২০১২ সাল অর্থনৈতিকভাবে কেমন গেল? by ড. আর এম দেবনাথ

২০১২ সাল কেটে গেল। আজ নতুন বছরের চার তারিখ। কেমন যাবে নতুন বছর এই প্রশ্ন সবার মনে। রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখে অনেকেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে শঙ্কিত। প-িতরা এবং ‘চিন্তার পুকুররা’ (থিঙ্ক ট্যাঙ্ক) কত কী যে বলছেন।
এখন যা বলছেন ২০১১ সালেও মোটামুটি তারা এ ধরনের কথাই, আশঙ্কাই প্রকাশ করতেন। দেখা যায় তারা সব সময়ই নেতিবাচক কথায় গুরুত্ব দেন বেশি। এটা কেন হয় বুঝি না। এই যেমন তারা বলেছিলেন, ২০১২ সালের শেষে এক ডলারের দাম হবে ১০০ টাকা। এখন যখন ডলারের দাম বাংলা টাকার বিপরীতে আড়াই শতাংশের বেশি কমেছে তখন শুরু হয়েছে ভিন্ন কথা। ‘রেমিটেন্স’ কমে যাবে, হুন্ডি বাড়বে ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন ৮০ টাকায় এক ডলার পাওয়া যায়। এই রকম কত কথা ‘চিন্তার পুকুররা’ বলেন। যেমন তারা এদ্দিন বলতেন, ‘অবকাঠামোই’ হচ্ছে সবচেয়ে বড় অসুবিধা উন্নয়নের ক্ষেত্রে। এখন এরা বলেন, ‘জমিই’ হচ্ছে প্রধানতম অন্তরায়। তারা সব সময়ই বলেন, মানুষের অবস্থা ভাল নয়। আমেরিকানরা যখন যা বলে তারা তখন তা শিরোধার্য মনে করে। মজেনা যা বলেন তাকে তারা বেদবাক্য মনে করে। গ্রামীণ ব্যাংক সম্বন্ধে যা বলে তাকে তারা ‘পুরাণবাক্য’ মনে করে। তাহলে ‘পুকুরদের’ জিজ্ঞাসা করি ‘গ্যালাপের’ জরিপ বলছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা ভালÑ এখন কী বলবেন। ‘গ্যালাপ’ বাংলাদেশী কোন সংগঠন নয়। এটি খাস ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান যারা বিশ্বব্যাপী ৭৫ বছর ধরে জরিপের কাজ করছে। তারা ২০১১ সালের মে মাসে ১৫ দিনব্যাপী একটি জরিপ করে। তারা মানুষকে অনেক প্রশ্ন করে। অধিকাংশ মানুষ বলেছেন, তারা ভাল আছেন। ৩৮ শতাংশের মতে, তারা মোটামুটি ভাল, ৩৭ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তারা অর্থনৈতিকভাবে ভাল আছেন। এসব কথা আমার মতো এতিপেতি লোকের নয়। আমার প্রশ্ন : মার্কিনীদের উগ্র বন্ধু, সরকারের উগ্র সমালোচকরা এখন কী বলবেন? তারা কী বলবেন, না মানুষ ভালো নেই। না, মানুষ কষ্টে আছেন? মানুষ অশান্তিতে আছেন?
আসলে মার্কিনীদের গবেষণা প্রতিষ্ঠান লাগে না। চোখে ‘ঠুলি’ না পরে দেখলে বাস্তব অবস্থা বোঝা যায়। এটা তো জলের মতো পরিষ্কার ২০১২ সালজুড়ে চালের দাম ছিল স্থিতিশীল। ‘ওএমএস’-এর প্রয়োজনীয়তা ছিল না। সরকারের গুদামে ১৫-১৬ লাখ টন চাল। সাধারণ মানুষের চালের কষ্ট, ভাতের কষ্ট ছিল না। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল যা বরাবর দারিদ্র্যপীড়িত সেসব অঞ্চলের লোকদের চালের কষ্ট ছিল না। অবশ্য শুধু ২০১২ সালের কথা বলি কেন? ২০১০ সাল থেকেই এই অবস্থা। ধানের উৎপাদন, ফলন আশাতীত। সরকারের ভর্তুকি নীতি এই ক্ষেত্রে দারুণ ফল দিয়েছে। চালে এখন আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ, অবশ্যই তা মোটা চালে। চিকন চাল, ময়দা ও আটায় আমাদের কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। চালে নেই। এ সাদামাটা সত্যটি স্বীকার করতে কার্পণ্য কেন হবে? সবচেয়ে বড় কথা এটাই আসল কথা। ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, মধ্যবিত্ত, চাকরিজীবীদের বিবেচ্য বিষয় ভিন্ন। দেশের শতকরা ৩০ শতাংশ মানুষ যারা চাল কিনে খায় তাদের কোন চালের কষ্ট ছিল না। তবে হ্যাঁ, আমাদের এখন সমস্যা পুষ্টির- মাছ, মাংস, দুধ ও তরিতরকারির। আমি জোর তাগিদ দেব এ ব্যাপারে অধিকতর নজর দিতে। বস্তুত এখন দরকার মাছ, মাংস, দুধ, তরিতরকারি ও ফলমূলের বাজেট। তবে ধানের মূল্যের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনার দরকার আছে। এখন দেখা যায় কৃষকরা ধানের দাম না পেলে অন্য ফসলে চলে যায়। আগে এসব বিকল্প ছিল না। কৃষকরা এখন এক ফসল থেকে অন্য ফসলে যাচ্ছে। এটা মনে হয় মন্দ নয়। এভাবেও যদি কৃষক তার লোকসান পুষিয়ে নিতে পারে তাহলে ক্ষতি কী?
