ডিজেল কেরোসিনে ৭, পেট্রল অকটেনে ৫ টাকা দাম বাড়ল-বিএনপির হরতাল রবিবার!

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে এক নির্বাহী আদেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়। এ দফায় লিটারপ্রতি পেট্রল ও অকটেনে পাঁচ টাকা এবং ডিজেল ও কেরোসিনে লিটারে সাত টাকা করে দাম বাড়ানো হয়েছে।
নতুন দর অনুযায়ী ডিজেল ৬৮, কেরোসিন ৬৮, অকটেন ৯৯ এবং পেট্রল ৯৬ টাকায় বিক্রি হবে। তবে এ দফায় ফার্নেস অয়েলের দাম বাড়েনি। গতকাল রাত ১২টার পর থেকে এ দাম কার্যকর হয়েছে।
সর্বশেষ ২০১১ সালের ২৯ ডিসেম্বর সরকার এই চার ধরনের জ্বালানি তেলের দাম লিটারপ্রতি পাঁচ টাকা বাড়িয়েছিল। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে বর্তমান সরকারের আমলে এ নিয়ে পাঁচবার বাড়ল জ্বালানি তেলের দাম। দাম বাড়ার প্রতিবাদে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট ও বাম দলগুলো হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণার কথা জানার পরপরই গত রাতে জরুরি বৈঠক ডাকেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। রাত ১১টায় গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ডেকে পাঠানো হয় দলের সিনিয়র নেতাদের। বৈঠকে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আগামী রবিবার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কর্মসূচি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এ বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। বিএনপির একটি সূত্র জানায়, আজ শুক্রবার ১৮ দলের মহাসচিব পর্যায়ের বৈঠক শেষে হরতালের এ ঘোষণা দেওয়া হবে। বৈঠকে বিএনপি নেতাদের মধ্যে ছিলেন লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, এম কে আনোয়ার, ড. আবদুল মঈন খান, সাদেক হোসেন খোকা, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রমুখ।
এদিকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, আলোচনায় বসেই তাঁরা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবেন। একই কথা বলেন দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদও।
সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ালেই হরতাল দেওয়া হবে- এমন ঘোষণা বিএনপি চেয়ারপারসনের আগে থেকেই ছিল। গত ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর পাঁচটি স্পটে পথসভায় এই ঘোষণা দিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল যৌথভাবে কঠোর কর্মসূচি দিতে যাচ্ছে। তবে কঠোর কর্মসূচি হরতাল কি না সে ব্যাপারে গত রাতে এ দুটি দল কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। এ বিষয়ে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, সরকার জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কামান দাগাল। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ঠিক কী ধরনের কর্মসূচি দেওয়া হবে তা শিগগিরই জানানো হবে।'
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রতিবাদে সাতটি বামপন্থী দলের জোট গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা হরতালের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তবে হরতালের তারিখ এখনো ঘোষণা করেনি। এ বিষয়ে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সমন্বয়ক ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, 'আমরা হরতাল দেব। সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে শিগগিরই হরতালের তারিখ ঘোষণা করা হবে।'
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রবীণ এক বাম নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আগামী রবিবার আমরা হরতালের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু আমাদের কর্মসূচি দেওয়ার আগে যদি বিএনপি রবিবার হরতালের ঘোষণা দেয় তাহলে আমাদের বিকল্প ভাবতে হবে।'
মহাজোটের শরিক দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে কঠোর কর্মসূচি পালন করবে। তবে দলটি হরতাল করবে কি না সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত করে কিছুই বলেনি। এ ব্যাপারে ওয়ার্কার্স পার্টি পলিটব্যুরোর সদস্য বিমল বিশ্বাস কালের কণ্ঠকে বলেন, আগামী রবিবার একটা কর্মসূচি নেওয়া হবে। তবে কর্মসূচি হরতাল হবে কি না সে ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে পরে জানানো হবে বলেও তিনি জানান।
