আ. লীগের নতুন কমিটি-তৃণমূলের আকাঙ্ক্ষাও উপেক্ষিত by পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ১৯তম জাতীয় সম্মেলনকে শুধু নিয়ম রক্ষার সম্মেলন নয়, বরং নতুন নেতা নির্বাচনের সম্মেলন বলে দাবি করেছিলেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। তবে সম্মেলন শেষে ঘোষিত দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
চোখে পড়ার মতো চমকও নেই। ঘুরেফিরে বিগত কমিটির নেতারাই জায়গা করে নিয়েছেন নতুন কমিটিতে।
সদ্য সমাপ্ত সম্মেলনে তৃণমূল থেকে আসা অনেক কাউন্সিলরেরও অভিমত ছিল, দলের সাংগঠনিক ভিত্তি শক্তিশালী করতে এবং আগামী দিনে বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলা করে দলকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করতে সংগ্রামী ও অভিজ্ঞ নেতৃত্ব প্রয়োজন। তাঁদের আকাঙ্ক্ষা ছিল, 'সংস্কারপন্থী' অপবাদ জিইয়ে না রেখে প্রবীণ নেতাদের এবার সভাপতিমণ্ডলীতে যুক্ত করা হবে। সংবাদকর্মীদের কাছে তাঁরা এ আকাঙ্ক্ষা ব্যক্তও করেছেন। কিন্তু নতুন কমিটিতে তৃণমূল নেতাদের সেই আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। এক-এগারোর সময় সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া নেতারা এবারও উপেক্ষিত থাকলেন।
অন্যদিকে দেশব্যাপী সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়াতে এবং বিভিন্ন ইউনিটের সম্মেলন করতে ব্যর্থ হওয়ার পরও বহালতবিয়তে আছেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদকরা। সাড়ে তিন বছরে ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন একটি মাত্র ইউনিটের সম্মেলন করতে সমর্থ হন। ঢাকা মহানগর ইউনিটের সম্মেলন হয়েছে জাতীয় কাউন্সিলের মাত্র দুই দিন আগে। খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক একটিও সাংগঠনিক জেলার সম্মেলন করতে পারেননি। সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মিছ্বাহ উদ্দিন সিরাজ এবং রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনও কোনো জেলা ইউনিটের সম্মেলন করতে পারেননি। অন্যদিকে বরিশাল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম দুটি ইউনিট, রংপুর বিভাগের দায়িত্ব পাওয়া খালিদ মাহমুদ চৌধুরী একটি, চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক বীর বাহাদুর পাঁচটি জেলার সম্মেলন করতে সমর্থ হন। সাড়ে তিন বছরে সম্মেলনের এই চিত্রের পরও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে কোনো পরিবর্তনই আসেনি। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের তিন পদেও কোনো পরিবর্তন নেই।
দীর্ঘদিন ধরে দলের ভেতরে এবং বিভিন্ন ফোরামে দলের প্রবীণ সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে দলের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার গুঞ্জন শোনা গেলেও বাস্তবে তা হয়নি। সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত এই নেতাদের প্রতি দলের সভাপতি শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের সম্মেলনের মতো এবারও অনমনীয় মনোভাব দেখিয়েছেন। মন্ত্রিত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর নিজেকে সভাপতিমণ্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একাধিকবার দলীয় সভাপতির কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলেন তোফায়েল আহমেদ। সভাপতিমণ্ডলীতে তাঁর ঠাঁই হয়নি। এ নিয়ে দলের ভেতরে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। প্রবীণ নেতাদের এবারও রাখা হয়েছে দলের কম গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা পরিষদে।
নতুন কমিটিতে আবারও উপেক্ষিত থেকেছেন সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত মুকুল বোস, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসেন, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, অধ্যাপিকা নাজমা রহমান, হাবিবুর রহমান খান, সাবের হোসেন চৌধুরীসহ অনেকে। তবে সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মান্নানকে এবার কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য করা হয়েছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ার পর এবার কেন্দ্রীয় কমিটি থেকেও বাদ পড়েছেন দলের সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ আবুল হোসেন। তবে একই নির্বাচনী এলাকার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী আবদুস সোবহান গোলাপকে কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য করা হয়েছে।
সভাপতিমণ্ডলী থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে বাদ পড়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। আরো বাদ পড়েছেন রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজু ও অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। নরসিংদীর জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে রাজি উদ্দিন রাজুর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তাঁকে এই পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে বলে মনে করেন দলের অনেক নেতা। তোফায়েল আহমেদকে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য না বানালেও তাঁকে খুশি করার জন্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ। কারণ তোফায়েল আহমেদ ও ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন দুজনের বাড়িই ভোলায়। ২০০৯ সালের সম্মেলনে তোফায়েল আহমেদকে বাদ দিয়ে সভাপতিমণ্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল হুমায়ুনকে।
অন্যদিকে নিজের কর্মদক্ষতায় দলে পদোন্নতি পেয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এবং সাবেক প্রচার সম্পাদক নূহ উল আলম লেনিন। বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় সব সময় রাজপথে থাকা এবং বিগত চার বছরে দলের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার ফল পেয়েছেন মোহাম্মদ নাসিম। অন্যদিকে দলের দাপ্তরিক কর্মকাণ্ড, দলের প্রকাশনা উত্তরণ প্রকাশ এবং অন্যান্য দক্ষতার ফল পেয়েছেন লেনিন। তবে দলের সর্বোচ্চ ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর দুটি পদ এখনো শূন্য আছে। এই পদে কারা আসছেন এ নিয়ে তৈরি হয়েছে কৌতূহল। পদ দুটির একটিতে বরিশাল এবং অন্যটিতে চট্টগ্রাম বিভাগের কারো আসার সম্ভাবনা প্রবল। পদ দুটিতে চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এবং বরিশাল থেকে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ব্যাপারে দলের হাইকমান্ডের ইতিবাচক মনোভাব থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। দলের কার্যনির্বাহী কমিটিতে রাখা হলেও ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের সভাপতিমণ্ডলীতে আসার সুযোগ এখনো রয়েছে বলে দলীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলকে বিগত কমিটির শুধু উপদেষ্টা পরিষদে রাখা হলেও এবার তাঁকে দলের শক্তিশালী ফোরাম পার্লামেন্টারি বোর্ডে রাখা হয়েছে।
দলের প্রবীণ নেতাদের কাছে নতুন কমিটির ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তাঁরা কেউ কিছু বলতে রাজি হননি। তবে আব্দুল জলিল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কমিটি হয়েছে, ভালোই হয়েছে।' আর কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।
গত ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ১৯তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে শেখ হাসিনা সপ্তমবারের মতো দলের সভাপতি এবং সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দ্বিতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে কাউন্সিলররা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে আলোচনার ভিত্তিতে পুরো কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেন। মঙ্গলবার রাতে এবং গতকাল সন্ধ্যায় গণবভনে দলের সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা বৈঠক করে এই কমিটি গঠন করেন। বুধবার রাতে সৈয়দ আশরাফ সংবাদ সম্মেলন করে নতুন কমিটির ঘোষণা দেন।

No comments

Powered by Blogger.