সরকার ও জনশক্তি রপ্তানিকারকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব- থমকে আছে থাইল্যান্ডে ৫০ হাজার কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া by শরিফুল হাসান

বাংলাদেশ থেকে লাখ দুয়েক কর্মী নিতে চায় থাইল্যান্ড। এর মধ্যে এখনই ৫০ হাজার মৎস্যজীবী নিতে চায় দেশটি। কিন্তু সরকার ও জনশক্তি রপ্তানিকারকদের মধ্যে দ্বন্দ্বে তা হচ্ছে না।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) নেতাদের দাবি, থাইল্যান্ডের এই শ্রমবাজার খুঁজে বের করেন জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা। তাঁরা যখন দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় এই বাজার উন্মুক্ত করার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছেন, তখন সরকারিভাবে লোক পাঠানোর উদ্যোগ নেয় প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়।
আর প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দাবি, ভবিষ্যতে যেন এই বাজার টেকসই হয়, সে জন্যই নিয়মকানুন মেনে সামনে এগোতে চায় সরকার। জেলেরা কাজ করবেন নদী বা সমুদ্রে, সেখান তাঁদের নিরাপত্তা কী হবে, সে বিষয়টি সরকারকে ভাবতে হবেই। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, থাইল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাস ও বায়রা সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের জানুয়ারিতে বায়রার একটি প্রতিনিধিদল দেশটিতে গিয়ে সেখানকার শ্রমবাজারের বিষয়ে খোঁজখবর করে। ইতিবাচক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দেশে ফিরে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানান। প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী বায়রার নেতাদের ওই বাজারের ব্যাপারে অগ্রসর হতে বলেন। গত বছরের ১৯ জানুয়ারি প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ বিষয়ে বায়রাকে সহযোগিতার জন্য থাই শ্রমমন্ত্রীকে একটি চিঠিও লেখেন।
ওই চিঠি নিয়ে বায়রার চার সদস্যের প্রতিনিধিদল থাই শ্রমমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এরপর থাই মন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটি খসড়া সমঝোতা (এমওইউ) প্রস্তাব দেওয়ার পরামর্শ দেন। বায়রার নেতারা বিষয়টি সরকারকে জানালে মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল খসড়া প্রস্তাব নিয়ে থাইল্যান্ডে যায়। বায়রার নেতারাও কয়েক দফা দেশটিতে গিয়ে আলোচনা এগিয়ে রাখেন।
গত নভেম্বর মাসে অস্ট্রেলিয়া সফর শেষে দেশে ফেরার সময় প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী, সচিব ও জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক দেশটির বিমানবন্দরে কথা বলেন থাই প্রতিনিধিদলের সঙ্গে। ইতিমধ্যে মালয়েশিয়ার সঙ্গে সরকারিভাবে লোক পাঠানোর জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। ফলে মন্ত্রণালয় একই প্রক্রিয়ায় কর্মী পাঠানোর প্রস্তাব দেয় থাইল্যান্ডকে।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কাজী ইমতিয়াজ হুসেইন গত সেপ্টেম্বরে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে দেখা করেছেন। ওই সাক্ষাতের সূত্র ধরে থাইল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ঢাকায় একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়, থাই ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে চায়। থাই মন্ত্রিসভাও বাংলাদেশ থেকে ৫০ হাজার মৎস্যজীবী নেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। ভবিষ্যতে নির্মাণ খাতসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও শ্রমিক নিতে চায় দেশটি। তবে সরকারিভাবেই লোক নিতেন চায় থাইল্যান্ড। এ ক্ষেত্রে যেসব মৎস্যজীবী আসতে চান, তাঁদের প্রশিক্ষণ নিয়ে আসতে হবে। কারণ, কর্মীরা দক্ষতা দেখাতে না পারলে তাঁদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে। এ সময় জেলেদের নিরাপত্তা ও বেতন-ভাতার বিষয়টি উত্থাপন করে বাংলাদেশ। সব বিষয়ে দুই পক্ষের ইতিবাচক আলোচনা হলেও কবে নাগাদ থাই কর্তৃপক্ষ বিষয়টি চূড়ান্ত করবে, তা বলা হয়নি।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ গত ডিসেম্বর মাসে বিএমইটির অতিরিক্ত মহাপরিচালকের নেতৃত্বে সরকারি আরেকটি প্রতিনিধিদল যায় থাইল্যান্ডে। থাই কর্তৃপক্ষের আমন্ত্রণে বায়রার প্রতিনিধিদলও পৃথকভাবে একই সময়ে সেখানে যায়। কিন্তু বায়রার এ সফর নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে থাইল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাস। ফলে থাই কর্তৃপক্ষ সরকারি প্রতিনিধিদল এবং বায়রার প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করে। এতে সরকার ও বায়রার নেতাদের আলাদা অবস্থানের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় থাই সরকারের কাছে। ফলে লোক পাঠানোর প্রক্রিয়াটিই আটকে আছে।
বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘থাইল্যান্ডের শ্রমবাজারের বিষয়ে আমরাই প্রথমে খোঁজখবর করি। আমরা গত বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত চারবার দেশটির মন্ত্রী, সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাদের বলেছে, মৎস্য আহরণ, কৃষি ও নির্মাণ খাতে তারা দুই লাখ কর্মী নিতে চায়। ওই শ্রমবাজার চালুর বিষয়ে সরকার আমাদের শুরু থেকেই সহযোগিতা করে আসছিল। কিন্তু সবকিছু যখন চূড়ান্ত, তখন এ উদ্যোগ থেমে আছে।’
সরকারের সঙ্গে আপনাদের দূরত্বের কারণেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে কি না, জানতে চাইলে আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
তবে জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা দাবি করেছেন, সরকার যে খসড়া এমওইউ থাইল্যান্ডে পাঠিয়েছিল, তাতে সরকারি ও বেসরকারি—উভয়ভাবেই কর্মী পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু এখন সরকারিভাবেই লোক পাঠাতে চায় সরকার।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব জাফর আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অতীতে বিভিন্ন বাজারে প্রতারণাসহ যেসব অনিয়ম হয়েছে, আমরা চাই না সেগুলো আবার হোক। এ কারণেই আমরা ধীরে এগোচ্ছি, যাতে ভবিষ্যতে কোনো সংকট না হয়। আর গভীর সাগরে জেলেদের নিরাপত্তা কেমন হবে, অতীতে কী হয়েছে, সেসব বিষয়ে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মাধ্যমে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তবে আমরা থাইল্যান্ডের চূড়ান্ত প্রস্তাবের অপেক্ষা করছি। এর পরই সবকিছু ঠিক করা হবে।’
প্রসঙ্গত, মালয়েশিয়ায় সরকারিভাবে লোক পাঠানোর প্রক্রিয়া নিয়ে বিরোধিতার জের ধরে সরকার ও জনশক্তি রপ্তানিকারকদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অতিরিক্ত অর্থ আদায়, প্রতারণাসহ নানা অনিয়মের কারণেই কর্মীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সরকারিভাবে লোক পাঠানো হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.