২০১২ সাল কী শুধু ভাতের প্রাপ্যতার দিক থেকেই ভাল ছিল? না তা নয়। মূল্যস্ফীতি বেশ কিছুটা হ্রাস পেয়ে এক অঙ্কে নেমেছে এটাও এই সালের বড় খবর। তা প্রধানত ঘটেছে অনেকগুলো কারণে। ডলারের দাম হ্রাস, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ নিয়ন্ত্রণ, খাদ্যমূল্য হ্রাস ইত্যাদি কারণে মূল্যস্ফীতি ছিল নিম্নমুখী। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে ‘মিডিয়া’ এই বিষয়টা আমলেই নেয়নি। মিডিয়ার খবরে ছিল : ডেসটিনি, ‘এমএলএম’ কোম্পানি, হলকার্ম, পদ্মা সেতু আর দু’একজন মন্ত্রীর দুর্নীতি। এসব খবর বস্তুত অন্য সব খবরকে আড়াল করে দেয়। এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয় তাতে মনে হয়, যেন বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত সেই। ‘হলমার্ক’ ঘটনা এমনভাবে প্রচারিত হয় যে মনে হয়, ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি ছাড়া কিছু নেই। অথচ ‘মিডিয়া’ বিবেচনাতেই নিল না যে, ব্যাংকিং খাত তারল্য সঙ্কট থেকে অনেকটা মুক্ত হয়েছে। ২০১২ সালের প্রথম দিকে ভীষণ তারল্য সঙ্কট ছিল। ২০১২ সালের শেষে সকল ব্যাংকে বেশ কিছুটা স্বস্তি নেমে আসে। আমানতের সঙ্কট কিছুটা কাটে। ডলারের সঙ্কট তিরোহিত হয়। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল ২০১২ সালের শেষে। রেমিটেন্স আশানুরূপ বৃদ্ধি পায়। আমদানির পরিমাণ আগের গতিতে বাড়েনি। রফতানির প্রবৃদ্ধি মোটামুটি সন্তোষজনক। বড় বড় ঋণপত্র খোলার ঘটনা কম হওয়ায় ডলারের ওপর চাপ হ্রাস পায়। এসব কারণে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বেড়েছে। আশাপ্রদভাবে যদিও এটা অবিমিশ্র আশীর্বাদ নয়। কারণ অতিরিক্ত রিজার্ভে লুক্কায়িত থাকে মূল্যস্ফীতির উপাদান। রিজার্ভের একটা উপাদান রেমিটেন্স। রেমিটেন্স মানেই গ্রামের মানুষের টাকা। যারা বিদেশে গেছে তারা টাকা পাঠায় বাপ-মায়ের কাছে। এই টাকার বেশিরভাগ যায় বাজারে যা মূল্যস্ফীতির বীজ বহন করে চাহিদা হিসাবে।
বিদ্যুতের অবস্থা ভাল ছিল। তিন বছর আগে বিদ্যুত নিয়ে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তাতে সব কিছু ‘কলাপস’ হওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়। কিন্তু সরকারের কুইক রেন্টালের ব্যবস্থার ফলে বিদ্যুতের অবস্থার উন্নতি হয়। এখন লোডশেডিং সর্বনিম্ন পর্যায়ে। বিদ্যুত কাজ করে কৃষিতে। কৃষিতে পর্যাপ্ত বিদ্যুত দেয়ার ফলে ফলন হয় ভাল। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সমস্যা হয়েছে মূল্য। বিদ্যুতের মূল্য বাড়ছে। এটা শাখের করাত। বিদ্যুত ব্যয়বহুল হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। কারণ তা না হলে বাড়াতে হয় ভর্তুকি। অধিকতর ভর্তুকির ভার বহন করার ক্ষমতা অর্থনীতির নেই। অতএব বিদ্যুত হতে হবে ব্যয়বহুল। কিন্তু এর কুফল বাড়বে সর্বত্র। মধ্যবিত্তের বোঝার কথা বাদই দিলাম। বিদ্যুতের মূল্য বাড়লে বস্তুত অর্থনীতির পুরোটাই হবে ক্ষতিগ্রস্ত। শিল্পের খরচ বাড়বে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এটাই পরিস্থিতি যতক্ষণ পর্যন্ত না বিদ্যুতের ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদী হয়। মনে হয় সরকার এ ব্যাপারে ভাবছে। দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা ছাড়া ত্বরিত বিদ্যুত ব্যবস্থা কোন কাজে আসবে না। অর্থনীতিতে ২০১২ সালব্যাপী আরেকটি সমস্যা ছিল গ্যাসের। গ্যাসের নতুন সংযোগ নেই। বস্তুত বিদ্যুত ও গ্যাসের নতুন সংযোগের অভাবে রিয়েল এস্টেটের বাজার যাচ্ছে মন্দা। হাজার হাজার ফ্ল্যাট হয়ে রয়েছে অবিক্রীত। রিয়েল এস্টেটের সঙ্গে দৈনন্দিন মজুরদের সম্পর্ক রয়েছে, কাঠমিস্ত্রি, ওস্তাগার থেকে শুরু করে শত ধরনের শিল্পের সম্পর্ক রয়েছে। বস্তুত রিয়েল এস্টেট অর্থনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এখন তা মুখ থুবড়ে পড়েছে।
