বদলে যাক দৃষ্টিভঙ্গি by সাবিনা ইয়াসমিন

বিশ্বব্যাপী যেমন নারীর ক্ষমতায়ন চলছে তেমনি নারী নির্যাতন ও নিপীড়নও বাড়ছে। নারীর অগ্রগতির প্রধান বাধা নারী নির্যাতন। নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতে চলন্ত বাসে নারকীয় গণধর্ষণের ঘটনা শুধু গোটা ভারতকেই নয়, সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু ক্ষোভ প্রকাশই নয়, ভারতে নারীর নিরাপত্তা নিয়েও এখন জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশেষ করে কর্মজীবী নারীরা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। বর্মস্থল এবং এমনকি রাস্তাঘাটে ও পরিবহনে চলাচলে নিজেদের সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ মনে করছে তারা। নারীর নিরাপত্তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। গত ১৬ ডিসেম্বর রাতে ভারতের রাজধানী দিল্লীতে এক মেডিক্যাল ছাত্রী চলন্ত বাসে গণধর্ষণের শিকার হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানোর ব্যবস্থা করে ভারত সরকার। কিন্তু অত্যন্ত দুভার্গ্যরে কথা। মৃত্যুর সাথে দীর্ঘ তেরো দিন লড়াই করে ২৯ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে এই তরুণী। ঘটনার দিন এই তরুণীর সাথে তার এক বন্ধু ছিল। ধর্ষক নরপশুরা পিটিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে তাকেও বাস থেকে ছুড়ে ফেলে। এই বর্বর ও পাশবিক ঘটনার নিন্দায় সারা ভারত উত্তাল হয়ে উঠেছে । ধর্ষকরূপী পশুদের বিচারের দাবিতে জনগণ আন্দোলন করে যাচ্ছে।
ভারতে ধর্ষণের ঘটনা বিরল নয়। বিশেষত ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতেও প্রায়ই ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। কিন্তু সম্প্রতি চলন্ত বাসে মেডিকেল ছাত্রীর গণধর্ষণের লজ্জাজনক এ ঘটনা নারীর বিরুদ্ধে যে কোন অপরাধ ঠেকাতে বিদ্যমান আইনের দুর্বলতাকেই যেন বার বার আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে।ভারতের রাজনীতি ও সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, ওই ছাত্রীর ওপর নির্যাতনের যে ঘটনা ঘটেছে তা দেশের একমাত্র ঘটনা নয়। বরং দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিন নারী নির্যাতনের এ রকম অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। রোজকার খবরের কাগজে চোখ বুলালেই নারী নির্যাতনের অনেক খবর পাওয়া যায়। গণধর্ষণও এখন দৈনন্দিন ঘটনায় দাঁড়িয়েছে। নারী নির্যাতনের একটি হিসাব থেকে দেখা যায়, ২০১১ সালে ভারতে ২৪ হাজার নারী নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ পায়। এ তথ্য থেকে আরও জানা যায় যে, আগের বছরের তুলনায় ধর্ষণ বেড়েছে। ৯.২ শতাংশ। আর নির্যাতিত নারীদের অর্ধেকের বেশির বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। ধর্ষণ মামলাগুলোর বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এ ধরনের ঘৃণ্য কাজকে আরও উৎসাহিত করছে বলে ভারতের অনেক আইজীবীর ধারণা। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীর ছয়টি জেলা আদালতে প্রায় এক হাজার ধর্ষণ মামলা বিচারাধীন অবস্থায় আছে। বিচার বিভাগের দীর্ঘসূত্রতার ফলে এ সকল মামলার রায় হতে বেশ সময় লেগে যায়। অকারণ মামলা স্থগিত, ধর্র্ষিত নারীদের আদালতে হেনস্থামূলক জেরা, সরকারী কৌঁসুলির নিষ্ক্রিয়তা, পুলিশের অসহযোগিতাসহ বিভিন্ন কারণে এসব মামলা অকারণে বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকে। ফলে ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীরা মামলা লড়ে যাওয়ার ইচ্ছা ও ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন এবং উপযুক্ত বিচার থেকেও বঞ্চিত হন। অপরাধীরা রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিশ্লেষকদের মতে, ধর্ষণসহ অন্য সকল ধরনের অপরাধ কমাতে এসব মামলা দ্রুতগতিতে নিষ্পত্তি করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।
