নাগর জেলার মাকবানা থেকে আনা হয় সাদা মার্বেলপাথর। ঢোলপুর এবং ফতেপুর থেকে আনা হয় লালপাথর। নরবাদ ও চরকহ থেকে আনা হয় হলুদ ও কালো পাথর। এ ছাড়াও আরও অনেক মূল্যবান পাথর, স্বর্ণ, রৌপ্য দেশ বিদেশের রাজা-বাদশাদের কাছ থেকে উপঢৌকন হিসেবে পাওয়া গিয়েছিল।
তাজের পাশাপাশি এখানে আরও নির্মাণ করা হয়েছে জামাতখানা, তিনটি সিঁড়িযুক্ত প্রধান ফটক, মসজিদসহ ছোট ছোট কিছু দালান। নিখুঁত কারম্নকাজ। অকানত্ম পরিশ্রম আর অসম্ভব মেধা খরচ করে তাজমহলের সমসত্ম গম্বুজ ও পিলারে কালো, সাদা, সোনালি পাথর কেটে বসিয়েছে শিল্পীরা। গেট পেরিয়ে তাজমহলের মূল সৌধের কাছে যেতে বেশ কিছু পথ হাঁটতে হয়। নিচ থেকে ২১টি সিঁড়ি পার হয়ে তাজমহলের মূল বেদীতে প্রবেশ করতে হয়।
যখন পশ্চিমের সূর্য হেলে লাল আভা চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে, কানত্ম পাখিগুলো ঘরে ফিরতে শুরম্ন করেছে_এমনি এক সময়ে আমি তাজমহল থেকে বেরিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে উঠলাম। আমাদের বাস অপো করছে। প্রচ- গরম। আমাদের বাস মথুরার উদ্দেশে রওনা দিল। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর মথুরায় পেঁৗছে গেলাম আমরা। মথুরা শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি। এখানে গড়ে উঠেছে বিশাল কৃষ্ণ-মন্দির। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা এই মন্দিরটি দিন-রাত পাহারা দেয়। শ্রী-কৃষ্ণের মন্দিরের সঙ্গে মোগল আমলের মসজিদ রয়েছে। মসজিদ, মন্দিরে দুই সমপ্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে প্রার্থনা করে। সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে এই মসজিদটি তৈরি হয়েছিল। এখান থেকে রাত ৮টার দিকে আমাদের বাসটি বৃন্দাবনের দিকে রওনা দিল। মাত্র আধঘণ্টার মধ্যে পেঁৗছে গেলাম সেখানে। এটি হিন্দু সমপ্রদায়ের গুরম্নত্বপূর্ণ একটি তীর্থস্থান। এখানে ৫০০ মন্দির রয়েছে। ৯,০০০ একর খালি জমিতে হাজার হাজার গরম্ন অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বৃন্দাবনের বিভিন্ন মন্দিরে ২০০০ বিধবা মহিলা শুধু মানুষের সেবা করে এবং মন্দিরের দেখাশোনা করে। মানুষের অনুদানে এইসব বিধবাদের জীবন চলে। গাইড বাসের সব যাত্রীদের মন্দির দেখাতে নিয়ে গেল। আমাদের মধ্যে অনেকই পুজো দিল। এখান থেকে রাত ১০টার দিকে বাস ছাড়ল দিলস্নীর উদ্দেশে। রাত পৌনে দু'টার দিকে আমরা দিলস্নীতে পেঁৗছালাম। নগরীর মানুষ তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। কেবল দূরপালস্নার বাস আর ট্রাকগুলো দ্রম্নতবেগে চলাচল করছে। হোটেলে পেঁৗছে আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর যাবার কথা। ট্রাভেল এজেন্সি থেকে জানানো হলো বাসের সমস্যার কারণে সকালে যাওয়া হবে না। ৪০৫ নম্বর বাসে লালবাগের কেলস্না গেলাম। দিলস্নীর অপূর্ব সুন্দর স্থাপনাগুলোর মধ্যে লালবাগের কেলস্না অন্যতম একটি। সম্রাট শাহজাহান লালবাগের কেলস্না স্থাপন করেছিলেন। নির্মাণ করতে প্রায় ১০ বছর সময় লেগেছিল। এতে রয়েছে দুটি প্রবেশপথ। দিলস্নী-গেট এবং লহরী-গেট। বিভিন্ন জায়গায় বাগান রয়েছে। এখানে রয়েছে তিনটি জাদুঘর, শৈল্পিক নন্দন দালান, লহরী-গেট, মিনাবাজার, নওয়াবখানা, দীনিয়াম এবং মতি মসজিদ। এই রেডফোর্টেই ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ-রাজের পতাকা নামিয়ে স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। এখান থেকে নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরবারে যাই। প্রায় আধঘণ্টা সময় কাটাই। সেখান থেকে বেরিয়ে মোগল স্থাপত্য-যুগের চমৎকার কীর্তি হুমায়ুনের সমাধিস্থলে যাই। ১৬৬৫ সালে ১৬ লাখ রম্নপী মূল্যে হুমায়ুনের বিধবা স্ত্রী হাজী বেগম কর্তর্ৃক লাল বালির পাথর ও সাদা রঙের টাইল্স দিয়ে এটি নির্মিত হয়। সম্রাট হুমায়ুন নিজেই তাঁর সমাধির জায়গা নির্বাচন করে গিয়েছিলেন। মনোরম এক বাগানের ভেতর এই সৌধটি। ইতিহাসবিদরা মনে করেন সম্রাট শাহজাহান এটিকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েই আগ্রার তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন।
