‘ইয়োলো সিøপ’ ও সৌদি নারীরা

তথ্যপ্রযুক্তির নতুন নতুন আবিষ্কার মানুষের মধ্যে যোগাযোগকে করেছে সহজ ও দ্রুত। এর ফলে মানুষের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও জোরদার করেছে। প্রযুক্তি মানুষের স্বাধীনতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। কিন্তু প্রযুক্তির ব্যবহার সব ক্ষেত্রে স্বাধীনতা এনে দেয় না। সৌদি নারীদের ক্ষেত্রেই তা বিবেচনা করা যায়। গত নবেম্বর মাসে সৌদি সরকার সৌদি পুরুদের তথ্য বা এসএমএস প্রদানের মাধ্যমে একটি বিশেষ ব্যবস্থা শুরু করে। এ ব্যবস্থায় সৌদি সরকার দেশটির পুরুষ নাগরিকদের ওপর নির্ভরশীল সৌদি নারীদের যে কোন আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ক্ষেত্রে অনুমতি প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেয়। সৌদি নারীদের জন্য এ ব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। তুলনামূলকভাবে সৌদি নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। সৌদি নারীরা তাদের পুরুষ অভিভাবকদের অনুমতি ব্যতীত শিক্ষা গ্রহণ, গাড়ি চালানো, এমনকি নিজেদের অনেক ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন না। আইনত সৌদি নারীদের অভিভাবক হিসেবে পিতা, স্বামী এবং ছেলে স্বীকৃত। যার ফলে নারীরা যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি নিতে বাধ্য। সৌদি আরবে স্কুলগামী বালিকারা ও তাদের পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। শিক্ষা-দীক্ষা, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কর্মকা-েও নারীর অংশগ্রহণ বাধাহীন নয়। সৌদি নারীদের ৩৪ শতাংশই ঘরের বাইরে নিজেদের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করতে চায়। অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করা সত্ত্বেও নারীরা কার্যক্ষেত্রে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারছে না। সৌদি নারীদের বিশেষ কিছু চিকিৎসাসেবা গ্রহণের জন্যও তাদের পুরুষ অভিভাবকের সম্মতি গ্রহণ করতে হয়। এমতাবস্থায় সৌদি নারীদের স্বাধীনতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। সম্প্রতি কয়েক বছরে সৌদি সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ২০১১ সালে সৌদি সরকার আইন পেশায় নারীদের অংশগ্রহণের অনুমোদন দান করেছে। সৌদি নারীরা এখন আদালতে তাদের মক্কেলের পক্ষে লড়তে পারছে। নিজ নামে তাদের আইন সেবার প্রতিষ্ঠান খুলতে পারছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই প্রযুক্তি মানুষের মধ্যকার সম্পর্কে আরও জোরদার করেছে তা বন্ধু হোক কিংবা পরিবারের মধ্যেই হোক। তথ্যপ্রযুক্তির নতুন নতুন আবিষ্কার মানুষের মধ্যে স্বাধীনতা এন দিয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তি সবসময় স্বাধীন নয়। এ ছাড়া গত বছরই সৌদি সরকার প্রধমবারের মতো অলিম্পিক গেমসে নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে মহিলা ক্রীড়াবিদদের অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যা নারী ক্ষমতায়নের একটি নতুন দ্বার উন্মোচন করবে বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু সৌদি সরকার দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারকে অস্বীকার করছে অনেক ক্ষেত্রেই। আর যতদিন এ অবস্থা বিরাজ করবে, সৌদি সমাজে নারীরা কখনও তাদের প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে না। সৌদি নারীরা যে কোন আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ক্ষেত্রে তাদের পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি বা সম্মতি নিতে বাধ্য। শুধু তাই নয়, পুরুষ অভিভাবকদের সম্মতি প্রদান সম্পর্কিত এসএমএস নোটিফিকেশন ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে দেখাতে হবে। সৌদি সরকার এ ব্যবস্থাকে নারীদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ‘ইয়েল সিøপ’ বলে নামকরণ করেছে। সৌদি সরকার এসএমএস প্রদর্শনের এ ব্যবস্থাকে আরও বিস্তৃত করতে পদক্ষেপ নিয়েছে। চল্লিশ বছর বয়সী ফাতেমা রিয়াদে বসবাস করেন। ইয়েল সিøপ ব্যতীত তিনি বিমানে আরোহণ করতে পারেননি। তালাকপ্রাপ্ত ফাতেমার বাবাও অনেক আগেই মারা গেছেন। আইনত তার পুত্রই তার একমাত্র পরুষ অভিভাবক। পূর্ব প্রদেশে বসবাসকারী তার ছেলে বিমানবন্দরে এসে তাকে দেশত্যাগের অনুমতি দেয়। এরপর তিনি বিমানে আরোহণের অনুমতি পান। ব্রিগেডিয়ার আব্দুল্লাহ আবদেল কাদেরের বরাত দিয়ে আল শার্ক পত্রিকা এসএমএস নোটিফিকেশনকে প্রযুক্তির এক অনন্য সুফল বলে উল্লেখ করে। এ ছাড়া সৌদি সরকার প্রযুক্তির আরও ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে ভবিষ্যতে ই-সার্ভিস প্রদানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বাদশাহ ফাহাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চলাচলকারী যাত্রীদের ৯৫ শতাংশ বর্তমানে এ প্রযুক্তির ব্যবহার করেছে। সৌদি সরকার তা ইতিবাচক বলে উল্লেখ করেছে। প্রকৃতপক্ষে এই ইয়েল সিøপ ব্যবস্থা একদিকে যেমন বৈষম্যমূলক, তেমনি অন্যদিকে ঝামেলাপূর্ণও বটে। এসএমএস বা তথ্য প্রদান ও প্রদর্শনের এই ব্যবস্থাকে প্রযুক্তির সম্মুখগামী নয়, পশ্চাৎমুখী ব্যবস্থাই বলা যায়। কেননা এতে নারীদের চলাচলের আওতাকে সীমিত করে রাখার চেষ্টা করা হয়, যা অত্যন্ত অপমানজনক। তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের এ যুগে সৌদি নারীরা এখনও চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এই তথ্য বা মেসেজ প্রদানের ছোট সমস্যার মধ্যেই সৌদি নারীদের অভিভাবকত্ব ব্যবস্থার বিষয়টি বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃত অর্থে প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকার এগিয়ে এলেও নারীর স্বাধীনতাকেও এখানে মূল্যায়ন করা তো হয়নি এবং নারীর প্রতি মধ্যযুগীয় আচরণের প্রমাণ মেলে। প্রযুক্তির ব্যবহারের দ্বারা সৌদি নারীরা তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হবে, সৌদির বাইরে তাদের সমর্থকদের আজ এই প্রত্যাশা। অন্তত পক্ষে তাদের পশ্চাৎমুখী কৌশলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা উচিত।

সূত্র : ইন্টারনেট

No comments

Powered by Blogger.