পৃথিবী আগে যে অবস্থায় ছিল

আজ থেকে ২৫ কোটি বছর আগে প্রাক-ডাইনোসর যুগে পৃথিবীর বুকে যত রকমের প্রাণী ছিল তার প্রায় সবই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন যে প্রাণীদের এই গণবিলুপ্তি পৃথিবীর ইতিহাসে একাধিকবার ঘটেছে এবং প্রতিবার সেই বিলুপ্তির পর পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে “মৃত অঞ্চল” যেখানে হাজার হাজার বছর ধরে আর কোন প্রাণীকে দেখা যায়নি।
কিন্তু আলোচ্য ক্ষেত্রে অর্থাৎ ২৫ কোটি বছর আগে গণবিলুপ্তির পর যে মৃত অঞ্চল তৈরি হয়েছিল সেটির স্থায়িত্ব ছিল আশ্চর্যরকমের দীর্ঘ। ৫০ লক্ষ বছর টিকে ছিল সেটা। ওটা ছিল আদি ট্রিয়াসিক যুগ। মৃত অঞ্চলটা এত দীর্ঘকাল স্থায়ী হবার কারণ সে সময় তাপমাত্রা ছিল এত প্রচ- যে, কোন কিছুর বেঁচে থাকা অসম্ভব ছিল।
ব্রিটেন, চীন ও জার্মানির বিজ্ঞানীদের এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায় যে, প্রাণীদের গণবিলুপ্তি এবং দীর্ঘকাল ধরে নতুন আর কোন প্রাণীর আবির্ভাব না ঘটার কারণ বিষুব অঞ্চলে তাপমাত্রার মারাত্মক আকারে বৃদ্ধি। স্থলভাগের তাপমাত্রা তখন ছিল প্রায় ৫০ থেকে ৬০ ডিগ্রী। আর সাগর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। গবেষকদের অন্যতম চীনের ইয়াদং সান এক নিবন্ধে বলেছেন, “পারমিয়ান যুগের শেষ দিকে প্রাণীদের গণবিলুপ্তির সঙ্গে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সুদীর্ঘ সম্পর্ক আছে। তবে এই গবেষণাতেই প্রথম দেখানো হয়েছে যে, অত্যধিক তাপমাত্রার কারণেই বিষুবীয় অঞ্চলে প্রাণের পুনরাবির্ভাব ঘটতে লক্ষ লক্ষ বছর, সময় লেগে গিয়েছিল। পারমিয়ান যুগে পৃথিবীর স্থলভাগ আজকের মতো পাঁচটি মহাদেশে বিভক্ত ছিল না। পুরো স্থলভাগই ছিল এক এবং অখ-। এর নাম ছিল প্যানজিয়া। তেমনি জলভাগ ছিল এক ও অখ- প্যানথালাসা। ব্যাপক অঞ্চলজুড়ে বিরাজমান বনভূমি তখন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। মহাদেশের ভিতরভাগে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সৃষ্টি হয়েছিল ঊষর মরুভূমি। বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের পূর্বপুরুষ, কচ্ছপ, লেপিডেসের ও আর্কাসরদের মধ্যে সরীসৃপ প্রাণীগুলো শুষ্ক পরিবেশে ভালভাবে খাপ-খাইয়ে নিতে পেরেছিল। উভচরদের পূর্বপুরুষদের জায়গায় তখন এদেরই আধিপত্য দেখা দেয়। এই পারমিয়ান যুগের শেষদিকে প্রায় ৯০ শতাংশ সামুদ্রিক প্রাণী ৭০ শতাংশ স্থলজ প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটে তাপমাত্রার প্রচ-তার কারণে।
গবেষণায় এই প্রথম দেখা যায় যে, সমুদ্রের
পৃষ্ঠদেশের কাছাকাছি জলরাশির তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল। এমন তাপমাত্রায় সামুদ্রিক প্রাণী মারা যায় এবং ফটোসিনথেসিস বা
আলোকসংশ্লেষণ বন্ধ হয়ে পড়ে। এর আগ পর্যন্ত জলবায়ু বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, সাগর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি হতে পারে না।
যাই হোক, প্রাণীদের গণবিলুপ্তির পর আবির্ভূত মৃত অঞ্চলটি ছিল এক আশ্চর্য অঞ্চল। বিষুবীয় অঞ্চল ছিল অতিমাত্রায় আর্দ্র অথচ সেখানে প্রায় কোন কিছুই জন্মাত না। বনভূমি না, গাছপালা না। শুধু লতাগুল্ম ও ফার্ন জন্মাত। বিষুব অঞ্চলে কোন মাছ বা সামুদ্রিক সরীসৃপের দেখা পাওয়া যায়নি। শুধু শেলফিশের অস্তিত্ব ছিল। আর স্থলভাগে কোন প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল না। কারণ বিপাকক্রিয়ার অত্যধিক হারের কারণে চরম উষ্ণতার সঙ্গে মানিয়ে নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। শুধুমাত্র মেরু অঞ্চলেই এই প্রচ- তাপ থেকে বাঁচবার মতো আশ্রয় পাওয়া যেত।
পারমিয়ান যুগের শেষদিকে প্রাণীদের এই গণবিলুপ্তির আগে পৃথিবীটা নানা ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণীতে পরিপূর্ণ ছিল। ছিল আদি সরীসৃপ ও উভয়চর। নানা ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী যার মধ্যে কোরাল ও সামুদ্রিক লিলিও ছিল।
কিন্তু কেন এই অবস্থার এমন ভয়াবহ পরিবর্তন হলো? সেটার জন্য দায়ী বিশ্ব কার্বন চক্র। সাধারণ অবস্থায় উদ্ভিদ কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে এবং একে মৃত উদ্ভিদ বস্তু হিসেবে চাপা দিয়ে রেখে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে থাকে। উদ্ভিদ না থাকলে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বল্গাহীনভাবে বেড়ে যেতে পারে। আর সেটা হলে তাপমাত্রাও বেড়ে যায়। “সায়েন্স” সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণা রিপোর্টে গবেষণাকাল অর্থাৎ ২৫ কোটি ২০ লাখ থেকে ২৪ কোটি ৭০ লাখ বছর আগের তাপমাত্রার এ যাবৎকালের সবচেয়ে বিস্তারিত রেকর্ড তুলে ধরা হয়েছে। সান ও তার সহকর্মীরা দক্ষিণ চীনের ২ টন শিলারাশি থেকে আহৃত ১৫ হাজার প্রাচীন কনোডন্ট অর্থাৎ বিলুপ্ত ঈল জাতীয় মাছের ক্ষুদ্র দাঁত থেকে বিভিন্ন উপাত্ত সংগ্রহ করেন এবং গবেষণা চালান। কনোডন্টের অক্সিজেন আইসোটোপের অনুপাত পরীক্ষা করে তারা কোটি কোটি বছর আগের তাপমাত্রা নির্ণয় করতে সক্ষম হন।

এনামুল হক

No comments

Powered by Blogger.