পড়নত্ম বিকেলে গোলবাজার এলাকায় নেমে পড়লাম আমি। এখান থেকে সন্ধ্যার পর হোটেলে ফিরলাম। রাত সাড়ে নয়টার দিকে পংকজ ট্রাভেল্সের বাসে আজমীর শরীফে যাব। সাড়ে আটটার দিকে হোটেল থেকে বেরিয়ে রাজস্থান ট্রাভেল্স এজেন্সিতে গেলাম। অফিস কতর্ৃপ আমাকে বাসে উঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। দোতলা বাস, শোবার জন্য আলাদা আলাদা কেবিন রয়েছে। আমার কেবিনে দিলস্নীর এক যুবক উঠেছে। নাম মোঃ আব্দুলস্নাহ। তিনি আজমীর শহরে এক অফিসে কাজ করেন। রাত ১০টার দিকে বাস ছাড়ল। বিরতিহীনভাবে বাস চলল। দিলস্নী থেকে ২৬৫ কিঃমিঃ দূরে আজমীর নগরী। এখানে খাজা মুইনুদ্দিন চিশ্তি (রাঃ) মাজার।
প্রতিবছর সারা পৃথিবীর ধর্মপ্রাণ মানুষ এবং পর্যটক এখানে আসেন। সারা বছর ভিড় লেগেই থাকে। পূর্বের আকাশ ফর্সা হয়নি তখনও, সে রকম সময়ে চারদিকে পাহাড়ঘেরা আজমীর শহরে পেঁৗছলাম। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নগরী ধীরে ধীরে ব্যসত্ম হয়ে উঠতে থাকে। আমি আর মোহাম্মদ আবদুলস্না একটি টেম্পোতে রওনা দিলাম খাজা মইনুদ্দীন চিশ্তি (রঃ) সাহেবের মাজারে। ১৫ মিনিটের মধ্যে পেঁৗছে গেলাম। এক সময় আবদুলস্না আমার কাছ থেকে বিদায় নিলেন। মাজার শরীফ জিয়ারত করার পরও প্রায় দু'ঘণ্টা অবস্থান করলাম এখানে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে মহান এ ব্যক্তিত্বের মাজার শরীফ। মাজার শরীফের প্রবেশদ্বারে পুলিশের সিকিউরিটি বেশ জোরদার। ১১টার দিকে মাজার প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে আজমীর বাসস্ট্যান্ডে গেলাম। রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর শহরে যাব। ৭০ টাকা দিয়ে বাসের টিকেট কেটে বাসে উঠে পড়লাম। দুপুর আড়াইটার দিকে জয়পুর সিটিতে পেঁৗছে গেলাম। সুন্দর শহর জয়পুর। এখানকার অধিকাংশ ভবন গোলাপী রঙের । সবকিছু পরিকল্পিতভাবে তৈরি করেছে জয়পুর সরকার। পুরাতন জয়পুর শহরকে পিং সিটি বলা হয়। আগ্রা রোডে দুই তারকা হোটেল ব্রোডওয়েতে উঠলাম। তৈরি হয়ে ৪টার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম জয়পুর শহরে। জহুরীবাজার, ইন্দিরাবাজার, বাপুবাজার, লালকেলস্না বাজারসহ অসংখ্য বাজার রয়েছে এই নগরীতে। এ সব বাজারের প্রবেশমুখগুলো মসজিদের আদলে তৈরি। এগুলোকে স্থানীয়রা সিটিগেট বলে। এসব বাজারে হসত্মশিল্প, জুয়েলারি, কাপড়ের দোকান রয়েছে। বাজারগুলোর রাসত্মার ধার দিয়ে কাঁচা শাকসব্জির দোকান বসেছে। অধিকাংশ দোকানি মহিলা। জয়পুরের হসত্মশিল্প আর গহনার নাম ও স্তুতি পৃথিবীজুড়েই রয়েছে। জহুরী মার্কেটে বেশ কিছু কেনাকাটা করলাম। এভাবে কখন রাত ৯টা বেজে গেছে টেরই পাইনি। হোটেলে ফিরলাম। পরদিন সকালেই ওঠার পর হোটেল ম্যানেজার কেএস গুরজার সাহেব আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। মোটরসাইকেলে জয়পুর শহর ঘোরালেন। ৯টার দিকে রাজস্থান টু্যরিজম উন্নয়ন কর্পোরেশন লিমিটেড অফিসে নিয়ে গেলেন। সেখান থেকে সকাল সাড়ে ৯টায় বাস ছাড়ল। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যনত্ম ১২টি স্পট ঘুরে দেখাবে বাস কতর্ৃপ। প্রথমেই নিয়ে গেল দণি জয়পুরে মতিডাঙ্গারী পাহাড়ের বিরলা মন্দির। স্থানীয়রা একে লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির বলে জানে।

No comments

Powered by Blogger.