গোয়েন্দাদের ধাঁধায় ফেলে গুপ্তচরবৃত্তি করে গেছে তুর্কী প্রতিনিধিরা- আগমনী ভিসা সমাচার by আজাদ সুলায়মান

হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে অন এরাইভাল ভিসা (আগমনী ভিসা) প্রদানের ক্ষেত্রে ন্যূনতম বিধিনিষেধ নেই। বিশ্বের যে কোন দেশের যে কোন নাগরিক ইচ্ছে করলেই স্থল ও বিমানবন্দরে এসে এ ভিসা নিতে পারে। এমনকি ইসরাইয়েলের যে কোন মুসলিমও আগমনী ভিসার সুযোগ পাচ্ছে। শুধু ইন্টারপোলের তালিকাভুক্ত অপরাধীদেরই এ ক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যান করা হয়।
ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে এত সহজ ও উদারনীতি দুনিয়ার অন্য কোন দেশে নেই বলেও মন্তব্য করেছেন একটি শীর্ষস্থানীয় গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। তাঁর দৃষ্টিতে বাংলাদেশ হচ্ছেÑআগমনী ভিসার চারণভূমি। আর এ সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করেছে গত মাসে তুরস্কের প্রতিনিধি দল। ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে তারা যে কা- ঘটিয়েছে সেটা শুধু কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূতই নয়Ñ রীতিমতো সরকার ও রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ এনে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ারও যথেষ্ট যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে। তবে এ জন্য দেশের শীর্ষস্থানীয় গোয়েন্দাদের মধ্যে সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাবকেও দায়ী করা হয়েছে। গোয়েন্দাদের গোলক ধাঁধায় ফেলে তুরস্কের প্রতিনিধিরা ঢাকায় ৪ দিনব্যাপী যে সব কীর্তিকলাপ করে গেছেÑ তা ছিল অবিশ্বাস্য।
তুরস্কের প্রতিনিধি কেলেঙ্কারি ঘটনা তদন্তে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এ ধরনের তথ্য উঠে এসেছে। এ ছাড়া এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও একটি তদন্ত প্রতিবেদনেও আগমনী ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে আরও কড়াকড়ি আরোপসহ বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে।
একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দার তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়Ñ তুরস্কের যে ১৪ জন ঢাকায় এসেছিলÑ তাদের ট্যুরিস্ট ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে যাচাইবাছাই করা হয়েছে সাদামাটা। তাদের বিরুদ্ধে আগের কোন অভিযোগ বা বিধিনিষেধ না থাকায় কোন প্রকার সন্দেহের উদ্রেক হয়নি। ঢাকার তুরস্ক দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি আদনানসহ ৪ কর্মকর্তা তাদের হজরত শাহ্ জালাল বিমানবন্দর থেকে ভিআইপি প্রটোকল দিয়ে বের করে নিয়ে যান।
সূত্রমতে, এ প্রতিনিধি দলের সদস্যদের ইমিগ্রেশনে জানতে চাওয়া হয়েছিল ঢাকায় তাঁরা কোথায় থাকবেন, কি করবেন। এতে তাঁরা উল্লেখ করেনÑ গুলশানের হোটেল ডি ক্যাসেলে থাকবেন। আর বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করবেন।
এরপর তারা প্রতিমূহূর্তে আপত্তিকর কর্মকা-ে লিপ্ত হয়েছেন। যেমনÑকাগজে-কলমে হোটেল ডি ক্যাসেল লেখা হলেও তাঁরা থেকেছেনÑ ইন হোটেলে। সেখানে তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করেছেন বিএনপি-জামায়াতের কয়েকজন বুদ্বিজীবী ও একজন আইনজীবী। তাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছেÑ আগের সপ্তাহে ঘটে যাওয়া স্কাইপে কেলেঙ্কারি সম্পর্কিত সংবাদপত্র। তাঁদের বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধী নিয়ে গোটা দেশ দু’ভাগে বিভক্ত। সরকার গায়ের জোরে এক তরফা একটা রায় লিখে ফেলেছে।
