মধুপুরে ধর্ষিত স্কুলছাত্রীর চিকিৎসায় ৭ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড- জড়িতদের শাস্তি দাবিতে বিভিন্ন সংগঠনের মানববন্ধন ॥ চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে চাইছে বিএনপি

টাঙ্গাইলের মধুপুরে ধর্ষিত স্কুলছাত্রীকে সরকারের সব ধরনের সহযোগিতা দেয়ার ঘোষণার পর পরই ধর্ষিতার চিকিৎসায় ৭ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিএনপিও ধর্ষিতাকে সব ধরনের সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছে। এদিকে ধর্ষকদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সংগঠন মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করেছে।
গত ৭ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর থানাধীন আউশনারা ইউনিয়নের এক বাড়িতে গণধর্ষণের শিকার হয় ওই স্কুলছাত্রী। বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার কথা বলে এক বান্ধবীর হাতে ওই স্কুলছাত্রীকে ওই বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই বাড়িতে এক যুবদল নেতার সহযোগিতায় কয়েকজন মিলে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। প্রায় ৩ দিন আটকে রেখে তাকে ধর্ষণ করা হয়। অসুস্থ হয়ে পড়লে কিশোরীকে মধুপুরের রসুলপুর এলাকায় ফেলে দেয় ধর্ষকরা।
স্থানীয়দের সহায়তায় ১০ ডিসেম্বর কিশোরীকে উদ্ধার করা হয়। ওইদিন ভোরে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৫ জনকে গ্রেফতার করে টাঙ্গাইল ডিবি পুলিশ। ২ দিন মধুপুরে কিশোরীর চিকিৎসা হয়। এরপর ১২ ডিসেম্বর তাকে টাঙ্গাইল সদর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে পরে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে ঢামেক হাসপাতালে ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে চিকিৎসাধীন রয়েছে কিশোরী। এ ব্যাপারে কিশোরীর ভাই বাদী হয়ে মধুপুর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে একটি মামলা দায়ের করেছেন। ঘটনার পর পরই ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় ৫ জনকে।
এদিকে এ ঘটনায় সারাদেশে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সরকার ধর্ষিতাকে সব ধরনের সহযোগিতা করার ঘোষণা দেয়। সরকারের এ ঘোষণার পর বৃহস্পতিবার ধর্ষিতার চিকিৎসা তদারকের জন্য ৭ সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে ঢামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। মেডিক্যাল কলেজের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমানের নির্দেশে বোর্ড গঠিত হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ও নিউরো মেডিসিন বিভাগের প্রধান কাজী দ্বীন মোহাম্মদকে প্রধান করে গঠিত এই কমিটির সদস্যরা মেয়েটির চিকিৎসার দেখভাল করছেন। ইতোমধ্যেই বোর্ড ধর্ষিতার সহযোগিতায় সব ধরনের সহযোগিতা শুরু করেছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ডিএমসির ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) কো-অর্ডিনেটর বিলকিস বেগম। হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের প্রধান ডা. আব্দুল্লাহ-আল মামুনকে সদস্য করা হয়েছে বোর্ডের।
মেডিক্যাল বোর্ডের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, মেয়েটির অবস্থা খানিকটা উন্নতির দিকে। সে আগের মতো আতঙ্কে ছটফট করছে না। এদিকে ধর্ষকদের বিচারের দাবিতে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। বৃহস্পতিবারও বেশ কিছু সংগঠন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করেছে।