গত সপ্তাহে দিল্লী হাইকোর্ট পাঁচটি ফাস্ট ট্র্যাক আদালতের অনুমোদন দিয়েছে। আইনজীবীরা মনে করেন, এসব আদালতে নারী নির্যাতন, অপহরণ শ্লীলতাহানিসহ বিভিন্ন ঘটনায় প্রতি বছর ২৫ লাখেরও বেশি মামলা দায়ের করা হয়। অধিকাংশেরও বেশি অভিযোগকারী বিচার পায় না। সার্বিকভাবে নারীর ওপর অত্যাচারের ঘটনা বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। জি-২০ এর দেশগুলোর মধ্যে নারীর জন্য সবচেয়ে অনিরাপদ দেশ হিসাবে দাবি করা হয়েছে ভারতকে।ভারতের ৪টি বড় শহরের মধ্যে ধর্ষণের শীর্ষে রয়েছে রাজধানী দিল্লী। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। যথাসময়ে বিচার না হওয়ার ফলে এ ধরনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। ভারতের অনেক অঞ্চলেই ধর্ষণের জন্য নারীকে প্রথমত দোষী বলে দায়ী করা হয়। তাই অনেক ক্ষেত্রেই ধর্ষণের শিকার নারীরা অপমান ও গ্লানির হাত থেকে বাঁচতে ধর্ষণের বিচারের দাবি করতে চান না।
২০১২ সালের জুন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ১ হাজার ৩৮২টি ধর্ষণের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে। তার আগের বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৩৬৩টি। এনসিআরবির পরিসংখ্যান নারী পাচার ও বধূ নির্যাতনের ঘটনাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নারী নির্যাতনের বিভিন্ন মামলায় পশ্চিমবঙ্গে ২০১১ সালে মাত্র ০.৩২ শতাংশ অভিযুক্তের সাজা প্রদান করা হয়েছে বলে এনসিআবির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। সম্প্রতি আরও একটি জরিপে বলা হয় যে, ভারতে প্রতি ২০ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিত হয়। ২০১১ সালের গোটা ভারতে ২৪ হাজার ধর্ষণের মামলা নথিভুক্ত হয়। শুধু দিল্লীতেই এ মামলা করা হয় ৫৭০টি। ২০১২ সালে দিল্লী শহরে ৬৩৫টি ধর্ষণের মামলা দায়ের হয়েছে। শুধু ধর্ষণ নয়, ধর্ষণ মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হলেই ধর্ষণ উল্লেখযোগ্য হারে কমবে। তিন মাসের মধ্যে ধর্ষিতার জবানবন্দী গ্রহণ করে দ্রুত গতিতে মামলার নিষ্পত্তি করে অভিযুক্তকে শাস্তি প্রদান করা হলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।নারী নির্যাতনের ঘটনায় ভারতে শীর্ষস্থানে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। এমনকি এ সকল ঘটনায় অভিযুক্তদের শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে এ রাজ্যের অবস্থান পনেরো নম্বরে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) ২০১১ সালের প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ পায়। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশ সূত্রমতে, ২০১২ সালের প্রথম ছয় মাসের যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনাই বেশি ঘটেছে বলা হয়।