তারপর আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিনিধি দলের দৌড়ঝাঁপ দেখে সবার টনক নড়ে। এ অবস্থায় ঢাকা ত্যাগের আগে আরও একধাপ এগিয়ে গোপনে বৈঠক করে বনানীর হোটেল সেরেনাতেÑ যার মালিক বিএনপির প্রভাবশালী নেতা আমীর খসরু চৌধুরী।
গোয়েন্দা কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, ঢাকায় এ প্রতিনিধি দলের গতিবিধি নজরদারি করে গোয়েন্দাদের গোলকধাঁধায় ফেলা হয়েছে। একটি গোয়েন্দার পক্ষ থেকে প্রতিনিধি দলের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে কেন রাজনৈতিক কর্মকা- নিয়ে ব্যস্ত। এতে তাদের সাফ জবাব ছিল, দূতাবাসের কাছ থেকে যা জানার জেনে নিন। এতে গোয়েন্দারা ঢাকাস্থ তুরস্ক দূতাবাসে গেলে সেখান থেকেও পরামর্শ দেয়া হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে সব জানতে। কিন্তু গোয়েন্দারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে অধিকতর খবরদারি করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। এভাবেই দেশের বাঘা বাঘা গোয়েন্দাদের আহম্মক বানিয়ে প্রতিনিধি দল তাদের মিশন সফল করে ঢাকা ত্যাগ করে।
সূত্রমতে, তুরস্কের প্রতিনিধি দল ঢাকা ত্যাগের পর হুঁশ হয় সবার। এ ঘটনায় দেশের গোয়েন্দা বিভাগেরই দৈন্যদশা ফুটে ওঠে। তবে এ ঘটনার পর গোয়েন্দারা নতুন করে অন এরাইভাল ভিসা প্রদানে আরও সতর্ক ও কড়াকড়ি করার জোর সুপারিশ করে।
ইমিগ্রেশন সূত্রে জানা যায়, তুরস্ক নাগরিকদের আগমনী ভিসা প্রদান শুরু হয় ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। ভ্রাতৃপ্রতিম দু’ দেশের মধ্যে ব্যবসাবাণিজ্য ও বিনিয়োগের সম্প্রসারণ ঘটানোর লক্ষ্যেই ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে উদারনীতি গ্রহণ করে বাংলাদেশ। শুধু তুরস্ক নয়Ñ এ সুযোগ পাচ্ছে বিশ্বের সব দেশই। এমনকি ইসরাইয়েলও। ফিলিস্তিন, পশ্চিম তীর ও গাজার মুসলিমরা ঢাকায় বিশ্ব এজতেমায় আসে ইসরাইয়েলী পাসপোর্টে। তাদেরও হজরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আগমনী ভিসা দেয়া হয়। অবশ্য তাদের গতিবিধি সর্বক্ষণিক নজরদারি করা হয়।
পুলিশের হিসেব মতে দেখা যায়, গত এক বছরে তুরস্কের প্রায় ৫ শতাধিক নাগরিক আগমনী ভিসায় ঢাকায় আসে। তাদের মধ্যে এখনও দেশে রয়ে গেছে ১৮৯ জন। ঢাকায় তুরস্কের কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠানেই তারা কর্মরত।
আগমনী ভিসা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশসহ মোট ৪৯ দেশের নাগরিকদের সরকারী কাজ, ব্যবসা, বিনিয়োগ ও পর্যটনসহ ৪ ক্যাটাগরিতে আগমনী ভিসা প্রদান করা হচ্ছে। এসব ভিসার সর্বোচ্চ মেয়াদ হচ্ছে ৩০ দিন। উদারনীতি হলেও বেশ কিছু শর্তসাপেক্ষে এ ধরনের ভিসা দেয়া হয়। তবে ২০০৮ সালে বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিকদের বেলায় আগমনী ভিসা সহজ করা হলেও চারটি দেশের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়। এগুলো হচ্ছেÑ ইরাক, আফগানিস্তান, সুদান ও আলজিরিয়া। চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার স্বার্থে তাইওয়ানের নাগরিকদেরও আগমনী ভিসা প্রদানে যথেষ্ট যাচাইবাছাই করা হয়।
যোগাযোগ করা হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই ভিসামুক্ত পৃথিবী। চাই ভিসা পদ্ধতি উঠে যাক। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত ভিসা পদ্ধতি চালু রয়েছে ততদিন কিছু নিয়মকানুন ও আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনেই চলতে হচ্ছে। তুরস্ক যদি আমাদের অন এরাইভাল ভিসা দিতে পারে তাহলে আমরা কেন দিতে পারব না। পারস্পরিক সম্পর্ক ও সমঝোতার ভিত্তিতেই ভিসা আদান-প্রদান করা হচ্ছে। এ নিয়ে তেমন সমস্যা তো দেখছি না।

No comments

Powered by Blogger.