খাবার টেবিলের অত্যাচার- আনোয়ারা সৈয়দ হকের কলাম

সেদিন একজনের বাড়িতে নেমনতন্ন রা করতে গিয়ে আমার এক জবর শিা হলো । মনে হলো লাফ মেরে খাবার টেবিল ছেড়ে বাইরে এক দৌড় দিই । কিন্তু দৌড় দেবার ইচ্ছে মনে ষোলোআনা থাকলেও বাইরে শীতের উৎপাত সেদিন এত বেশি যে, সে ইচ্ছেটাও দমন করতে হলো ।
এদিকে আমার খাবার থালাটার দিকে তাকিয়ে কান্না চলে এলো চোখে । যার নিমন্ত্রণে সেই বাড়িতে গিয়েছি সেই মহিলা এত ভাল যে, প্রতি দশ সেকেন্ড পর পর আমার খাবারের পেস্নটে মাছ-মাংস তুলে দিচ্ছেন । আর অনর্গল সব ভাল ভাল কথা বলে যাচ্ছেন । তিনি বলছেন, ''আপা, মাছের এই টুকরোটা খান। আপনি আজ খাবেন বলে একটু বড় সাইজ করে কাটা হয়েছে । এটা হলো বোয়াল মাছ । আর এই মাংসের পিসটা খুব ভাল । এটা হলো বকরীদের মাংস আপা, ডিপফ্রিজে এতদিন যত্ন করে তুলে রেখে দিয়েছিলাম। আপনি আসবেন শুনে ফ্রিজ থেকে আজ বের করেছি। আর এই কাবাবটা আপা, এটা আমার নিজের হাতে তৈরি। এর নাম হাড়িয়া কাবাব । আমার মতো করে কেউ এ কাবাব তৈরি করতে পারে না এই তলস্নাটে। এটাও কোরবানির গোশত দিয়ে তৈরি । না, না, আপত্তি করলে কিছু হবে না আপা। আমি আপনার কোন আপত্তি শুনব না ! ভাবছেন হাই কোলেস্টেরল? আরে আপা, এটা হলো কোরবানির গোশত। আলস্নাহর নাম করে যতই খান না কোন তি হবে না । আর খাওয়া শেষে একটু মিষ্টিও খেতে হবে, আপা। আমার নিজের হাতে তৈরি খেজুরের গুড়ের ীর। ডায়াবেটিস তো কি। একটু খেলে কিচ্ছু হবে না।''
আমি নিরম্নপায় হয়ে যতই তাকে বোঝাতে লাগলাম যে, আমার হাইপ্রেসার আছে, ডায়াবেটিস আছে, ওভার ওয়েট আছে, হার্টের দোষ আছে, বয়সও খুব একটা কম না কিন্তু হাহতোস্মি! কে শোনে কার কথা!
বিয়েবাড়িতে গিয়েও দেখেছি ঐ একই অবস্থা । কনেকে বা বরকে আশীর্বাদ করতে গিয়েছি, আশীর্বাদ করে চলে আসব কিন্তু আসব কি করে? বরকর্তা বা কনে প একেবারে হামলে পড়বে। ''আঃ, আপা, একেবারে না খেয়ে আশীর্বাদ করে চলে যাবেন? ডাক্তার বিরিয়ানি খেতে মানা করেছেন? আহা, একদিন বিরিয়ানি খেলে কিছু হবে না আপা । কিচ্ছুই হবে না। ''
তখন তাকে বলা যায় না যে, মাসে এই রকম পাঁচ থেকে সাতবার বিরিয়ানি খাওয়ার দাওয়াত আমার আসে ।
আমি দুনিয়া ঘুরে দেখেছি কিন্তু পৃথিবীর আর কোথাও বাঙালীদের মতো খাওয়ার টেবিলে মানুষকে জোর করে খাওয়াতে দেখিনি । জোর করাটা মাঝে মাঝে এমন এক পর্যায়ে পড়ে যাকে সন্ত্রাসী আগ্রাসন বলাটাও খুব একটা ভুল হবে না । অনেক বাঙালী মহিলা মনে করেন তিনি তখনই একজন ভাল গৃহিণী যখন জোর করে মানুষের পেটের ভেতরে ভাল ভাল খাবার ঢোকাতে পারবেন। খাওয়ার টেবিলে আর কারো কোন আধিপত্য চলবে না। শুধু চলবে সে বাড়ির গৃহিণীর আধিপত্য।
বিদেশের সংস্কৃতিতে এভাবে জোর করে মানুষকে খাওয়ানো একটি অমার্জিত ব্যবহার। সবচেয়ে বড় অমার্জিত ব্যবহার হচ্ছে মানুষের পাতে জোর করে খাবার তুলে দেয়া। যে বোয়াল মাছ জীবনেও খায়নি, তার পাতে বোয়াল মাছ তুলে দেয়া । যে গরম্নর মাংস দশ বছর ধরে খায় না, তার পাতে বোয়াল মাছ তুলে দেয়া। হঁ্যা, খাবার টেবিলে অতিথিদের বেশি করে খাওয়ার জন্য অনুরোধ অবশ্যই করা যায় কিন্তু মাত্র একবারই সে অনুরোধ করা জায়েজ । একবারের বেশি দু'বার বা তিনবার অনুরোধ করাটা হলো অত্যাচার।