দাম বৃদ্ধির যুক্তি হিসেবে সরকারের দাবি, গত অর্থবছরে জ্বালানি তেলে সরকারকে লোকসান দিতে হয়েছে ৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ইতিমধ্যে এ লোকসান সাড়ে ১০ হাজার কোটি ছাড়িয়ে গেছে। জ্বালানি তেলের দাম না বাড়ালে এই লোকসান ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণেই দেশের বাজারে দাম বৃদ্ধি না করলে সরকারের পক্ষে ভর্তুকির বোঝা টানা সম্ভব নয়।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়েনি : আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম গত এক বছর স্থিতিশীল ছিল। গত এক বছরে বিপিসি জ্বালানি তেল কিনেছে কম দামে। শুল্ক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ওই বছরের ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকার অপরিশোধিত তেল গড়ে প্রতি লিটার ২৪ টাকা দরে কিনেছে। এর মধ্যে লিটারপ্রতি ৯ টাকা দরও রয়েছে।
চাপে পড়বে অর্থনীতি : এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় চাপে পড়বে দেশের অর্থনীতি। তাঁদের মত, দেশীয় জ্বালানি গ্যাস ও কয়লার দিকে নজর না দেওয়ায় আমদানিনির্ভর জ্বালানির ওপর ঝুঁকে পড়ার কারণে বারবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে হচ্ছে সরকারকে। ফলে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের আয় সংকুচিত হচ্ছে। সরকার এমন মুহূর্তে জ্বালানি তেলের দাম বাড়াচ্ছে, যখন আন্তর্জাতিক বাজারে গত এক বছরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়েনি। তাঁরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকার আইনও মানছে না। আইন ভেঙে নির্বাহী আদেশে একের পর এক জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এ কারণে প্রশ্ন উঠেছে এ খাতের মূল্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) ভূমিকা নিয়ে। এ পর্যন্ত নির্বাহী আদেশেই জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। আর এসব আদেশ দেওয়া হচ্ছে মধ্যরাতে। ভর্তুকি কমিয়ে আনতে সরকার এর আগে ২০১১ সালে চারবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে।
চাপে পড়বে সাধারণ মানুষ : বর্তমান সরকারের আমলে আরেক দফা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে এরই মধ্যে চড়ে থাকা বাজার আরো টালমাটাল হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে পণ্যের উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বাড়বে। কৃষি উৎপাদনের ব্যয় বাড়বে। দেশের সামগ্রিক উৎপাদনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ালে কৃষকের ভর্তুকির বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। তবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, যা খুচরা বিদ্যুৎ বিক্রির সঙ্গে সমন্বয় করতে গিয়ে আবারও বাড়াতে হবে বিদ্যুতের দাম। এ ছাড়া গণপরিবহনের ভাড়াও বাড়বে, যার প্রত্যক্ষ চাপ পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর।
বেশি ক্ষতি হবে কৃষির : বিপিসি সূত্রে জানা যায়, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে কৃষি খাত। কৃষি খাতে মোট জ্বালানির ২০.৬১ শতাংশ ব্যবহার করা হয়। পরিবহনের পরে এটাই এককভাবে সব থেকে জ্বালানি ব্যবহারের বড় খাত। বিপিসির দেওয়া তথ্য মতে, প্রতি লিটারে ডিজেলের দাম পাঁচ টাকা বাড়লে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে ৩৫০ কোটি টাকা। বিদ্যুৎবিহীন অঞ্চলে কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় জনগণকে বাড়তি গুনতে হবে অন্তত ৩১৬ কোটি টাকা।
বিপিসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, বিদ্যুৎ সংকট সমাধান করতে বেশি মাত্রায় তাড়াহুড়া করেছে সরকার। বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে গিয়ে দেশের অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এক বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা বেড়েছে ২৭ শতাংশের বেশি।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ভর্তুকি তুলে দিয়ে লোকসান কমানোর একটা চেষ্টা বেশ কিছু বছর ধরেই করা হচ্ছে। এবার কৃষিতে উৎপাদন খরচের বিপরীতে যে মূল্য কৃষক পেয়েছে, তাতে সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ অবস্থায় আবার ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি করে সরকার কৃষককে বিপদেই ফেলে দিয়েছে।' তিনি আরো বলেন, সরকারকে কৃষকের ভর্তুকি নিশ্চিত করতে হবে। কৃষককে যে প্রণোদনা দেওয়া হয়, সেখানে আরো বেশি প্রণোদনা দিতে হবে। তা না হলে কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ফলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে সরকারকে।

No comments

Powered by Blogger.