এ তো গেল উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া দেশ ভারতের কথা। ২৯ নবেম্বর ২০১২, আমাদের দেশেই ঘটে আরেক মর্মান্তিক ঘটনা। রাজধানী ঢাকার দক্ষিণখানে ব্র্যাক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন ২৭ বছর বয়সী তরুণী ডা. সাজিয়া আরেফীন। ধর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়ে দুর্বৃত্তরা খুন করে ডা. সাজিয়াকে। ৩১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলে গণধর্ষণের শিকার হয় এক ছাত্রী ।দেশ জুড়ে এ রকম ঘটনা ঘটেছে হাজারো। স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নির্যাতিত হওয়া পথে ঘাটে কর্মস্থলে শিক্ষাকেন্দ্রে চলেছে ধর্ষণ, উত্ত্যক্তকরণ। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন পত্রপত্রিকা মারফত নারীর সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধির কথা জানা যায়। শুধু নিজ দেশ কিংবা প্রতিবেশী দেশেই নয়, নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে বিশ্বজুড়ে। একটি ঘটনার রেশ না কাটতেই ঘটছে আরেকটি ঘটনা। সংঘটিত এ সকল ঘটনার কয়টি বিচার হয়েছে তা বলা কঠিন।
আধুনিকতার হাত ধরে নারী এখন কর্মমুখী হচ্ছে। পরিবার ছাড়াও সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নিজেকে নিয়োজিত করছে। কর্মক্ষেত্রে পেশাগত দায়িত্ব পালনে নারীর সম্পৃক্ততা বাড়ছে। তাই কর্মজীবী নারীদের জন্য নিরাপত্তার বিষয়টিও আলোচনায় আসছে। শুধু কর্মক্ষেত্রেই নয়, রাস্তাঘাটে, পরিবহনে চলাচলের সময়ে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরী। এ দায়িত্ব শুধু দেশের সরকারের নয়। দেশের সকল নাগরিকের। তার জন্য আমদের পুরুষশাসিত সমাজের মানসিকতার প্রয়োজন সর্বাগ্রে। নারীকে অবদমিত করে রাখার হাজারো কৌশল আমাদের সমাজপতিদের জানা। নারীর মান সম্মানকে হেয় প্রতিপন্ন করে অজস্র উপায়ে অবমূল্যায়িত করে রাখছে। নারীকে পরিণত করেছে পণ্য সামগ্রীতে। পশ্চাৎমুখী পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবগুলোকে জিইয়ে রাখার প্রয়াসে এখনও তৎপর প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ধারক ও বাহকেরা।
ভারতের এক মেডিক্যাল ছাত্রীর মর্মান্তিক পরিণতির প্রতিবাদে ও বিচারের দাবি আজ বিশ্ববাসী সকলকে নাড়া দিয়েছে। এ ঘটনা আমাদের এ বার্তাই জানাচ্ছে যে, আধুনিকতার মোড়কে আবৃত এ সভ্যতায় নারীরা এখনও নিরাপদ নয়, এখনও নারীরা মূল্যায়িত হচ্ছে না মানুষ হিসেবে। নারীরা যতই শিক্ষিত কিংবা যতই প্রগতিশীল হোক না কেন নিপীড়ন, বৈষম্য আর লাঞ্ছনার শিকার হওয়াই যেন তাদের নিয়তি। নির্যাতিত হওয়াই যেন তাদের বিধিলিপি। দেশ কাল পাত্র ভেদে এর কোন সীমারেখা নেই। থাকলে হয়ত শুধুমাত্র শিক্ষার অধিকার চাওয়ার কারণে গুলিবিদ্ধ হতে হতো না মালালাকে। প্রাণ দিতে হতো না ভারতকন্যাকে। উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ডাকে নারীরা হচ্ছে বহির্মুখী ও কর্মমুখী। কিন্তু সমাজ যদি থাকে পশ্চাৎপদ, পুরুষরা যদি সহযোগী না হয়ে হয় নির্যাতক তবে ঘরে কিংবা ঘরের বাইরে কোথাও নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। দেশের অগ্রগতির বিষয়টির সাথে আজ নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িয়ে পড়েছে। নারীর নিরাপত্তা বিধানের জন্য আইন নয়, মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ বন্ধে ভারতীয়দের প্রতিবাদ বিশ্ববাসীর সকলের বিবেককে আজ জাগ্রত করেছে। শুধু ভারতীয়রাই নয়, নারী নির্যাতন বন্ধে প্রতিবাদী হোক বিশ্ব। নারীর প্রতি বদলে যাক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি।

No comments

Powered by Blogger.