বাঙালি জাতির খাওয়ার টেবিলের ব্যবহার ও আচরণ নিয়ে একটা বই লিখে ফেলা যায় । যেমন বহু সম্ভ্রানত্ম এবং বড়লোকের বাড়িতে দেখেছি টেবিলে খেতে বসে মাছের কাটাকুটি, মাংসের হাড় ও চর্বি এবং তরকারির খোসা ও মরিচের ছিলকা টেবিলের ওপরেই ফেলে রাখতে। পাশে কোয়ার্টার পেস্নট মাছের বা মাংসের উচ্ছিষ্ট ফেলার জন্য রাখা থাকলেও সেদিকে বিন্দুমাত্র দৃষ্টিপাত করেন না। আবার দেখেছি খেতে খেতে ডান হাত দিয়ে গস্নাস ধরে ঢকঢক করে পানি খেতে। বাঁ হাতটাকে অতি অপবিত্র মনে করে সে হাতে পানির গস্নাস না ছুঁতে। আরও দেখেছি ভাত খেয়ে উঠে পানি পান করার সময় প্রথমে মুখে পানি নিয়ে একটা কুলকুচি করতে, তারপর সেই পানি মাটিতে না ফেলে গিলে ফেলতে। অথচ সেই পানির ভেতরে ছিল একটু আগেই খেয়ে সারা খাদ্য কণিকার অজস্র টুকরো যেগুলো দাঁতের ফাঁকে আটকে ছিল খাওয়ার সময় । সত্যি বলতে সেই কণিকাগুলোও হচ্ছে খেয়ে ফেলা খাদ্যের উচ্ছিষ্ট। খাওয়া শেষে খাদ্যের উচ্ছিষ্ট কে খায়? বাঙালী খায়!
বাঙালী চরিত্রে পরিচ্ছন্নতাবোধ অতিশয় নিম্নমানের। খাবার টেবিলে বাড়ির গৃহিণীদের ব্যবহার সেই সার্বিক অপরিচ্ছন্ন ব্যবহারেরই একটি জ্বলনত্ম নমুনা ।
এমন একদিন ছিল যখন বাংলাদেশে দুর্ভি লেগেই থাকত । অধিকাংশ মানুষ তিনবেলা ভাত খেতে পারত না বা তাদের ভাল-মন্দ খাওয়ার মওকা জুটত না । কিন্তু এখন কিছুটা হলেও দিন পাল্টেছে । মানুষের খাদ্যাভাব কিছুটা হলেও কমেছে । আবার সেই সঙ্গে খাবারের ব্যাপারেও মানুষের সচেতনতা বেড়েছে । মানুষ বুঝেছে , মানুষের বয়স যত বাড়ে , শরীরে খাদ্য খাবারের প্রয়োজন তত কমে যায় । বস্তুত মানুষ তার বয়সের নিয়ম না মেনে যদি অতিরিক্ত আহার করে তাহলে তার আয়ু অতি দ্রম্নত য়ে যায় । বরং শরীরে যে খাবারের চাহিদা আছে তার চেয়ে একটু কম খাওয়াটা স্বাস্থ্যের জন্য একটা জরম্নরী ব্যাপার ।
কিন্তু আমাদের বাঙালী পরিবারে গৃহিণীরা যতদিন সচেতন না হচ্ছেন এবং পেটুক পুুরম্নষেরা নিজেদের রসনা সম্বরণ না করছেন , ততদিন আমাদের খাওয়ার টেবিলে এই ধরনের অত্যাচার চলতেই থাকবে । আমি আশা করছি এমন একদিন আসবে যেদিন এক গণঅভু্যত্থানের মাধ্যমে পরিবারের ভেতরে তো বটেই , পারিবারিক অনুষ্ঠানেও মানুষ ভাত বা বিরিয়ানির বদলে একগাদা সালাদ থালায় নিয়ে হাসিমুখে শুধু সালাদ খেয়েই বর-কনেকে আশীর্বাদ করে বাড়ি ফিরবেন ! আবার বাড়ির খাবার টেবিলগুলো থাকবে বিভিন্ন ধরনের সালাদের আইটেম দিয়ে সজ্জিত। তার ভেতরে ভাতও থাকবে তবে সে ভাত তখন হয়ে যাবে একমুঠি একটা ম- মাত্র , ঠিক যেমন জাপানীরা ভাত খায় এবং এক শ' বছর হেসে খেলে বেঁচে থাকে । এই অভু্যত্থানের ফলে কিছু পেটুক পুরম্নষ যে আশা ভঙ্গ হয়ে হার্টফেল করে মরবেন তাতে সন্দেহ নেই! আর কিছু বাবুর্চির আত্মহননের ঘটনা ঘটবে । তবে সব ভাল কাজের ভেতরেই কিছু গুনাহগার দিতে হয় !

No comments

Powered by Blogger.