নিজস্ব সংবাদদাতা টাঙ্গাইল থেকে মধুপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মজিবর রহমানের বরাত দিয়ে জানান, ধর্ষক হোতা মনিরুজ্জামান মনি। সে মধুপুর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার মেয়র সরকার শহিদের চাচাত ভাইয়ের ছেলে। তার পিতার নাম হাজী ওমেদ আলী সরকার। তার বাড়ি মধুপুর উপজেলার বোয়ালী মধ্যপাড়া। সে মধুপুর উপজেলা যুবদলের ৩ নম্বর যুগ্ম সম্পাদক। রাজনীতির পাশাপাশি মধুপুর পৌর শহরে তার সুপ্তি নামে কম্পিউটারের দোকান রয়েছে।
শাজাহান আলীর পিতার নাম আয়েজ উদ্দিন। তার বাড়ি মধুপুর উপজেলার জঠাবাড়ী পশ্চিমপাড়া গ্রামে। সে পেশায় দলিল লেখক। সুপ্ত কম্পিউটারে নিয়মিত সে দলিল লেখার কাজ করাত। সেখান থেকেই তাদের পরিচয়। এসএম নুরুজ্জামান ওরফে গেদার পিতার নাম আব্দুল আজিজ। তার বাড়ি আউশনারা বোকারবাইদ গ্রামে। সে মনির কম্পিউটারের দোকানে কাজ করত। তার সঙ্গেই বীথির পরিচয়ের সূত্র ধরে বীথি স্কুলছাত্রীটিকে মনির কম্পিউটারের দোকানে নিয়ে যায়। হারুনের গ্রামের বাড়ি কুটিবাড়ী। তার পিতার নাম মজিবুর রহমান। নাটকে অভিনয়ের সূত্র ধরে বিথীর সঙ্গে হারুণের পরিচয়। ধর্ষণে সহায়তাকারী স্কুলছাত্রীর বান্ধবী বীথি আক্তার ইভা ওরফে সাথী। সে কালিহাতী উপজেলার মহেলা গুচ্ছগ্রামের আব্দুর রশিদের মেয়ে। মিউজিক ভিডিও, ড্যান্স ও বিভিন্ন নাটকে সে অভিনয় করে। মধুপুরে একটি চক্র ড্যান্স, নাটক, মিউজিক ভিডিও তৈরি করে ডিশ লাইনের মাধ্যমে এসব প্রচার করে। এসব নাটকে নায়িকা চরিত্রে বীথি ও নায়ক চরিত্রে এসএম নুরুজ্জামান অভিনয় করত। এরা গ্রামের অসহায় নিরীহ মেয়েদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নাটকে অভিনয় করাত। এরপর যৌন নির্যাতন চালাত তাদের ওপর। যৌন নির্যাতনের চিত্র ভিডিও করে রাখা হতো যুবদল নেতা মনির মালিকানাধীন সুপ্ত কম্পিউটারে। ইতোমধ্যেই সুপ্ত কম্পিউটার থেকে অশ্লীল ভিডিও ও বেশ কয়েকটি সিডি, দুটি কম্পিউটার ও দুটি ক্যামেরা উদ্ধার করা হয়েছে।
এদিকে স্কুলছাত্রী গণধর্ষণের ঘটনায় ফুঁসে উঠেছে জেলার স্কুল, কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মানবাধিকার ও সচেতন নাগরিক কমিটির সংগঠন। ন্যক্কারজনক এ গণধর্ষণের প্রতিবাদ এবং এর সঙ্গে জড়িতদের ফাঁসির দাবিতে সংগঠনগুলো মানববন্ধন ও প্রতিবাদসভা কর্মসূচী পালন করেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে স্থানীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে ঘণ্টাব্যাপী তারা এ কর্মসূচী পালন করে। স্বতঃস্ফূর্ত এ মানববন্ধনে সরকারী কুমুদিনী কলেজ, বিন্দুবাসিনী সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, বিভিন্ন এনজিও, মানবাধিকার কর্মী, নারী সংগঠন, সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ইয়ুথ এন্ডিং হাঙ্গার টাঙ্গাইল জেলা শাখা অংশ নেয়।
মানববন্ধন কর্মসূচী থেকে ধর্ষকসহ এর সঙ্গে জড়িতদের ফাঁসি, নারীদের নিরাপত্তা ও ধর্ষিতা এবং তার পরিবারের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি করা হয়েছে। ঘটনাস্থল মধুপুর উপজেলায় সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের মাঝে কালো ব্যাজ ধারণ কর্মসূচী পালন শুরু হয়েছে। টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক আনিছুর রহমান মিঞা কিশোরীর চিকিৎসার জন্য তার ভাইয়ের হাতে ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন।
এদিকে আলোচিত কিশোরীর চিকিৎসার ব্যয় বহন করার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় চীফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে এ ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, স্কুলছাত্রীর সব চিকিৎসা ব্যয় বিএনপি বহন করবে। প্রয়োজনে কিশোরীকে বিদেশে চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থা করা হবে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নারী নেত্রীদের প্রতিও আহ্বান জানান বিরোধীদলীয় চীফ হুইপ।

No comments

Powered by Blogger.