২০১২ সালে আরেকটি খাত ছিল আশঙ্কাজনক। আর সেটি হচ্ছে শেয়ারবাজার। ২০১২ সালে ঢাকা শেয়ারবাজারের সূচক কার্যত ১০০০ পয়েন্ট হ্রাস পেয়েছে। এদিকে এ বাজারে নতুন শেয়ার এসেছে মাত্র ১৪টি। এর মধ্যে চারটি মিউচ্যুয়াল ফান্ড, ১০টি কোম্পনির শেয়ার। এরা সব মিলে বাজার থেকে মাত্র ২০০০ কোটি টাকা তুলেছে। এই ছিল সংক্ষেপে বাজারের অবস্থা। পুরো ২০১২ সালে শেয়ারবাজারে কোন নতুন তারল্য সরবরাহ ছিল না। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাজারে ছিল না, বড় বড় বিনিয়োগকারীরা ছিল না, বিদেশী বিনিয়োগও ছিল না। একটা হতাশাজনক অবস্থা বিরাজ করে শেয়ারবাজারে। শেয়ারবাজার ছাড়া আরেকটা মাধ্যম ছিল সঞ্চয়পত্র। সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে মানুষের কাছ থেকে ঋণ নেয়। এটা দীর্ঘকাল ধরে ছিল একটা নির্ভরযোগ্য ঋণ মাধ্যম। কিন্তু সরকারের নানাবিধ সঞ্চয়বিরোধী পদক্ষেপের ফলে বাজারটি নষ্ট হয়েছে। ২০১২ সালে মানুষ সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেছে বেশি, ক্রয় করেছে কম। এর একটা কারণ অবশ্য মানুষের সঞ্চয়ের অবস্থা। মানুষের সঞ্চয় আগের মতো বাড়ছে না। আয় যে হারে বাড়ছে তার চেয়ে বেশি হারে বাড়ছে খরচ। এক কারণে ব্যাংক আমানত ও সঞ্চয়পত্র বিক্রি বৃদ্ধির হার আগের তুলনায় কম।
সার্বিকভাবে বিচার করলে বলা যায়, ২০১২ সালটি ছিল একটা মিশ্র বছর। সাধারণ মানুষের খেয়ে পরে ছিল এ কথা সত্যি। রফতানি বাড়ছে, রেমিটেন্স বাড়ছে, আমদানি কম হারে হলেও বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে। এসেছে দুই অঙ্ক থেকে এক অঙ্কে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বেশ বেড়েছে। বৈদেশিক বিনিয়োগও কিছুটা বেড়েছে। এসব বিচারে ২০১২ সাল ছিল ভাল। খুব ভাল বলা যাবে না। বলা যাবে না আমরা টার্গেট অনুযায়ী ২০১২-১৩ অর্থবছরে ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধি ঘটাতে পারব। ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার ছয় শতাংশের কাছাকাছি হতে পারে। দৃশ্যত খারাপ পারফরম্যান্স। কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলোর যে অবস্থা তাতে ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও তাকে বলতে হবে ভাল পারফরম্যান্স। পশ্চিমা দেশে মন্দা চলছে। সেখানে মন্দার কোন কমতি নেই। চীনের অর্থনীতি, জাপানের অর্থনীতি, ভিয়েতনামের অর্থনীতির অবস্থা ভাল নয়। ভাল নয় ভারতের অর্থনীতির অবস্থা। তাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছয় শতাংশের কম হবে বলে প্রাক্কলন করা হচ্ছে। এমতাবস্থায় আমাদের অবস্থা তো ভালই বলতে হয়। ২০১২ সালের পারফরম্যান্স যদি অব্যাহত থাকে তাহলে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ছয় শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি ঘটানো অসম্ভব নয়। আমি নিরাশার কোন কারণ দেখছি না।

লেখক : সাবেক অধ্যাপক বিআইএম

No comments

Powered by Blogger.